প্রবাসে যৌন নির্যাতনের কথা শুনে শরীর কেঁপে ওঠে

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:৪৩ পিএম, ১৭ নভেম্বর ২০১৯

অ্যাডভোকেট সালমা আলী। মানবাধিকার আইনজীবী। সাবেক নির্বাহী প্রধান, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি। নারীর অধিকার ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। বিশেষ করে নারী পাচাররোধ এবং প্রবাসী নারী শ্রমিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রাখছেন এ মানবাধিকার নেত্রী।

সম্প্রতি প্রবাসী নারী শ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। আলোচনায় গুরুত্ব পায় দেশের নারী উন্নয়নও। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ : প্রবাসী নারী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। বিদেশের মাটিতে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে বলে অভিযোগ ঘনীভূত হচ্ছে। কেউ লাশ হয়ে ফিরছেন, কেউ ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরছেন। এমন অভিযোগ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

সালমা আলী : বলতে পারেন, বাংলাদেশের নারীরা ঘরে ও বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। বাংলাদেশের যেসব নারী দেশের বাইরে শ্রম দিতে যাচ্ছেন, তাদের বড় একটি অংশ পরিবার বা সমাজ দ্বারা কোনো না কোনোভাবে নির্যাতিত।

হয় কারও পরিবারে ঠাঁই নেই অথবা স্বামী ছেড়ে দিয়েছে কিংবা গৃহকর্মী বা গার্মেন্টে কাজ করেন- এমন নারীদের নানাভাবে প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়।

জাগো নিউজ : প্রলোভন বলছেন কেন? একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই যাচ্ছেন তারা…

সালমা আলী : না। যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, সেখানে স্বচ্ছতা নেই। যে কাজ করার কথা বলে তারা নিয়ে যায়, সে কাজ তারা করায় না। নিয়োগ প্রক্রিয়ার কিছুই তারা জানতে পারে না। সৌদি আরবে নির্যাতনের কথা কী ভয়াবহ! ফিরে আসা নারীদের মুখেই সব শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে প্রবাসে যৌন নির্যাতনের কথা শুনে শরীর কেঁপে ওঠে। গত সাত মাসে দুই সহস্রাধিক নারী ফেরত এসেছে সৌদি আরব থেকে এবং তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতিত।

জাগো নিউজ : এই যে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া, এজন্য রিক্রুটিং এজেন্সি, না-কি সরকারি ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করবেন?

সালমা আলী : ঘাপলা সব জায়গায়ই। এখানে তিনটি মন্ত্রণালয় কাজ করে। প্রবাসী কল্যাণ, পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখানে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত। তিনটি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় থাকার কথা। কিন্তু এ সমন্বয়ে ব্যাপক ঘাটতি আছে। একজন পুরুষের পাশাপাশি একজন নারীরও বিদেশে গিয়ে শ্রম দেয়ার অধিকার আছে।

একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে মনে করি, প্রত্যেকেরই তার মৌলিক অধিকার রয়েছে। এ অধিকার ভোগ করতে গিয়ে নারী লাশ হয়ে দেশে ফিরছে, এর চেয়ে নির্মমতা আর কী হতে পারে! আমার ২৭ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, নারীর ওপর কীভাবে বর্বর অত্যাচার করা হয়।

মধ্যপ্রাচ্যে একধরনের নির্যাতন, অন্য দেশে আরেক ধরনের নির্যাতন। দক্ষিণ এশিয়ায় নারীদের পাচার করা হয়, জোর করে পতিতাবৃত্তি করানো হয়। মধ্যপ্রাচ্যে কাজের নাম করে নিয়ে নির্মম অত্যাচার করা হয়।

জাগো নিউজ : ২৭ বছরের অভিজ্ঞতার কথা বলছেন। এমন নির্যাতনের খবর আগেও ছিল। এখন বড় করে দেখানো হচ্ছে কি-না?

সালমা আলী : আপনাকে সময় ও বাস্তবতা দেখতে হবে। সভ্যতার এমন সময়ে আপনি নারীর ওপর এমন অমানবিক নির্যাতনের কথা বলতে পারেন না।

এমন নির্যাতনের কারণেই ২০০৯ সালে সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ হয়। নির্যাতনের পাশাপাশি শ্রমিকদের অদক্ষতা এজন্য দায়ী করা হয়েছিল। ওই সময় অনেকেই অনেক যুক্তি দিয়েছিল।

আমরা বলেছিলাম, দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে না পারলে নির্যাতন বন্ধ হবে না। কাজের দক্ষতা নেই। ভাষাগত দক্ষতা নেই। এই অদক্ষতা বজায় রেখেই ২০১৫ সালে ফের সৌদিতে নারী শ্রমিক পাঠানো শুরু হলো। ৯৯ ভাগ নারীই বিদেশে গিয়ে কাজের উপযোগী নয় বলে নানাভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

জাগো নিউজ : সরকার থেকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে- এমনটিও বলা হচ্ছে…

সালমা আলী : জনশক্তি রফতানি ব্যুরো, মন্ত্রণালয় এ প্রশিক্ষণের কথা বলে। কিন্তু আমরা দেখেছি, এ প্রশিক্ষণ আসলে কিছুই না। মৌলিক যে সাপোর্টগুলো পাবার কথা, তা তারা পায় না।

আমি দেখেছি, মধ্যপ্রাচ্যে নির্যাতিত নারীরা দূতাবাসের মৌলিক সাপোর্ট পায় না। আইনি সাপোর্টও পায় না। একজন নারী অসুস্থ হয়ে পড়লে তার দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। এমন চিত্র আমরা প্রায়শই দেখছি।

salma

জাগো নিউজ : সরকার এমন চিত্র-কে তো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলছে…

সালমা আলী : আপনি পত্রিকায় প্রকাশিত ঘটনাপ্রবাহ দেখেন। যে কেউই চমকে উঠবেন। একের পর এক নারীশ্রমিক লাশ হয়ে ফিরছেন। যারা বেঁচে আছেন, তারা অসহনীয় নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এ ধারাবাহিক নির্যাতনের ঘটনা কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন বলা যাবে না। বিচ্ছিন্ন বলে এমন ভয়াবহতা আড়াল করা সম্ভব নয়।

জাগো নিউজ : সরকার আসলে নির্যাতনের ঘটনা আড়াল করতে চাইছে কেন?

সালমা আলী : আড়াল করতে চাইছে নানা পক্ষই এবং সেটা নিজেদের স্বার্থের কারণে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এমন ঘটনা জানার পরও কেন অসহায় নারীদের পাঠানো হচ্ছে? শিক্ষিত, দক্ষ নার্স পাঠানো যেতেই পারে। তারা নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন। কথা বলতে পারবে। চাইলে সে এক জায়গার চাকরি ছেড়ে আরেক জায়গায় চাকরি নিতে পারবে।

তা না করে একজন অশিক্ষিত, অদক্ষ নারীকে পাঠানো হচ্ছে। যিনি নিজের দেশেই ভালো করে কথা বলতে পারেন না, মোবাইলে কথা বলতে পারেন না। নিয়োগকর্তার সঙ্গে কোনো সম্পর্কই থাকে না। এটা তো সরকারপক্ষ অবগত।

নিয়োগকর্তা, যারা পাঠাচ্ছেন, প্রবাসী মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় থাকার কথা। সেটা নেই। প্রত্যেক দেশেই দূতাবাস রয়েছে। নারীরা দূতাবাসের সহায়তা পায় না। অথচ, আমরা দেখেছি, নারীরা পুরুষের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠায়।

এএসএস/এমএআর/জেআইএম

নারী লাশ হয়ে দেশে ফিরছে, এর চেয়ে নির্মমতা আর কী হতে পারে

যে কাজ করার কথা বলে তারা নিয়ে যায়, সে কাজ তারা করায় না

শতকরা ৯৯ভাগ নারীই বিদেশে গিয়ে কাজের উপযোগী নয় বলে নানাভাবে প্রমাণিত

মধ্যপ্রাচ্যে নির্যাতিত নারীরা দূতাবাসের মৌলিক সাপোর্ট পায় না। আইনি সাপোর্টও পায় না

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।