ইউরোপে যাওয়ার প্রলোভনে আলজেরিয়ায় মানবেতর জীবন

৫০ হাজার টাকা বেতন, আছে ইউরোপে যাওয়ার সুযোগ। এমন স্বপ্ন নিয়ে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়ায় যান মানিকগঞ্জের মো. জসিম। কিন্তু সেখানে গিয়ে তার স্বপ্নভঙ্গ হয়। সাত মাস অমানসিক কষ্ট সহ্য করে মাত্র এক মাসের বেতন নিয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হন তিনি।
শুধু জসিম নন, পরিবারের পাঠানো টাকায় বিমানের টিকিট কেটে গত ২৭ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরেছেন আরও নয়জন। রিক্রুটিং এজেন্সির স্পেনে পাঠানোর প্রলোভনে পা দিয়ে মরোক্কোয় অবস্থান করছেন চারজন। আলজেরিয়ায় এমন প্রলোভনে পড়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন আরও প্রায় ২২ বাংলাদেশি। এক ভিডিও বার্তায় তারাও দেশে ফেরার আকুতি জানিয়েছেন।
তাদের মধ্যে সাতজনের পরিবারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠি দিয়েছে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আলজেরিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসকে নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
আলজেরিয়ায় অবস্থান করা এবং ফেরত আসা কর্মীরা জানান, মাসে ৫০ হাজার টাকা এবং ইউরোপে পাঠানোর স্বপ্ন ও প্রলোভন দেখিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সি বন্যা বিজয় ওভারসিজ ও মুন্সীগঞ্জের সিঙ্গাপুর স্কিল ট্রেনিং সেন্টার বিএমইটির ছাড়পত্র দিয়ে তাদের আলজেরিয়া পাঠানো হয়। জনপ্রতি তিন লাখ পাঁচ হাজার টাকা খরচে ৫৫ জন বাংলাদেশি সেখানে যান। আলজেরিয়া যাওয়ার পর সেখানে কাজ দিলেও কোম্পানি ঠিক মতো বেতন এবং পর্যাপ্ত খাবার দেয়া থেকে বিরত থাকে। বেতন চাইলে কোম্পানির লোকজন মারধর করে।
ফেরত আসা মো. জসিম জাগো নিউজকে বলেন, আলজেরিয়ার বিমানবন্দরে নামার পর সেখান থেকে প্রায় আট ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের কাজের স্থানে নেয়া হয়। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর আমাদের সব স্বপ্ন ভেঙে যায়। আবাসন থেকে শুরু করে কোনো কিছুই ভালো ছিল না। জায়গাটি ছিল বসবাস অযোগ্য। তারপরও কাজ শুরু করি। কিন্তু মাস চলে যায় বেতন পাই না। বেতন চাইলে মারধর করে। এজেন্সিও আর কোনো দায়িত্ব নিতে চায়নি। তারা জানায়, আরও কিছু টাকা দিলে আলজেরিয়া থেকে স্পেনে পাঠাবে। কিন্তু আমি দেশে ফিরতে চাইলে পরিবারকে টাকা দিতে বলা হয়। পরে পরিবারের সহায়তায় দেশে ফিরে আসি।
‘পরে দেড় মাস জেল খাটার পর আলজেরিয়া থেকে দেশে ফিরে আসি’- জানান জসিম।
তিনি আরও বলেন, ‘গত বছর বন্যা বিজয় ওভারসিজ ও মুন্সীগঞ্জের সিঙ্গাপুর স্কিল ট্রেনিং সেন্টারের পক্ষ থেকে আমাদের এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছিল আলজেরিয়ায় সুলভ মূল্যে দ্রুত লোক পাঠানো হবে। সেখানে যাওয়ার পর দেখি ১২টার মতো টেবিল নিয়ে এজেন্সির স্যাররা বসে আছেন। স্যাররা জানান, দুই লাখ টাকার বিনিময়ে আলজেরিয়ায় কোম্পানির কাজ পাব। ৫০ হাজার টাকা বেতন। শুধু তা-ই নয়, ম্যাপ দেখিয়ে বলা হয় সেখান থেকে স্পেন কাছে হওয়ায় তারা ইউরোপের ওই দেশটিতেও যেতে পারবেন।’
জসিম বলেন, পরদিন ঢাকা ও আলজেরিয়া থেকে আসা লোকজন ইন্টারভিউ নেয়। আমাকে সিলেক্ট করে। আমি ৫০ হাজার টাকা জমা দেই। ছয় মাস পর ভিসার কথা বলে একটা কাগজ দেয়। তখন বাকি জমা টাকা দেই। তবে টাকার রসিদ চাইলে দেয়া হয়নি। ছবি তুলতে চাইলেও মোবাইল কেড়ে নেয়। তারও কিছুদিন পর আরও এক লাখ টাকা করে দিতে বাধ্য করে তারা। সর্বশেষ আলজেরিয়া যাওয়ার আগে ইন্স্যুরেন্সের নামে আরও পাঁচ হাজার ৩০০ করে টাকা নেয়।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বন্যা বিজয় ওভারসিজ ও মুন্সীগঞ্জের সিঙ্গাপুর স্কিল ট্রেনিং সেন্টার। বন্যা বিজয় ওভারসিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরুন দেবনাথ এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি দেখাশোনা করে মুন্সীগঞ্জের সিঙ্গাপুর স্কিল ট্রেনিং সেন্টার। তারাই ভালো বলতে পারবে। সব তথ্য তাদের কাছে আছে। তবে আমরা বৈধভাবে আলজেরিয়ায় কর্মী পাঠাই।’
মুন্সীগঞ্জের সিঙ্গাপুর স্কিল ট্রেনিং সেন্টারের ম্যানেজার রাশেদা মোল্লা রাশু জাগো নিউজকে বলেন, ‘একেক স্থানের পরিবেশ একেক রকম। যাওয়ার পরে ওরা এক মাস খুব কষ্ট করেছে। আমি ওদের বুঝিয়ে কাজ করাই। দুই মাস পর পরিবেশ ভালো হয়। তবে কোম্পানির শর্ত ছিল দক্ষ কর্মীদের ৪০০ মার্কিন ডলার এবং অদক্ষদের ৩০০-২৫০ মার্কিন ডলার দেবে। কিন্তু কর্মীরা সেটা মানতে রাজি হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘তিন মাস পরপর তাদের বেতন দেয়া হচ্ছে। এখন তারা বলছে, সেখানে খাওয়া, বাথরুমের সমস্যা। এ বিষয়েও তাদের ধৈর্য ধরতে বলেছি। কিন্তু তারা একসাথে আন্দোলন শুরু করে কোম্পানির বিরুদ্ধে। তাদের মধ্যে সাত-আটজন স্পেনে যাওয়ার লোভে মরোক্কো প্রবেশ করে, পরে সেখানে জেল খাটে। আমরা বৈধভাবে আলজেরিয়ায় কর্মী পাঠাই। স্পেনে যাওয়ার প্রলোভন দেখাইনি। তারা নিজেরাই সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করে।’
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ এ বিষয়ে জাগো নিউজকে বলেন, মানবেতর জীবন-যাপন করা বাংলাদেশিদের দ্রুত ফেরত আনা হবে। পাশাপাশি এসব এজেন্সির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে লাইসেন্স বাতিল করা হতে পারে।
এখন পর্যন্ত নানা অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ১৬টি রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে বলেও জানান মন্ত্রী।
ব্র্যাক মাইগ্রেশনের প্রোগ্রাম প্রধান শরিফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আলজেরিয়ার মাধ্যমে শ্রমিকদের ইউরোপে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল নিয়োগকারীদের। এটি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। এ বিষয়ে সরকারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, আলজেরিয়ায় আটকে পড়া শ্রমিকদের মধ্যে সাতজনের পরিবার ব্র্যাকের কাছে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা চেয়েছিল। সে অনুযায়ী তাদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করা হয়।
জেপি/আরএস/এমএআর/এমএস