শর্তে হলেও খালেদার মুক্তির দাবি তৃণমূলে
সর্বাত্মক কার্যকর আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবে পূর্ণাঙ্গ সাংগঠনিক অবকাঠামো না থাকা এবং অভ্যন্তরীণ কিছু নেতার ব্যক্তিস্বার্থের কারণে দলীয়প্রধানের মুক্তির আন্দোলন ব্যর্থ হচ্ছে। আন্দোলন ছাড়া দলীয়প্রধানের মুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়- অনেকে এমনটি মনে করলেও বেগম জিয়ার স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রয়োজনে যেকোনো শর্তে তাকে মুক্ত করার দাবি উঠেছে তৃণমূলে।
জাতীয়তাবাদী মৎস্যজীবী দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যক্ষ সেলিম মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলকভাবে সরকার দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে আটকে রেখেছে, তার জামিনে বাধা দিচ্ছে। তার মুক্তির জন্য যে আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার সেটা হচ্ছে না। ম্যাডামের বয়স, অসুস্থতার বিষয়টি বিবেচনা করে তার মুক্তি জরুরি। উন্নত চিকিৎসা জরুরি। তাই যেকোনো শর্তে হলেও ম্যাডামের মুক্তির ব্যবস্থা করা উচিত বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ম্যাডামকে আপসহীন রাখতে গিয়ে অন্যরা সরকারের সঙ্গে মিলে আঁতাত করবে- এটা হতে পারে না। ’
জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মো. আক্তার হোসেন বলেন, ‘প্যারোলের বিষয়টা দলীয়ভাবে শোভনীয় নয়, পরিবার থেকে যদি আবেদন করা হয় তবে সেটা ভিন্ন বিষয়।’
‘আন্দোলন সেভাবে গড়ে উঠছে না বলে মুক্তি মিলছে না’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সরকার জামিনে বাধা দিচ্ছে, যে কারণে আইনি প্রক্রিয়ায় তার মুক্তি হচ্ছে না। একমাত্র আন্দোলনের মাধ্যমেই মুক্তি সম্ভব।’
জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের কেন্দ্রীয় সদস্য কে এম রকিবুল ইসলাম রিপন বলেন, ‘অবৈধ সরকারের কাছে যারা প্যারোলে মুক্তি চাইবে তারা ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত হবে। সিনিয়র নেতারা প্রকাশ্যে বলেছেন, আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ষড়যন্ত্র করছেন। গণতন্ত্রের আপসহীন নেত্রীর জন্য প্যারোল আবেদন, আমিও ষড়যন্ত্র মনে করি। এতদিনে আন্দোলন গড়ে না উঠলেও আমি আশাবাদী, একমাত্র রাজপথের উত্তাল আন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের মাতা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে।’
তিনি বলেন, ‘যারা প্যারোলের কথা বলেন, তাদের বলব, প্যারোল কেন? যেকোনো বিবেচনায় তিনি জামিনযোগ্য, সেটা তো এ অবৈধ সরকার দিচ্ছে না। এজন্য আন্দোলনের বিকল্প নেই।’
জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হেলেন জেরিন খান বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলকভাবে ভিত্তিহীন মামলায় সাজা দিয়ে আটক রাখা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে। তাকে জামিন দেয়া হচ্ছে না। জামিন আটকে দেয়া হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ম্যাডামের মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ম্যাডাম আপসহীন নেত্রী। তার কর্মী হয়ে আমরা প্যারোলের বিষয়টি উচ্চারণ করতে পারি না।’
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) মো. হানিফ বলেন, ‘যেহেতু ম্যাডামকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আটকে রাখা হয়েছে। কাজেই রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া মুক্তি হওয়া সম্ভব নয়। রাজনৈতিক সদিচ্ছা তখনই সরকারের হবে যখন সরকারকে বাধ্য করা হবে এবং এজন্য একমাত্র উপায় হলো আন্দোলন। সেই আন্দোলন করতে হলে সাংগঠনিক প্রস্তুতি দরকার।’
‘দলে আগে থেকে সাংগঠনিক প্রস্তুতি না থাকায় আমরা আন্দোলন গড়ে তুলতে পারিনি এবং ম্যাডামকে মুক্ত করতে পারিনি। আইনি প্রক্রিয়ায় তার মুক্তি সুদূরপরাহত। একমাত্র আন্দোলন অথবা সরকার যদি ইচ্ছা না করে তার মুক্তির সম্ভাবনা নেই। তাকে মুক্ত করার জন্য যে আন্দোলন দরকার সেই আন্দোলন আমরা করতে পারিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আন্দোলন করতে হলে যে পূর্বপ্রস্তুতি দরকার সেগুলোর অভাব এখনও আমাদের রয়েছে। যেমন- একটা কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে সাংগঠনিক অবকাঠামো সুদৃঢ় থাকতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সাংগঠনিক অবকাঠামো সুদৃঢ় নয়। আমাদের মূল দলের ৮৩টি সাংগঠনিক জেলা, অধিকাংশ জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই, অঙ্গ-সংগঠনের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। কোনো কোনো সংগঠনে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে, কোনো সংগঠনে সুপার ফাইভ, সুপার সেভেন কমিটি আছে। রুট লেভেল পর্যন্ত যদি সাংগঠনিক অবকাঠামো না থাকে তবে একটা কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলা যায় না। এ প্রস্তুতিটা সময়সাপেক্ষ। সাংগঠনিক অবকাঠামো না করে সর্বাত্মক আন্দোলনে যাওয়া যায় না।’
হানিফ আরও বলেন, ‘প্রথমত, ম্যাডাম প্যারোল নিতে অনিচ্ছুক। উনি বলেছেন, এখানে আমার বিনা চিকিৎসায় যা-ই হোক প্যারোলে মুক্তি নেব না। আরেকটি হলো, প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি তো সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। আবেদন করলেই যে প্যারোলে মুক্তি দেবে, সেটার নিশ্চয়তা কি আগে কেউ দিতে পারবে? সরকার কি বলেছে যে, উনি প্যারোলের আবেদন করলে আমরা মুক্তি দেব। রাজনৈতিকভাবে ও দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা প্যারোলে মুক্তির পক্ষে নই। আমরা মনে করি, তার জামিন পাওয়া আইনগত অধিকার। সব বিবেচনায় তিনি জামিন পাওয়ার যোগ্য। আমরা তো সেই জামিন চাই, জামিনে তাকে মুক্তি দেয়া হোক। প্যারোলে মুক্তির জন্য উনি রাজি নন।’
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ বলেন, ‘না, প্যারোলে মুক্তির জন্য আবেদন করা উচিত বলে মনে করি না। ম্যাডাম যদি এটা একসেপ্ট (মেনে নেয়া) করেন, সেটা ভিন্ন কথা। প্যারোলে মুক্তির আবেদন করা হচ্ছে সরকারের কাছে একধরনের আত্মসমর্পণ করা। বেগম খালেদা জিয়া এ ধরনের আত্মসমর্পণ করবেন- এটা আমি বিশ্বাস করি না।’
তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়ার জন্য সরকার তাকে জেলে ঢুকায়নি। সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক চিন্তা থেকে খালেদা জিয়াকে একটি হটকারি মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে এবং পরিকল্পিতভাবে সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপে বারবার জামিন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সব বিবেচনায় বেগম খালেদা জিয়া জামিন পাওয়ার যোগ্য। আমরা আন্দোলনের কথা বলছি খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য, কিন্তু তার মুক্তির জন্য যে আন্দোলন করা দরকার সে আন্দোলন হয়তো করতে পারছি না, নয়তো আমাদের কেউ কেউ করতে দিচ্ছে না। খালেদা জিয়ার মুক্তি যদি নিশ্চিত করতে হয়, নির্ঘাত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। সেই আন্দোলনের জন্য মাঠপর্যায়ের কর্মীরা প্রস্তুত। প্রস্তুত না নেতারা। নেতারা যদি যথাযথ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে আন্দোলন শুরু করতে পারেন, সরকার খালেদা জিয়াকে ছেড়ে দিতে বাধ্য। কারণ এ বিষয়ে জনগণের একটা চাপ রয়েছে সরকারের ওপর।’
কেএইচ/এমএআর/এমএস