সৌদির ‘অযৌক্তিক শর্ত’ মেটাতে বাড়ছে এজেন্সির সংখ্যা
>> নারীকর্মী না পাঠালে পুরুষকর্মী নয়- এমন শর্ত সৌদি সরকারের
>> ফিলিপাইন নারীকর্মী পাঠানো বন্ধের পর নতুন এ শর্ত দেয় সৌদি
>> অভিজ্ঞতাহীন এজেন্সির কারণে বাড়ছে নারী নির্যাতনের ঘটনা
>> ২০১৮ সাল থেকে প্রতি মাসে গড়ে ২০০ নারীকর্মী দেশে ফিরেছেন
১৯৯১ সাল থেকে বিদেশে নারীকর্মী পাঠাতে শুরু করে বাংলাদেশ। পরবর্তী ২৪ বছর পর্যন্ত শুধুমাত্র ১৫ রিক্রুটিং এজেন্সি বিদেশে নারীকর্মী পাঠানোর অনুমতি পায়। কিন্তু গত চার বছরে রিক্রুটিং এজেন্সির সংখ্যা ৬০০ ছাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে এখন ৬২১ রিক্রুটিং এজেন্সির বিদেশে নারীকর্মী পাঠানোর অনুমতি রয়েছে।
অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাতারাতি এত এজেন্সিকে নারীকর্মী পাঠানোর অনুমতি দেয়ায় এ খাতে কল্যাণ বয়ে আনেনি। কোনো ধরনের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই নারীকর্মী পাঠাচ্ছে এসব এজেন্সি। ফলে নারীদের সুরক্ষার বিভিন্ন দিক উপেক্ষিত থাকছে। বাড়ছে বিদেশে নারী নির্যাতনের সংখ্যাও।
সূত্র জানায়, নারীকর্মী না পাঠালে পুরুষকর্মী নেয়া হবে না- সৌদি আরবের এমন অলিখিত শর্তের কারণে রাতারাতি এসব রিক্রুটিং এজেন্সি নারীকর্মী পাঠাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। সর্বশেষ গত ৯ অক্টোবর ৫৮ রিক্রুটিং এজেন্সি নারীকর্মী পাঠানোর অনুমতি পায়। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মোহাম্মদ শাহীন স্বাক্ষরিত আদেশে এ অনুমতি দেয়া হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অনুমতির পাশাপাশি এসব এজেন্সিকে নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিং করা খুবই জরুরি। কারণ সম্প্রতি বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেরত আসা নারী গৃহকর্মীদের বিষয়ে জড়িত রিক্রুটিং এজেন্সিদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো শাস্তির দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করা যায়নি।
তবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে অনিয়ম পেলেই ব্যবস্থা নেব। প্রয়োজনে লাইসেন্সও বাতিল করা হবে।
‘তবে নারীকর্মীদের নির্যাতনের বিষয়ে সৌদি আরবের আইনে হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সমস্যা সমাধনে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে’ বলেও জানান তিনি।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব সেলিম রেজা জাগো নিউজকে বলেন, অভিযোগ পেয়ে ইতোমধ্যে বেশকিছু এজেন্সিকে জরিমানা করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বন্ধ রাখে সৌদি আরব। কয়েক বছর ধরে সৌদির শ্রমবাজারে কর্মী নিয়োগের বিষয়ে আলোচনা চললেও তা খুলছিল না। এরই মধ্যে নির্যাতনের অভিযোগ এনে ফিলিপাইন সৌদিতে নারীকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দেয়। তখন সৌদি আরব বাংলাদেশ থেকে একজন পুরুষকর্মীর সঙ্গে একজন নারীকর্মী দেয়ার শর্ত জুড়ে দেয়। বাংলাদেশ অন্যতম বৃহৎ এ শ্রমবাজার উন্মুক্ত করতে মাত্র ৯০০ রিয়াল বেতনের বিনিময়ে নারীকর্মী পাঠাতে রাজি হয় সরকার।
সূত্র জানায়, এমন পরিস্থিতিতে নারীকর্মী না পাঠালে পুরুষকর্মী পাঠাতে পারছিল না রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। ফলে মাত্র চার বছরে ১৫টির পরিবর্তে ৬২১ রিক্রুটিং এজেন্সির অনুমতি মেলে।
বায়রার একাধিক সদস্য জানান, সৌদি সরকারের অলিখিত এ বাধ্যবাধকতার কারণে অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা নারীকর্মী পাঠাচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বায়রার এক নেতা জাগো নিউজকে বলেন, সৌদি দূতাবাস নারীকর্মী পাঠানোর লাইসেন্স করতে আমাদের বাধ্য করছে। নারীকর্মী পাঠানোর লাইসেন্স না থাকলে সেসব রিক্রুটিং এজিন্সর কোনো বই তারা জমা নিচ্ছে না।
এসব এজেন্সির ওপর সরকারের আরোপিত শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে- নারী গৃহকর্মী পাঠাতে অনুমতিপ্রাপ্ত প্রতিটি রিক্রুটিং এজেন্সিকে নিরাপত্তা জামানত বাবদ ১৫ লাখ টাকা এফডিআর আকারে বিএমইটির মহাপরিচালকের অনুকূলে লিয়েন মার্ক করে জমা দিতে হবে। কেবল নিরাপত্তা জামানত বাবদ ১৫ লাখ টাকা জমা দেয়ার পরই সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সি বিদেশে নারী গৃহকর্মী প্রেরণ প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে। গৃহকর্মীর কাছ থেকে অভিবাসন ব্যয় বাবদ কোনো অর্থ গ্রহণ করতে পারবে না রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, বিদেশে নারীকর্মী পাঠানো বেশ স্পর্শকাতর বিষয়। অনেক কিছু জানতে হয়। তাদের নিরাপত্তাসহ নানা বিষয় দেখভাল করতে হয়। অথচ রাতারাতি ছয় শতাধিক এজেন্সি সেই অনুমতি পেল, যাদের অনেকেরই অভিজ্ঞতা নেই। যারা এসব সংবেদনশীলতা বা নিরাপত্তার বিষয়গুলোও বোঝে না। যে কারণে নারীনির্যাতন বাড়ছে।
তিনি বলেন, ‘যাদের সক্ষমতা আছে, যারা নারীকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে, দেখভাল করতে পারবে তাদেরই নারীকর্মী পাঠানো উচিত। আমি মনে করি সর্বসাকুল্যে ৫০টির বাইরে অন্য এজেন্সির এ যোগ্যতা নেই।’
তবে বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম মনে করেন, অনেক বেশি এজেন্সি অনুমতি পেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি হবে। এতে নারীকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করাও সহজ হবে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্রে জানা গেছে, গত বছর সৌদি যায় ৭৩ হাজার ৭১৩ নারীকর্মী। ২০১৭ সালে ছিল ৮৩ হাজার ৩৫৪। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত সৌদি গেছেন ৪৪ হাজার ৭১৩ নারীকর্মী।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে প্রতি মাসে গড়ে ২০০ নারী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন। একই সঙ্গে সৌদি আরবের রিয়াদ ও জেদ্দায় সেফহোমে গড়ে ২০০ নারী শ্রমিক আশ্রয় নিয়েছেন। গত দু-তিন বছরে অন্তত পাঁচ হাজার নারী সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। এসব নারীর একটি বড় অংশ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার।
জেপি/এএইচ/এমএআর/জেআইএম