কৌশলগত দূরত্বে অলি-ইবরাহিম, ভাঙনে কি ২০ দল?
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের কার্যক্রমে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি- এলডিপি চেয়ারম্যান ড. অলি আহমেদ এবং বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের ক্রমাগত অনুপস্থিতিতে রাজনৈতিক মহলে মেলছে নানা গুঞ্জনের ডালপালা। জোটের এমন পরিস্থিতিতে শরিকদের কয়েকজন বিএনপিতে যোগদানের অপেক্ষায় রয়েছেন।
সূত্র মতে, ২০ দলের প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে এলডিপি চেয়ারম্যান অলি আহমেদকে স্বীকৃতি না দেয়ায় জোটের কয়েকটি দল নিয়ে বিএনপির সঙ্গে কৌশলগত দূরত্ব বজায় রাখছেন তিনি। এরই অংশ হিসেবে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে (১) এলডিপি, (২) কল্যাণ পার্টি, (৩) বাংলাদেশ জাতীয় দল, (৪) জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি- জাগপা, (৫) বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, (৬) খেলাফত মজলিস, (৭) ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভগ্নাংশ, (৮) জমিয়তে উলামায়ে- ২০ দলীয় জোটের এ আটটি দল নিয়ে গঠন করেন ‘জাতীয় মুক্তিমঞ্চ’। জোটের মধ্যে গড়ে ওঠা নতুন জোটের অধিকাংশ শরিক দলের শীর্ষ নেতারা মুক্তিমঞ্চের কর্মসূচিতে থাকলেও যাচ্ছেন না ২০ দলীয় জোটের কার্যক্রমে। জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা একমাত্র ২০ দল ও মুক্তিমঞ্চের কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন।
প্রায় চার মাস পর গত ১০ অক্টোবর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ২০ দলীয় জোটের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এদিন মুক্তিমঞ্চের কর্মসূচিতে এলডিপি সভাপতি অলি আহমেদ এবং কল্যাণ পার্টির সভাপতি সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরামি অংশ নিলেও ২০ দলের কর্মসূচিতে যাননি।
আবার জাতীয় মুক্তিমঞ্চ-কে কেউ কেউ বাঁকা চোখে দেখছেন। বিএনপিকে বাদ দিয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবির আড়ালে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলেও কেউ কেউ মনে করছেন। ২০ দল ও মুক্তিমঞ্চের এমন পরিস্থিতিতে কয়েকটি দল দুই প্লাটফর্মের কর্মসূচিতে নিষ্ক্রিয় থাকছেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ‘অযোগ্য’ ও ‘ব্যর্থ’ আখ্যা দিয়ে ২০ দলের কার্যক্রমে যাচ্ছেন না জাগপা সভাপতি ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধান। মুক্তিমঞ্চের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে তাসমিয়াকে দেখা গেলেও পরবর্তীতে আর দেখা যায়নি। বর্তমানে দুই প্লাটফর্মের কর্মসূচিতে দলটির সাধারণ সম্পাদক অংশ নিচ্ছেন। জামায়াতে ইসলামীরও তৃতীয়-চতুর্থ সারির নেতারা দুই জোটের কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। এনডিপি, জমিয়তে উলামায়ে, খেলাফত মজলিস দুই জোটভুক্ত থাকলেও এখন দুই জোটেই তারা নিষ্ক্রিয়। ২০ দলের কর্মসূচিতে পিপলস লীগও নিষ্ক্রিয়। তবে পিপলস পার্টি অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান রীটা রহমানের মতো জোটের বেশ কয়েকটি দলের নেতারা বিএনপিতে যোগদানের অপেক্ষায় আছেন।
২০ দলের এক শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘এলডিপি চেয়ারম্যান অলি আহমেদ এবং কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বিএনপি ও ২০ দল ভাঙার চক্রান্ত করছেন। তারা হয়তো জোট ছেড়ে দিচ্ছেন। জোটের মধ্যে জোট গঠন করে তারা এক জোটের কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন, আর অন্য জোটের কর্মসূচিতে তৃতীয় বা চতুর্থ সারির নেতাদের পাঠাচ্ছেন। বিশেষ করে অলি আহমেদ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বা স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের নেতৃত্ব মানতে পারছেন না। এ ক্ষোভ থেকে তিনি এসব করছেন বল অনেকে মনে করছেন।’
তবে ২০ দলের কর্মসূচিতে নিজের অনুপস্থিতির প্রসঙ্গে সৈয়দ ইবরাহিম বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, তাই কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সব সময় আমার যেতে হবে, এমন তো নয়। অন্য নেতাদের পাঠানো হয়েছে যাতে তারা রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ক হয়।’
ইবরাহিম বলেন, ‘আমরা ২০ দলে ছিলাম, আছি এবং থাকব। ২০ দলের ভেতরে থেকেই জাতীয় মুক্তিমঞ্চের রাজনৈতিক কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাব।’
২০ দলের কার্যক্রমে অলির অনুপস্থিতির প্রসঙ্গে এলডিপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদৎ হোসেন সেলিম বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে অলি সাহেব ২০ দলের মিটিংয়ে যান না। দলের পক্ষ থেকে আমি বা রেদোয়ান সাহেব (মহাসচিব) প্রতিনিধিত্ব করতাম। কিন্তু সম্প্রতি আমি ও রেদোয়ান সাহেব দেশে না থাকায় আমরা প্রতিনিধিত্ব করতে পারিনি। আমাদের অন্য নেতারা প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এর মানে এই নয় যে, আমরা জোট ছেড়ে দিচ্ছি। এখানে গুজব, সন্দেহ, অবিশ্বাসের কোনো অবকাশ নাই। আমরা ২০ দলীয় জোটে আছি এবং ২০ দলীয় জোটে থাকব। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করাই আমাদের লক্ষ্য।’
শোনা যাচ্ছে, আপনি এলডিপি ছেড়ে বিএনপিতে যোগদানের অপেক্ষায় আছেন- এমন প্রশ্নে সেলিম বলেন, ‘বিএনপিতে যোগ দেয়ার ব্যাপারে দ্বিমত নাই। সেজন্য তো অপেক্ষা করতে হবে। আমরা তো দীর্ঘ সময় ধরে এ ব্যাপারে বিএনপির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছি, এটা তো চলমান আছে। তবে বিষয়টা এ মুহূর্তে নিশ্চিত নয়, আবার বিএনপির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগতভাবে কোনো দূরত্বও নাই।’
তিনি বলেন, ‘যোগদানের ব্যাপারে সরাসরি বিএনপির হাই কমান্ডের সঙ্গে আমরা কথা হয়নি। তবে হাই কমান্ড আমার ব্যাপারে আন্তরিক।’
মুক্তিমঞ্চের বাইরে থাকা ২০ দলের নেতা লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, ‘অলি-ইবরাহিম সাহেবরা ২০ দলের কর্মসূচিতে নিজেরা না আসলেও তাদের দলের প্রতিনিধিরা অংশ নিচ্ছেন। এর মানে এই নয় যে, তারা জোট ছেড়ে যাচ্ছেন। জামায়াতে ইসলামীর আমির বা সেক্রেটারি জেনারেলও কিন্তু ২০ দলের কর্মসূচিতে আসেন না।’
‘কেউ যদি জোট ছেড়ে যেতে চায় তবে সেটা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তবে আমি মনে করি, বিএনপি বা ২০ দলের বাইরে গিয়ে কেউ খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না। দেখেন, আন্দালিভ রহমান পার্থ, জেবেল রহমান গানি, খন্দকার গোলাম মোর্ত্তজারা কিন্তু রাজনীতি থেকে হারিয়ে গেছেন। তাদের কর্মকাণ্ড কিন্তু এখন আর কারও চোখে পড়ে না।’
২০ দল ও মুক্তিমঞ্চ- দুই প্লার্টফর্মেই সক্রিয় থাকা বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, জাতীয়তাবাদী শক্তির মধ্যে কোনো বিভেদ নাই। বিএনপি, ২০ দলীয় জোট, জাতীয় মুক্তিমঞ্চ অটুট রয়েছে, কেউ বিভেদের ঘোষণা দেননি। ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় মুক্তিমঞ্চ স্ব স্ব কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘সরকার দেশে অগণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে। গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। যে কারণে ২০ দলীয় জোটের বৈঠক অনিয়মিতভাবে হচ্ছে। ফলে জোটের মধ্যে হালকা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে, এটাকে সমন্বয়হীনতাও বলা যায়। নিয়মিত বৈঠক হলে এসব ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে জোট আরও বেশি শক্তিশালী হবে।’
‘গণতন্ত্রের মাতা আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে জাতীয় মুক্তিমঞ্চ গঠন করা হয়েছে। তার মুক্তির দাবি শুধু বিএনপি, ২০ দল বা মুক্তিমঞ্চের নয়। দেশের আপামর জনসাধারণ ও গণতন্ত্রকামী মানুষ বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি চায়’- যোগ করেন তিনি।
কেএইচ/এমএআর/জেআইএম