পঞ্চম শ্রেণির ৯৫ ভাগ শিক্ষার্থীই দ্বিতীয় শ্রেণি পাসের সমতুল্য
অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। ১৯৫৪ সালে কুষ্টিয়া শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি এবং জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৮ সালে রাশিয়ার মস্কো ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ইকোনমি থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেন। একই প্রতিষ্ঠান থেকে উন্নয়নের রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। তার ৬০০টির বেশি গবেষণাকর্ম এবং ২৪টি গবেষণাগ্রন্থ রয়েছে।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে জাগো নিউজের মুখোমুখি হন বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন প্রসঙ্গ নিয়ে। দীর্ঘ আলোচনায় উন্নয়ন ও বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শন নিয়ে আলোকপাত করেন। বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু একধরনের সমাজতন্ত্র চেয়েছিলেন। তা না হলে কেন তিনি শোষিতের গণতন্ত্রের কথা বললেন?’ বর্তমান রাজনীতি, অর্থনীতি প্রসঙ্গে মতামত প্রকাশ করেন। ‘বর্তমান উন্নয়ন আশাব্যঞ্জক’ বলেও মত দেন। পাঁচ পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে তৃতীয়টি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন অনেকেই। আবার এ উন্নয়ন নিয়ে নানা প্রশ্নও আছে। আপনার বিশ্লেষণ কী?
আবুল বারকাত : কেমন উন্নয়ন- এ নিয়ে প্রশ্ন করে লাভ নেই। প্রশ্নের খাতিরে প্রশ্ন করলে তো হবে না। প্রশ্নটা হতে হবে যুক্তিসঙ্গত ও সময়োপযোগী। প্রশ্ন তো আমিও ইতোমধ্যে তুলেছি। যেমন- পদ্মা সেতু নির্মাণে টোল আদায়ের প্রসঙ্গ আসছে। সরকার যদি মনে করে যারা সেতু পারাপার করবে তাদের কাছ থেকে আদায় করা টোল থেকে এর নির্মাণ ব্যয় তোলা হবে। এটি করলে সরকার ভুল করবে।
আমাকে ভাবতে হবে পদ্মা সেতুর কারণে ১৭টি জেলা সরাসরি ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। মংলা সমুদ্র বন্দরও যুক্ত হলো। বেনাপোল স্থলবন্দরও যুক্ত হলো। এ সেতু-কে কেন্দ্র করে ওই ১৭ জেলার পাশাপাশি সারাদেশে শিল্পায়ন গড়ে তোলার কথা ভাবতেই হবে। সময়ক্ষেপণ করা যাবে না। পরিকল্পনাটা এখনই করতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে এবং বেসরকারি খাতকে জাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গড়ে তুলছেন, হাল্কা শিল্প গড়ে তুলছেন- এসব ভালো কথা। এখন আপনাকে ভারী শিল্প গড়ে তুলতে হবে। যেমন- গার্মেন্টসের জন্য বাইরে থেকে মেশিন আমদানি করছেন। এমন শিল্প গড়ে তোলেন যা মেশিন বানানোর মেশিন বানাবে অর্থাৎ ভারী শিল্প। আমি তো কল্পনা করি, বাংলাদেশ ২০ বছরের মধ্যে প্লেন বানাতে পারবে। হেলিকপ্টার বানাতে পারবে। এ ভাবনা তো অমূলক নয়।
মন্ত্রীরা চার চাকার গাড়ির পরিবর্তে হেলিকপ্টার ব্যবহার করলে অসুবিধা কোথায়? একজন মন্ত্রীর সময়ের দাম আছে। আমি একজন ভালো মানের মন্ত্রীর কথা বলছি। ধরুন, তিনি উন্নয়ন নিয়ে বরিশালে গিয়ে একটি অফিসিয়াল মিটিংয়ে যোগ দেবেন। গাড়িতে পথে যেতে-আসতে দুদিন পার হয়ে যায়। আবার একটি মিটিংয়ে চারজন মন্ত্রী একসঙ্গে যোগ দিলেন। চারবার যেতে হলো না। এক হেলিকপ্টারেই সমাধান। এক লাখ ৬০ হাজার টাকা ভাড়া আসতে পারে। আপনার বহু সময় বাঁচল। বিশাল গাড়ির বহরও থাকল না। গাড়ির জন্য যে শুল্ক রেয়াত তা থেকেও সাশ্রয় হলো। সবাইকে ব্যস্তও রাখলেন না। শারীরিক ধকল থেকেও রেহাই পেলেন। আপনি পরের মিটিংয়ের জন্য শক্তি সঞ্চয় করে রাখলেন। আমার এ ভাবনার কারণে অনেকেই পাগল বলতে পারেন। কিন্তু এটিই বাস্তব এবং এটিই উন্নত দেশ গড়ার ভাবনার অংশ।
বলছিলাম, ভারী শিল্পের কথা। উন্নয়নের মহাসড়কে গতি বাড়াতে হলে ভারী শিল্পে যেতেই হবে। ভারী শিল্পে গুরুত্ব দেয়ার কথা ছিল আরও আগেই। কারণ বাংলাদেশের শ্রমশক্তি এখন যেকোনো শিল্পের জন্য বড় অবদান রাখতে সক্ষম। সম্ভবত প্রয়োজনটা হলো শ্রম সংখ্যাটাকে দক্ষ শক্তিতে রূপান্তর। এ সম্পদ একদিকে যেমন দুষ্প্রাপ্য অন্যদিকে অমূল্য।
মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করছে। এ শ্রমিকরা নানা শিল্পেও কাজ করছে। বিদেশে গিয়ে কী পরিমাণ কষ্ট করছে, তা যে দেখেছেন সেই বলতে পারবেন। বাংলাদেশে যদি অর্ধেক মজুরিতে কাজ করতে পারেন তারা, তাহলে কেউ বিদেশে গিয়ে শ্রম দেবেন না। তাহলে কম দক্ষ শ্রমিকের পাঠানো রেমিট্যান্স আর লাগবে না। তখন উচ্চমানের দক্ষতাসম্পন্ন কেউ বিদেশে গিয়ে যে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারবে, তা এখনকার ২০০ শ্রমিকের পাঠান রেমিট্যান্সের সমান হবে।
কিন্তু এ ক্ষেত্রটা তৈরি করতে হবে। আমাকে ভিত্তি তৈরি করতে হবে এজন্য। এ ভিত্তি তৈরি হয় তিনটি সম্পদ থেকে। প্রথমত, মানুষ। কিন্তু এ মানুষকে আমরা এখনও সম্পদে রূপান্তরিত করতে পারিনি। মানুষের এ সংখ্যাটাকে সম্পদে রূপ দিতে গেলে তাকে ভালো শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। দেশ ভাবনার শিক্ষা দিতে হবে। এটি একটি প্যাকেজ।
দ্বিতীয়ত, ভৌত অবকাঠামো। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্টসহ যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিজ্ঞানের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। তৃতীয়ত, প্রাকৃতিক সম্পদ। একসময় বলা হতো বাংলাদেশে কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার উপযোগী নয়। বান-বন্যা আর দুর্যোগই বাংলাদেশের প্রকৃতি। এটি ভুল। বন্যাও প্রাকৃতিক সম্পদ হতে পারে। বন্যার পর যে পলি মাটি পড়ে, সেখানে আর কোনো রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হয় না। অথচ এ পলি আমরা অনুর্বর জমিতে কাজে লাগাতে পারি।
জাগো নিউজ : প্রশ্ন আছে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ এবং ব্যবহার নিয়েও…
আবুল বারকাত : প্রাকৃতিক গ্যাস-কয়লার যথার্থ ব্যবহার আমরা করতে পারিনি। বঙ্গোপসাগরে ৬৮২ নটিক্যাল মাইল বাংলাদেশ পেল। ৬০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বাংলাদেশের জেলেরা গিয়ে মাছ ধরতে পারে। এর পরে আর যেতেই পারে না। ২০০ মেট্রিক টন ক্ষমতাসম্পন্ন লাইটার জাহাজ আছে। অথচ লাগে ২০০০ মেট্রিক টন ক্ষমতাসম্পন্ন লাইটার জাহাজ। আমরা যেতে পারছি না বলে অন্যরা তো বসে থাকবে না। তারা এসে আমাদের মাছ নিয়ে যাবেই।
বঙ্গোপসাগরে কী ধরনের সম্পদ আছে, তা হয়তো রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা এখনও অবগত নন। কোনো তালিকাও দেখিনি যেখানে বঙ্গোপসাগরের পানি ও পানির নিচে কী সম্পদ আছে তার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের চারপাশের প্রধান সম্পদ হচ্ছে সুপেয় পানি। আগামীতে বিশ্বে লড়াই হবে খাবার পানি নিয়ে। খাবার পানি, পানির মধ্যে ও নিচের সম্পদ এবং পানির মধ্য দিয়ে ব্যবসা- এ তিন কারণে লড়াই হবে। সুতরাং বঙ্গোপসাগরের দিকে নজর দেয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। আমি তো মনে করি, বঙ্গোপসাগরে সব সম্পদের খনিই আছে।
ভৌগোলিক অবস্থানটাও বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ। হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, বাংলাদেশ বন্যা আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। বাংলাদেশ উন্নত হলে বিশ্বের সব দেশই উন্নত হতে পারবে। আমরা কিন্তু পেরেছি। বাঙালিদের মতো পরিশ্রমী শ্রমিক আর নেই। বাঙালিরা এখন নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু বানাতে পারে। বাঙালিরা কিন্তু নিজস্ব স্যাটেলাইট বানিয়ে মহাকাশ জয়ও করেছে। বাঙালিদের মধ্যে বড় বড় মাথা তৈরি হয়েছে, আরও হবে। আর সুযোগ মিললে তা দ্রুততার সঙ্গেই হবে।
আগামী ২০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর ২০টি উন্নত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ থাকবে। ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হবে এবং এর সমস্ত উপাদান এখন বিরাজ করছে। আমি সম্ভাবনার কথা বলছি।
এখন দরকার সঠিক অর্থনৈতিক-সামাজিক-প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনা। সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার। মানবসম্পদ তৈরি করা। ভৌত কাঠামো তৈরি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার। তবে সর্বোচ্চ বিবেচনায় রাখতে হবে যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কোনো ক্ষতি না হয়। কারণ তা হলে ওই উন্নয়ন টেকসই হবে না।
প্রয়োজন এ তিন সম্পদকে বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা করা। ডেলটা প্লানের কথা বলা হচ্ছে। এজন্য প্রস্তুতি দরকার। ভুল করেন। সমস্যা নেই। ঠিক হয়ে যাবে। যে কাজ করে তার ভুল হবেই। সে বিবেচক-বুদ্ধিমান যে ভুল থেকে শিক্ষা নেয় এবং ভুল পুনরাবৃত্তি করে না। শুরুটা করতে হবে। শুরুটা করেন নিজেরাই। বাইরের ধার করা কোনো কিছুর দরকার নাই। তবে জানার দরকার আছে। আমি ধার করা প্রজেক্টের পক্ষে নই। কারণ, আমাদের পরিবেশ, সংস্কৃতি, বাস্তবতা আরেক দেশের সঙ্গে মিলবে না। সুতরাং উগান্ডায় গিয়ে নিরাপদ পানির শিক্ষা নেয়ার কোনো দরকার নাই। আমাদের নিজস্ব সময় আছে, ইতিহাস আছে। আমাদের ভালোটা আমাদেরই করতে হবে। পদ্মা সেতু নিজেদের টাকায় করার জন্য কেউ বলেনি। শুরুটা আমরাই করেছি।
তৃতীয় বিশ্বের দেশ যারা দোটানায় রয়েছে, তারা এসে দেখে যাক। অন্য দেশের অভিজ্ঞতা সবসময় কাজে লাগে না। অনেক সময় ওই অভিজ্ঞতার হুবহু বাস্তবায়ন আসল কাজকে বাধাগ্রস্তও করে। এসব এখন প্রমাণিত সত্য।
সব আলোচনাই করছি উন্নয়নকে সামনে রেখে। অর্থাৎ উন্নয়ন করতে হলে আপনাকে এখন ভারী শিল্পের কথা ভাবতেই হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ গড়তে হবে শিল্পায়নের রূপকল্পের মধ্য দিয়ে।
জাগো নিউজ : ব্যবস্থাপনার কথা বলছেন। এজন্য প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন, স্বকীয়তার দরকার। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর সে সক্ষমতা আছে কি?
আবুল বারকাত : হ্যাঁ, আপনি এতদিন যে উন্নয়ন করে আসছেন, তা অনেকগুলো কাঠামোর মধ্য দিয়ে। যে কাঠামোয় অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানই প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি। আমি বলি, প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য প্রতিষ্ঠান করা। এটি করতে না পারলে আপনি সক্ষমতার ফাঁদে পড়ে গেলেন।
জাগো নিউজ : ‘সক্ষমতার ফাঁদ’ যদি ব্যাখ্যা করতেন?
আবুল বারকাত : আপনি বাইরে থেকে ভালো একটি প্রজেক্ট বা অভিজ্ঞতা নিয়ে আসলেন, দেশে প্রয়োগ করবেন বলে। অনেক ঢাক-ঢোল পেটালেন। জনগণও অংশগ্রহণ করলো। এটিকে বলে কৃত্রিম স্তুতি। এ কৃত্রিম স্তুতি যেসব জায়গায় গাওয়া হয়েছে, সেসব জায়গায় আসলে উন্নয়ন হয়নি।
আরও পরিষ্কার করে বলি। একটি শিশু হাঁটাই শেখেনি, তাকে যদি দৌঁড়াতে বলেন, তার কিন্তু বিপদ ঘটবে। সক্ষমতার ফাঁদ হচ্ছে এমনই। তার মানে, বাচ্চটাকে আগে হাঁটা শেখাতে হবে। এটিও বহুভাবে শেখানো যায়। প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলতে হয় এভাবে। শিশুকে হাঁটতে শেখান, জোরজবরদস্তি করবেন না যেন ভূমিষ্ঠ হবার পরপরই হাঁটতে থাকে, হাঁটা শিখাতে যত্ন নিন, এরপর সে দৌড়াবে, দৌড়ানোর সুযোগ করে দিন, সুযোগ করে দিন অন্য শিশুদের সঙ্গে দৌড়ানোর। এসবের ব্যত্যয় হলে সৃষ্টি হবে সক্ষমতার ফাঁদ যা থেকে বের হওয়া দুষ্কর।
গত দুই দশকে আমরা উন্নয়ন করেছি বটে, কিন্তু সক্ষমতার ফাঁদ থেকে বের হতে পারিনি। অথচ বের হওয়া দরকার ছিল। হা-হুতাশ করার কিছু নেই। রোগ যখন নির্ণয় হয়েছে তখন চিকিৎসাটা কঠিন হবে না।
জাগো নিউজ : এ প্রশ্নে আপনার পরামর্শ কী?
আবুল বারকাত : উদাহরণ দিয়ে বলি। আপনাকে শিক্ষার কথা বলা হলো। আপনি প্রথমে একটি ভবন বানালেন। শিক্ষার্থীরাও তৈরি আছেন। স্কুল দিলেই শিক্ষার্থীরা আসবেন। পাঠ্যপুস্তকও দিলেন। শিক্ষক লাগবে। এ চারটি হলেই শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়ে গেল। এটিকে আমি বলি উন্নয়নের সফট পার্ট (সহজ অংশ)। কঠিন পার্টটি হচ্ছে পরের। আর তা হলো জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর জন্য শিক্ষকদের যে মান সেখানে ঘাটতি আছে। তার অর্থ হলো, শিক্ষার্থীদের জ্ঞান জাগতিক যে জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষক দিয়েছেন তার সক্ষমতায় ঘাটতি। এ ঘাটতি পূরণ না করতে পারলে আটকে যাবেন আসল জায়গায় অর্থাৎ হার্ড পার্ট অর্জনে।
পঞ্চম শ্রেণি পাসের একজন শিক্ষার্থীর যে জ্ঞান থাকার কথা তা নেই। বৈশ্বিক গড় মাপকাঠিতে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশের পঞ্চম শ্রেণি পাস করা শতকরা ৯৫ ভাগ শিক্ষার্থী আসলে দ্বিতীয় শ্রেণি পাসের সমতুল্য মানের জ্ঞান অর্জন করছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ না ঘটাতে পারলে নিরক্ষরতা দূর হবে অথবা সাক্ষরতার হার ১০০ শতাংশে পৌঁছে যাবে কিন্তু শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হাসিল হবে না। বিষয়টি জরুরি ভাবনার বিষয়।
জাগো নিউজ : মান বৃদ্ধির উপায় নিয়ে কী বলবেন?
আবুল বারকাত : আমি বারবার বলেছি, প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন এক টাকা হলেও বিসিএস ক্যাডার থেকে বেশি হওয়া উচিত। বঙ্গবন্ধু কিন্তু বলেছিলেন, শিক্ষার বরাদ্দকে ব্যয় হিসাবে না দেখে বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে।
বিসিএস ক্যাডারের চেয়ে বেতন বেশি হলে সমস্ত মেধাবীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরির জন্য দরখাস্ত করবেন। করবেনই। আর এক টাকা বেশি বলার একটি অর্থও আছে। অন্তত সামাজিক সম্মানের প্রশ্নে।
প্রাথমিকের শিশুরাই কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাদের যদি আমরা সঠিকভাবে লালন, সংরক্ষণ করতে না পারি, তাহলে সবই যাবে। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন নিয়ে আমি জোর দিয়ে বলছি। সবসময়ই বলি। নীতিনির্ধারকরা বুঝতে চান না। বুঝলে সমস্যা।
ধরুন, একটি জেলায় শিক্ষা সপ্তাহ উদযাপন অনুষ্ঠান চলছে। জেলা প্রশাসক প্রধান অতিথি হিসেবে অথবা উদ্বোধক হিসেবে পায়রা উড়াচ্ছেন। শিক্ষা সপ্তাহ উদযাপনে ওই জেলার সবচেয়ে প্রবীণতম শিক্ষককে দিয়ে পায়রা উড়ানোর সমস্যা কোথায়? সব কিছুই আমলাতান্ত্রিকতার মধ্যে প্রবেশ করালে সমাজে ভারসাম্য আসে না। সবকিছু যেভাবে চলছে সেভাবে চলতে থাকলে শিক্ষার মান আমলারা বাড়াতে পারবেন না। অর্জিত হবে না শিক্ষার ‘হার্ড পার্ট’ অর্জন। আবারও সক্ষমতার ফাঁদ চলতেই থাকবে।
শিক্ষার মান বাড়াতে হলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জাগো নিউজ : উন্নয়ন তো প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই হচ্ছে…
আবুল বারকাত : যে উন্নয়ন আমরা দেখতে পাই, তা অনানুষ্ঠানিক উন্নয়ন। আমাদের রাষ্ট্রের তিনটি অর্গান (বিভাগ) আছে। আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ। যত প্রতিষ্ঠান আছে, তার প্রতিটিই এ তিনটির কোনো না কোনোটির অধীন। কিন্তু আমরা এ প্রতিষ্ঠানগুলোর ঠিক কার্যকারিতা দেখতে পাই না। প্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু উন্নয়ন হচ্ছে কোনো ব্যক্তির সিদ্ধান্তে, যা অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায়। প্রতিষ্ঠানগুলো ভঙুর। যে কেউ এর ভিন্ন ব্যবহার করতে পারে, যা করার কথা নয়।
প্রবৃদ্ধি বাড়ানোই উন্নয়ন নয়। এর সঙ্গে বাজার প্রসার ও বৈষম্য দূরীকরণের বিষয়টিও মেলাতে হবে। এটা করতে পারলে অনানুষ্ঠানিক উন্নয়নের সঙ্গে তুলনামূলক ভঙুর প্রতিষ্ঠানকেও গ্রথিত করতে পারবেন।
প্রথমে শিল্পায়নের মাধ্যমে উন্নয়নের কথা বললাম। দ্বিতীয় বিষয়টি বলছি, প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ। এর মধ্য দিয়েই আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগও প্রতিষ্ঠানে রূপ নেবে। এটা হলে বাজারের প্রসার বাড়বে, বৈষম্যও কমে আসবে। প্রবৃদ্ধি তো বাড়বেই। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যকার জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বাড়লে আপনি শিল্পায়নের রূপকল্পের মধ্য দিয়ে উন্নয়ন করতে পারবেন। এর মধ্য দিয়ে আপনার অন্যান্য আনুষঙ্গিক অভিপ্রায়ও পূরণের সুযোগ আসবে।
এএসএস/এমএআর/এমএস