বঙ্গবন্ধু এক ধরনের সমাজতন্ত্র চেয়েছিলেন
অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। ১৯৫৪ সালে কুষ্টিয়া শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি এবং জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি রাশিয়ার মস্কো ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ইকোনমি থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেন। একই প্রতিষ্ঠান থেকে উন্নয়নের রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। তার ৬০০টির বেশি গবেষণাকর্ম এবং ২৪টি গবেষণাগ্রন্থ রয়েছে।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে জাগো নিউজের মুখোমুখি হন বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং উন্নয়ন প্রসঙ্গ নিয়ে। দীর্ঘ আলোচনায় উন্নয়ন এবং বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র দর্শন নিয়ে আলোকপাত করেন। মতামত প্রকাশ করেন বর্তমান রাজনীতি, অর্থনীতি প্রসঙ্গেও। পাঁচ পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথম পর্ব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু ।
জাগো নিউজ : স্বাধীনতার অর্ধশত বছরে বাংলাদেশ। দেশের উন্নয়ন নিয়ে নানা গল্প আছে। আপনি এ উন্নয়ন কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
আবুল বারকাত: বাংলাদেশ মৌলিক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া একটি দেশ। এই ভূখণ্ড তার হাজার বছরের ইতিহাসে কখনই স্বাধীন ছিল না। যারা এই অঞ্চলকে শাসন করেছেন, তারা কোনো না কোনোভাবে শোষণ করেছেন, নিজেদের উন্নতির স্বার্থে। ব্রিটিশ শাসনের আগে কিংবা দিল্লির শাসনের সময়েও গ্রামীণ সাধারণ মানুষের কিছু যায়-আসেনি।
যদি মোগল আমলের কথা বলি, তাহলে দেখবো, গ্রামগুলো একেবারেই স্বনির্ভর ছিল। সব পেশার মানুষই গ্রামে বাস করতেন। এ কারণেই বলা হতো স্বনির্ভর গ্রাম গোষ্ঠী। ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক ইতিহাস বুঝতে হলে স্বনির্ভর গ্রাম গোষ্ঠী দিয়ে বুঝতে হবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করে ব্রিটিশরা এই বাংলাকে শোষণও করেছে, ভয়ও পেয়েছে। এর প্রমাণ হচ্ছে, বঙ্গভঙ্গ। ওই সময় ভারতবর্ষের কোথাও ভাগ হয়নি। বাংলা ভাগ হয়েছে। যদিও ফের একত্রিত হয়। বলা হতো, ‘বাংলা আজ যা ভাবে, ভারত আগামীকাল তা ভাববে।’
পুরো ব্রিটিশ আমল ধরে যদি বিশ্লেষণ করেন, দেখবেন, এই বাংলার মানুষ সব সময় বিপ্লবী ছিল। ব্রিটিশবিরোধী বড় বড় আন্দোলনের উৎপত্তি বাংলা অঞ্চলে। এসব আন্দোলন দেখলে বোঝা যায়, অধিকার আদায়ের আন্দোলন আসলে সোজা না। যা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের স্বাধীনতার ভাষণে।
ব্রিটিশদের ওপর বোমা মারার ধৃষ্টতা বাঙালিরাই দেখিয়েছিলেন। ভগত সিংয়ের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে গোটা ভারতে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, যে বোমা বানাবেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বাঙালি প্রভাষক ছিলেন, যিনি বোমা বানাতে পারতেন। প্রথমে রাজি না হলেও পরে তিনি বোমা বানানো প্রক্রিয়ায় ঢুকে পড়েন। এরপর ক্ষুদিরামদের ইতিহাস, বাঘা যতীনদের ইতিহাস চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ইতিহাস, তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস সবারই জানা। আমাদের উন্নয়ন ইতিহাসের পেছনের এ বিবর্তন বাদ দিয়ে প্রকৃত উন্নয়ন ও সম্ভাবনা বোঝা যাবে না।
জাগো নিউজ : আপনি বাঙালির অধিকার আন্দোলনের ইতিহাস বলছেন। কিন্তু অধিকার তো বরাবরই হাতছাড়া হয়েছে?
আবুল বারকাত : হ্যাঁ। বাঙালি অধিকারহারা হয়েছে বারবার, এটিও সত্য। কিন্তু শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করার ইতিহাস বাঙালি খুব সচেতনভাবেই জন্ম দিয়েছে। যে কারণে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বেশিদিন লাগেনি। দেশ ভাগের কিছুদিন পরেই বাঙালি বুঝতে পারছিল, ‘এই পাকিস্তান আমাদের না।’
আমি সচেতনভাবে বলছি, প্রতিটি আন্দোলনে স্বকীয় উন্নয়নের বার্তা ছিল। নিজের মাটি থেকে উন্নয়ন দরকার এই দর্শনে বাঙালির আকর্ষণ বহু আগে থেকেই ছিল। সম্ভবত ধার করা কোনো উন্নয়ন দর্শনে কখনোই আমাদের আকর্ষণ ছিল না, কারণ তা দিয়ে কাজ হয়নি। এ কারণেই আপনি বাংলাদেশের আবির্ভাবকে পৃথিবীর অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করতে পারবেন না। বাঙালির লড়াই-সংগ্রামের মধ্যে সম্ভবত দুটি আকাঙ্ক্ষার বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে, যা মুক্তিযুদ্ধে দারুণভাবে প্রতিফলিত হয়। প্রথমত, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং দ্বিতীয়ত, অসম্প্রদায়িক মানস কাঠামো।
জাগো নিউজ : আপনি বাংলাদেশের শুরুর কথা বলছেন। অনেকেই বলছেন, হোঁচটটা ঠিক স্বাধীনতার পরেই খেতে হয়েছে।
আবুল বারকাত : স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশে বললেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, ভাই হিসেবে বলছি, ‘মুক্তিযুদ্ধ করে দেশটা স্বাধীন করেছেন, এবার আপনাদের সঙ্গে নিয়ে দেশটা গড়ে তুলতে চাই।’ এর পরের কথায় তিনি বলেছেন, ‘আমি একটি আদর্শ রাষ্ট্র তৈরি করতে চাই’। এরপর তিনি বলেছেন, ‘যে রাষ্ট্রের ভিত্তি কোনো ধর্ম হবে না।’ সবশেষে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে তিনটি। ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদ’। ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে তিনি এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। ডিসেম্বর মাসে সংবিধান প্রণয়ন হয়।
রাষ্ট্র এবং সমাজ কাঠামো বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর আকাঙক্ষা ছিল পরিষ্কার। উন্নয়ন নিয়ে এতক্ষণ যা বললাম, তা আপনার কাছে রাজনৈতিক বক্তব্য ঠেকতেই পারে। কারণ, আমাদের কাছে উন্নয়ন আলোচনা মানেই জিডিপি আর জিডিপি।
বাংলাদেশের উন্নয়ন আলোচনা করতে হলে আপনাকে এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস মানতেই হবে। কারণ বড় মূল্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতি বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিকেও হার মানায়, যদি আপনি যুদ্ধের সময়সীমা বিবেচনা করেন।
এখন অনেকেই বলেন, সমতার বিষয়ে মানুষ তখন এত সচেতন ছিল না এবং গণতন্ত্র হলেই চলত। আর পুঁজি নির্ভর অর্থনীতির মধ্যে যেহেতু প্রবশ করেই ফেলেছি, সুতরাং এর মধ্য থেকেই যতটুকু বৈষম্য কমানো যায়। সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের প্রস্তুতি ঠিক ছিল না শুরুতে। অনেক একাডেমিশিয়ান এমনটিই বলেন। এ ধারণার সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবে একমত নই। কারণ আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাটা তো তখন বিরাজ করছিল।
জাগো নিউজ : এতদিনেও সমাজ কাঠামো বা মানস কাঠামো তো আসলে দাঁড় করানো গেল না। যারা বলছেন, তাদেরও তো ব্যাখ্যা আছে।
আবুল বারকাত : না। যারা এমন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, তারা ঠিক বলছেন না। আমি ১৬ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছি। তখন সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে ৯৬ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করত। আমি কুষ্টিয়া শহরে বেড়ে উঠেছি। ১৬-১৭ বছর বয়সে আমরা ভাবতে থাকলাম, কোনো একদিন ডাক পড়বে যে তোমরা গ্রামে যাও। ফুল প্যান্টগুলো হাফপ্যান্ট করতে হবে। আহ্বানের অপেক্ষায় ছিলাম, স্বাধীনতার পর কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দুই বছর বন্ধ থাকবে। স্কুলগুলো খোলা থাকবে। রাষ্ট্র বলবেন, এই দুই বছর গ্রামে গিয়ে চাষ করা শিখবা। কৃষকের কষ্ট বুঝবা। আর গ্রাম বাংলায় নিরক্ষরতা দূর করবা। তার মানে সমতা নিয়ে ভাবনা, বড় ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে ভাবনা অবশ্যই তখন ছিল।
জাগো নিউজ : তাহলে এই ভাবনা গুলিয়ে গেল কেন?
আবুল বারকাত : গুলিয়ে গেল, না-কী গুলিয়ে ফেলা হলো, তা ভাবতে হবে। আমার মনে হয়, ঠিক প্রশ্ন করতে পারাটা অনেক সময় উত্তর দেয়ার চেয়ে কঠিন হয়ে পড়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, তখনকার প্রক্রিয়াটা আসলে কী ছিল?
আমার ধারণা মতে বঙ্গবন্ধু এক ধরনের সমাজতন্ত্র চেয়েছিলেন। তা না হলে কেন তিনি ‘শোষিতের গণতন্ত্রের’ কথা বললেন?
জাগো নিউজ : সেটা কোন ধরনের সমাজতন্ত্র?
আবুল বারকাত : আমরা আসলে পুঁজিবাদী সমাজে ছিলাম না। আমরা সামন্তবাদী সমাজে ছিলাম, যেখানে পুঁজির প্রভাবটাও ছিল তবে তা ক্ষীণ। বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্রের তত্ত্বটি ছিল এমন যে, পুঁজিবাদকে বাইপাস করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আদি তত্ত্ব হচ্ছে এই রকম যে, আপনাকে সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদে যেতে হবে। আর পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে যেতে হবে। আমাদের এখানে সেই অর্থে তখন পুঁজিবাদ ছিল না। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু পুঁজিবাদকে বাইপাস করতে চেয়েছিলেন। তখনকার বাংলাদেশ ছিল প্রধানতঃ গ্রামীণ অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজ নির্ভর। বঙ্গবন্ধু তো ৬৫ হাজার গ্রামে বাধ্যতামূলক বহুমুখী সমবায় প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন- কেন? নিঃসন্দেহে শোষণমুক্ত গ্রামীণ অর্থনীতি-সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকেই।
আমার ধারণা এই তত্ত্ব বাস্তবায়নের জন্যই রাজনৈতিক কাঠামো হিসেবে বাকশাল গঠন করা হয়েছিল। এ তত্ত্বের উদ্ভব কিভাবে হলো এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত তথ্য দিতে পারছি না। কিন্তু বোঝার চেষ্টা থেকে বলছি। কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন সবচেয়ে ভালো ভূমিকা পালন করেছিল এবং পাশের দেশ ভারতকে সঙ্গে নিয়ে। তখন হয়ত শাসকদের পক্ষ থেকে মনে করা হয়েছিল, বাঙালি কোনো দিন গণতন্ত্রের স্বাদ পায়নি। একটু গণতন্ত্রের স্বাদ পাক। এরপর সমাজতন্ত্রের দিকে যাওয়া যাবে। এটি আমার ধারণা। প্রশ্ন হচ্ছে, কোন ধরনের গণতন্ত্র? পশ্চিমা গণতন্ত্রের ধারণা দিয়ে যে বাঙালিকে সমাজতন্ত্রে নিয়ে যাওয়া যাবে না, আমরা নিজেই তার বড় উদাহরণ।
জাগো নিউজ : কিন্তু এই গণতন্ত্রের স্বাদ দিতে কী ঘটলো?
আবুল বারকাত : যা ঘটার কথা তাই ঘটেছে। আমাদেরকে ১৫ আগস্ট দেখতে হলো। যুদ্ধবিধস্ত দেশ পুনর্গঠন করতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বল্প সময়ে তা করেও ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা একদিকে। অন্যদিকে চীনের বিরোধিতা। সিআইএ-এর দলিলে ‘বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বের বোকাদের বোকা’ বলে ট্রিট করা হয়েছে সেই সময়ে। বলা হয়েছিল তিনি (বঙ্গবন্ধু) টেরও পাবেন না যে, ‘কত দ্রুত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন।’
ওই সময় বিশ্বব্যাংকসহ দাতাসংস্থাগুলো ঋণ দিতে চেয়েছিল। বিনিময়ে শর্ত দিয়েছিল। শর্ত ছিল পাকিস্তান আমলে তারা যত ঋণ দিয়েছিল, তার দায়ভার বাংলাদেশকে নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পছন্দ না হলে সাদা সাহেবদের চলে যেত বলো।’ ১৯৭৩ সালের কথা।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন যোশেফ ফার্লেন্ড। সম্ভবত, ১৯৭১ সালের ২২ মার্চ তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে চা পানের দাওয়াত নিলেন। বঙ্গবন্ধু রাজি হলেন। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে। বঙ্গবন্ধু দোতলা থেকে নেমে এসে তাকে নিয়ে গেলেন। আলাপের এক পর্যায়ে যোশেফ ফার্লেন্ড বঙ্গবন্ধুকে বললেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তোমার দেশ স্বাধীন করে দেবে।’ বঙ্গবন্ধু পাইপ টানছেন। এরপর ফার্লেন্ড বললেন, ‘এই স্বাধীনতা তারা বিনা রক্তপাতে এনে দেবে’। বঙ্গবন্ধু তখন ওঠে দাঁড়িয়ে জানালা খুলে পাইপের ধোঁয়া বাইরে ফুঁকে দেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘ মি. ফার্লেন্ড তোমার এই প্রস্তাবে নিশ্চয়ই একটি ‘তবে’ আছে। এই টুকুই তোমার শেষ কথা নয়।’ফার্লেন্ড তখন বললেন, ‘হ্যাঁ একটি ‘তবে’ আছে। বাংলাদেশের দক্ষিণের সেন্ট মার্টিন দ্বীপটিকে দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইজারা দিতে হবে।’
বঙ্গবন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘মি. ফার্লেন্ড, আমি শেয়ালের হাত থেকে দেশটাকে বাঘের মুখে তুলে দিতে পারি না।’ এরপর বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আপনি সিআইএ-এর এজেন্ডা বাস্তবায়ন চাইছেন। আপনি তো এর আগে আর্জেন্টিনায় রাষ্ট্রদূত ছিলেন এবং আপনি থাকা অবস্থাতেই সেখানে সামরিক ক্যু হয়েছে। আপনি ইন্দোনেশিয়ায় থাকা অবস্থাতেও সামরিক ক্যু হয়েছে। ধন্যবাদ আপনাকে।’
বঙ্গবন্ধু জেনেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র বুঝে গেছে যে, বাঙালি পিছু হটবে না। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাব নিয়ে আসবে এবং সেই প্রস্তাব গ্রহণ করলে বাঙালির জন্য মহাবিপদ দেখা দেবে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরেই বললেন, ‘ষড়যন্ত্র চলছে।’ শেখ হাসিনাও গতকাল বললেন, ‘ষড়যন্ত্র চলছে’। যখনই আমরা একটু ঘুরে দাঁড়াতে শিখি কেন যেন তখনই কোনো না কোনো ‘ষড়যন্ত্র’ দানা বাঁধে, নস্যাৎ করে দেই আমাদের গণ-আকাঙ্ক্ষা।
জাগো নিউজ : এখনকার ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ নিয়ে কী বলবেন?
আবুল বারকাত : আপনাকে সময় এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ব মিলিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে। বাঙালি এবং বাংলাদেশ এখন কোন পথে? আমাদের উন্নয়ন আলোচনায় বঙ্গবন্ধু হত্যা নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিভিন্ন সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে দেখি, ব্যানারে লেখা থাকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীর কুশীলবদের বিচার চাই। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর পরই এই কুশলিবরা বোঝাতে থাকেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যদি খন্দকার মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি না দেয়, তাহলে ভারতের সেনাবাহিনী নেমে যাবে বাংলাদেশে।’
মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ‘আমার কূটনৈতিক জীবনে এত আনন্দ পাইনি, যা পেয়েছি মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে।’
আন্তর্জাতিক এই কুশীলব কারা তা বাংলাদেশ সরকার প্রধানেরও জানা আছে। কিন্তু বলতে পারছেন না। বাংলাদেশের মতো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বলতে পারে না। হয়তো ২০ বছর পরে বলার পরিবেশ হতেও পারে।
জাগো নিউজ : আলোচনা করছিলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে।
আবুল বারকাত : সংবিধানের চেয়ে পবিত্র নীতি নির্ধারণী ডকুমেন্ট আর হয় না। বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে বলেছিলেন, সংবিধান মেনে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা হবে, সেটাই সমাজতন্ত্র। সংবিধানের ৭ (ক) অনুচ্ছেদে জনগণকেই প্রজাতন্ত্রের মালিক বলা হয়েছে। জনগণের অভিপ্রায়ের বিপক্ষে যে আইন, তা অকার্যকর বলে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ আমাদের সংবিধান অনুযায়ী শুধুমাত্র ‘জনগণ’ই সার্বভৌম, অন্য কেউ নয়, অন্য কোনো কিছুই নয়।
সংবিধানে উৎপাদনের মালিকানার ধরনের কথা বলা হয়েছে। প্রথমত, রাষ্ট্রীয় মালিকানা। দ্বিতীয়ত, সমবায় মালিকানা। তৃতীয়ত, ব্যক্তি মালিকানা। এখন সব উল্টে গেছে। অথচ উৎপাদনের উপায়ের উপর মালিকানার প্রশ্নে সংবিধান আগের জায়গাতেই আছে। ১৬নং অনুচ্ছেদে গ্রাম এবং শহরের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। কৃষি বিপ্লবের পাশাপাশি প্রথম পঞ্চবার্ষিকীর পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়। সংবিধান এবং সেই পরিকল্পনা যদি এক সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যেত, তাহলে একটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আদর্শ রাষ্ট্র বহু আগেই প্রতিষ্ঠা হয়ে যেত।
বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্রের কিছুটা স্বাদ এবং রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রের দিকে যাচ্ছিলেন। যদিও অনেকে বলেন, শুরুতেই বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্রের দিকে যাওয়া উচিত ছিল।
১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু তার জীবনের শেষ জনসভায় কর্মসূচি ঘোষণা করেন, যাকে দ্বিতীয় বিপ্লব বলা হয়। তিনি এবারে শক্তভাবে বললেন, ৬৫ হাজার গ্রামে বহুমুখী সমবায় গঠন করতে হবে। তখন জমির মালিকরা নড়চড়ে বসলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি জমি কেড়ে নিচ্ছি না।’ বললেন, ‘ফসলের এক-তৃতীয়াংশ জমির মালিক পাবেন। আরেক ভাগ শ্রমিকরা পাবেন। বাকি এক ভাগ সমবায়ে জমা হবে।’
বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় কর্তাদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘গ্রামের কৃষকদের ইজ্জত কইরা কথা কইবেন।’ এই নেতৃত্ব আর দেখিনি।
জাগো নিউজ : পুঁজিবাদকে আড়াল করে সমাজতন্ত্রে যাওয়া, অর্থাৎ গণতন্ত্রের স্বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুর ভুল ছিল কি-না?
আবুল বারকাত : একটি যুদ্ধবিধস্ত দেশ। চাইলেই একতরফা সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না, এমন পরিস্থিতিতে। এরপরেও তো তিনি প্রগতির পথেই ছিলেন। আমরা এই সময়ে কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন দেখেছি। এটি তো অভাবনীয় অগ্রগতি ছিল। এমন অনেক সিদ্ধান্তই নেয়া হয়েছিল তখন।
জাগো নিউজ : সমাজতন্ত্রে গিয়েও তো এমন সিদ্ধান্ত নেয়া যেত, যে সমাজতন্ত্র নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায় ছিল বলে বলছেন।
আবুল বারকাত : এটি কঠিন প্রশ্ন। আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধু তিন চার বছরের এই সময় প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। প্রস্তুত করছিলেন দেশের মানুষকেও। তিনি তো জাতীয়করণ শুরু করেছিলেন। সম্পদের ওপর ব্যক্তির অসীম মালিকানা নিয়ন্ত্রণের জন্যই রাষ্ট্র এবং সমবায় মালিকানার ওপর জোর দিচ্ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চের ওই সমাবেশে তিনি যুবকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তোমাদের ফুলপ্যান্ট কেটে হাফপ্যান্ট বানিয়ে গ্রামে যেতে হবে।’ যা আমরাও মুক্তিযুদ্ধের পরপরই ভেবেছি। তার মানে বঙ্গবন্ধুর পথটা ঠিক ছিল। বঙ্গবন্ধু আরও ৫ কী ১০ বছর ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশ কোথায় যেত, তা নিয়ে তো গবেষণা আছে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়ার অর্থনীতি সমান সমান ছিল। প্রথমত, ওই সময় জিডিপি প্রায় সমান ছিল। দ্বিতীয়ত, দুই দেশেই জাতীয়তাবাদ আন্দোলন ছিল। মাহাথির মোহাম্মদ প্রথম থেকেই একটি পথ বেছে নিয়েছেন, যেটি সমাজতন্ত্র না। আর বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রের পথে ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুসহ বাংলাদেশ ধরে যদি মূল্যায়ন করি তাহলে ২০১১ সাল নাগাদ আমাদের জিডিপি হতো ৪২ হাজার ১৫৮ মার্কিন ডলার। ২০১১ সালে মালয়েশিয়ার জিডিপি ছিল ১৫ হাজার ৪২৬ ডলার। তার মানে বঙ্গবন্ধু যে নীতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তাতে করে এত দিনে বাংলাদেশের জিডিপি মালয়েশিয়ার চেয়ে কমপক্ষে তিন গুণ বেশি হওয়ার কথা। এবং একই সাথে সমাজে শ্রেণিকাঠামোতে এমন ধরনের পরিবর্তন হতে পারত যেখানে দরিদ্র মানুষ তেমন থাকত না, ধনীদের সংখ্যাও হতো কম, আর মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা হতো সবচেয়ে বেশি। যেটা নিঃসন্দেহে হতো সমাজতন্ত্রমুখী।
সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার হিসাব-নিকাশের কারণেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামনে আসল। আমরা হেরে গেলাম। এরপরের রাজনীতি আর বঙ্গবন্ধুর নীতিতে চলেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একেবারে থমকে গেল। একজন সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে শাহ আজিজুর রহমান, আলিমের মতো রাজাকারদের মন্ত্রী বানালেন। রাজনীতি, অর্থনীতি দুর্বৃত্তায়িত এবং ধর্মায়িত হয়ে গেল। এই প্রক্রিয়া ছিল ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। এই সময়ে জিডিপি তুলনামূলক থমকে যায় এবং সমাজে শ্রেণি ও ধন বৈষম্য বেড়ে যায়। অথচ ১৯৭৪-১৯৭৫ সালে জিডিপির প্রবৃদ্ধি তো ভালোই ছিল। ওই সময় জিডিপির সূচকগুলো বাড়ার দিকে ছিল, তা নানা তথ্যেই প্রমাণিত।
এএসএস/এএইচ/এমএস