যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ে তালেবানরাই লাভবান হবে
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়, অটোয়া ও অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। জাপানের ইয়োকোহামা সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাজ করেছেন। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং টেররিজম ইন সাউথ এশিয়া : বিয়ন্ড স্টাটিস্ট ডিসকোর্সেস’ নামক গ্রন্থের রচিয়তা তিনি।
তালেবানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তির প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে কাশ্মীর, আসামের এনআরসি ও রোহিঙ্গা প্রসঙ্গও গুরুত্ব পায়। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : তালেবানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার চুক্তি দ্বারপ্রান্তে এসে আটকে গেল। এ চুক্তির বিষয়টি এখন কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ : আমার কাছে চুক্তির সময় নিয়ে প্রশ্ন ছিল। সেপ্টেম্বর মাসে চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। অথচ ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে ভয়াবহ হামলা এবং ওই হামলার জের ধরেই আফগানিস্তানে যুদ্ধ বাধাল। এমন সময়ে চুক্তির প্রাসঙ্গিকতা দুর্বল ঠেকেছে আমার কাছে। জানি না কাদের বুদ্ধিতে দিনক্ষণ ঠিক করা হয়েছিল?
তবে আমার মনে হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প ফের ব্যাক করবেন চুক্তির বিষয়ে। আমরা যতটুকু জানি, যুক্তরাষ্ট্র আফগান যুদ্ধের সমাপ্তি চাইছে। এ কারণেই তালেবান, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, পাকিস্তানের অংশগ্রহণে চুক্তির পরিধিটা বড় করে দেখানো হয়েছে।
জাগো নিউজ : চুক্তি সম্পন্ন না হওয়ায় কাদের জন্য অস্বস্তি বাড়ল?
ইমতিয়াজ আহমেদ : আসলে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে স্ট্যাডি করা মুশকিল। তিনি সকালের অবস্থান বিকেলে ধরে রাখতে পারছেন না। এটি হয়তো তার অভ্যাসগত ক্রিয়া, নয়তো তিনি এমন আচরণ প্রকাশ করতে মজা পান। এমন আচরণ তার অনুসারীরাও উপভোগ করেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোল্টনকে সরিয়ে দিলেন। এর আগে আরও দুই উপদেষ্টাকে সরিয়েছেন এবং তা খুব দ্রুততম সময়ে। ট্রাম্প ফের উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন।
এসবের মধ্য দিয়ে মনে হয়, চুক্তি আটকে গেছে বলেই অস্বস্তি বাড়িয়েছে, তা কিন্তু নয়। হয়তো সেপ্টেম্বর বলে তিনি এমন একটি নাটক করেছেন। কিন্তু চুক্তির বিষয়টি এমন জায়গায় গিয়ে গুরুত্ব পেয়েছে, তাতে করে মনে হচ্ছে, তিনি আবারও ফিরে আসবেন।
জাগো নিউজ : আপনি ‘৯/১১’-কে গুরুত্ব দিচ্ছেন। সম্প্রতি তালেবান হামলায় মার্কিন সেনা নিহত হওয়ার ঘটনায় চুক্তি সম্পন্নে জটিলতা দেখা দেয় বলে অনেকে মনে করছেন। আবার আফগান থেকে একেবারে সৈন্য প্রত্যাহারের তালেবানদের দাবিও মানতে নারাজ যুক্তরাষ্ট্র। আসলে কোনটি গুরুত্ব পেল?
ইমতিয়াজ আহমেদ : এগুলো আসলে ‘কারণ’ হিসেবে দেখলে সুবিধা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাবাহিনী আসলে নিরাপদ কি-না? তালেবান যে কোনো সময় আবারও মারমুখী হতে পারে এবং এটি সবাই জানে।
যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধটা আসলে যে জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল, তাতে তারা লাভবান হয়নি। লোকসানের জায়গা থেকেই তারা আফগান ইস্যুর রূপরেখার পরিবর্তন চাইছে। চুক্তির আগে নানা টানাপোড়েন সৃষ্টি করে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে চাইছে, যাতে হারটা সহজ মনে না হয়। এ কারণেই নানা হিসাব কষে কাজ করতে হচ্ছে।
হঠাৎ করে ‘না’ বলা যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্বভাব, আবার ‘হ্যাঁ’ও বলতে পারেন তিনি। এ কারণেই সেপ্টেম্বর মাসটি তারা কোনো না কোনো কায়দায় এড়িয়ে গেল। যে মাসে যুক্তরাষ্ট্রে হামলা হলো, সে মাসেই তালেবানদের সঙ্গে চুক্তি, এটি ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য সুখ দিচ্ছিল না।
জাগো নিউজ : তার মানে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বিদায় নিতেই হচ্ছে, এটা বলতে চাইছেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ : ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেজাজটা আপনাকে বুঝতে হবে। তিনি হয়তো বোঝাতে চাইছেন, ‘বিশ্বকে নিরাপদ রাখার ভার আমি একা কেন নেব?’ তার তো অর্থনীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হচ্ছে।
জাগো নিউজ : যুদ্ধটা তো একাই বাধিয়েছেন। অন্যরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গী মাত্র। দায় তো তাকেই নিতে হবে…
ইমতিয়াজ আহমেদ : ২০০১ সাল আর ২০১৯ সালের মধ্যে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। গ্লোবাল পুলিশম্যানের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের। এর মধ্যে অনেক দেশ অর্থনীতিতে এগিয়ে গেছে। চীনের সঙ্গে আপনি কাউকে আর তুলনা করতে পারছেন না।
বিশ্বকে নিরাপদ করার কথা বলে আফগানিস্তানে এখন শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য মারা যাচ্ছে। সঙ্গত কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ক্ষতি আর করতে চাইছেন না।
এটি শুধু আফগানিস্তানের ক্ষেত্রেই নয়, অন্য জায়গা থেকেও ব্যাক করার নীতি অবলম্বন করার পরিকল্পনা নিচ্ছেন হয়তো। বিশ্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থেকে এখন তার জাতীয় অর্থনীতির ওপরও গুরুত্ব দিতে হচ্ছে।
জাগো নিউজ : কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি তো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গেও জড়িত…
ইমতিয়াজ আহমেদ : অবশ্যই। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বিশ্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাদের অর্থনীতিকে বলা হয় ‘মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রি কমপ্লেক্স’। এমন অর্থনীতি যুদ্ধের কাঠামোর মধ্যেই আটকে থাকে। আপাতত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ওই মিলিটারি কমপ্লেক্স দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। আফগানিস্তান থেকে সরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ফের কোথায় যাবে, তা বলা মুশকিল।
কিন্তু যুদ্ধ না করলে তার অর্থনীতির জন্য বড় সমস্যা তৈরি হবে। আবার একা যুদ্ধ করেও ক্ষতিটা তাকে একাই মানতে হচ্ছে।
জাগো নিউজ : দু’দশকের আফগান যুদ্ধ থেকে আসলে কী বার্তা পাওয়া গেল?
ইমতিয়াজ আহমেদ : এ বিশ্লেষণের জন্য আরেকটু সময় লাগবে। আফগান টার্গেট ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সহজ টার্গেট। কিন্তু তালেবানদের প্রতিরোধের কাছে সেই সহজ বিজয়টি হলো না। জনগণের সঙ্গে তালেবানদের সম্পর্ক এবং ভৌগোলিক অবস্থান বিজয়ের পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রকে অধিক লোকসান গুনতে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র হয়তো এখন মনে করছে, পৃথিবীর শান্তি বজায় রাখতে আরও শক্তির প্রকাশ ঘটছে। সে সব শক্তির অর্থনীতি ও স্বার্থের জন্যই শান্তি জরুরি। এক্ষেত্রে চীন একটি বড় শক্তি। আফগান শান্তিতে তাদেরও স্বার্থ আছে। সবাইকে সঙ্গে নিয়েই হয়তো আফগান পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র।
জাগো নিউজ : আফগান সরকার কীভাবে দেখছে এ পরিস্থিতি?
ইমতিয়াজ আহমেদ : আফগানিস্তানের বর্তমান সরকার ভালো করে জানে, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া কাবুল ধরে রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তারা তালেবানের শক্তি কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারবে না। দেশটির বড় একটি অংশই তালেবানরা দখলে রেখেছে। এ বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে পেরেই কাতার সমঝোতা সামনে আনল। যেখানে তালেবানদের সঙ্গে সরাসরি মিটিং করে ট্রাম্প বিশেষ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিলেন।
জাগো নিউজ : তার মানে আফগান পরিস্থিতি বদলাবেই…
ইমতিয়াজ আহমেদ : হ্যাঁ। আমার মনে হয় না, আরও অস্ত্র-অর্থ নিয়ে এসে আফগানিস্তানে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে আমেরিকা। সেই পরিস্থিতি আর তাদের নেই। অর্থনৈতিকভাবে কেন আরও দুর্বল হবে তারা?
জাগো নিউজ : যুক্তরাষ্ট্র বিদায় নিলে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে?
ইমতিয়াজ আহমেদ : ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে আফগানিস্তানের জনগণের ওপর। তারা খুবই সচেতন একটি জাতিগোষ্ঠী। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের মানুষ একটি সভ্যতা দাঁড় করিয়েছে। মনে রাখতে হবে, আফগান সভ্যতা অনেক পুরনো একটি সভ্যতা। এ বাংলা অঞ্চলও এক সময় আফগানদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
আফগানদের মধ্যে উগ্রবাদ যেমন আছে, তেমনি সহিষ্ণুতাও আছে। যুক্তরাষ্ট্র চলে গেলে কীভাবে সাজাবে, তার দায়িত্ব দেশটির জনগণের। তবে এতটুকু বলতে পারি, কোনো বিদেশি শক্তি আফগান দখল করে নিজেদের মতো করে সাজাবে, তা দেশটির জনগণ মানবে না।
কারণ দখলদারিত্ব নিয়ে তাদের একাধিক অভিজ্ঞতা আছে। ব্রিটিশরা চেষ্টা করেছিল, দখলে রাখতে পারেনি। রাশিয়াও পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র বিদায় নিচ্ছে। তার মানে, বিদেশিদের প্রতিরোধের যে ক্ষমতা, তা আফগানদের মধ্যে তীব্র এবং বিদেশি শক্তিও এখন তা বুঝতে পারছে।
আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র বিদায় নেয়ার বেলায় কী স্বার্থ রেখে যায়, তা দেখতে হবে। আবার চীন আফগানিস্তানে বিনিয়োগ করতে চাইছে বড় পরিসরে। সিল্করুটের মধ্য দিয়ে বড় অবকাঠামো নির্মাণ করতে যাচ্ছে তারা। এমন পরিস্থিতিতে আফগানিস্তান আসলে কোথায় দাঁড়াবে, তার জন্য সময় নিতে হবে। তবে আফগানিস্তানে কোনো বিদেশি শক্তি টিকতে পারবে না, তা হলফ করে বলতে পারি।
আফগানরা কী রকম মারমুখী, তা যুক্তরাষ্ট্র এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
জাগো নিউজ : যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ে তালেবানরা আরও মারমুখী হতে পারে কি-না?
ইমতিয়াজ আহমেদ : এখনকার তালেবান এবং আগের তালেবানের মধ্যে তফাৎ আছে, তা বলা যায়। নইলে তো আর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসতো না। দীর্ঘ যুদ্ধে তালেবানদের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপকহারে। প্রচুর হতাহত হয়েছে। এখনও তাদের যাযাবর জীবন। এ বাস্তবতা থেকে তারাও হয়তো মুক্তি চায়। তবে তালেবানরা আরও শক্তিশালী হবে, এটি সহজেই বলা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ে তালেবানরাই লাভবান হবে।
এএসএস/এমএআর/জেআইএম