শাস্তির বিধান রেখে চূড়ান্ত হচ্ছে ‘ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড’
>> মানহীন দুগ্ধজাত পণ্য বিক্রিতে ২ বছরের কারাদণ্ড
>> অর্থদণ্ড ৫০ হাজার টাকা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান
>> দুধ উৎপাদন, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণে থাকবে প্রণোদনা
>> উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে নিতে হবে রেজিস্ট্রেশন
জাতীয়ভাবে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং নিরাপদ খাদ্য হিসেবে দুধের সরবরাহ নিশ্চিত করতে ‘বাংলাদেশ ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড’ করতে যাচ্ছে সরকার। এজন্য ‘বাংলাদেশ ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড আইন, ২০১৯’ এর খসড়া তৈরি করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
খসড়া আইন অনুযায়ী, ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড দুধ বা দুধজাত খাদ্যের মান নির্ধারণ করে দেবে। নমুনা পরীক্ষা করে মানহীন পণ্য পেলে আইনানুগ ব্যবস্থাও নেবে বোর্ড। মানহীন দুধ বা দুগ্ধজাতীয় পণ্য প্রস্তুত, মজুত ও বিপণনে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে খসড়া আইনে।
এছাড়া দুধ উৎপাদন বা প্রক্রিয়াকারী উদ্যোক্তাদের পুঁজি সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ, ডেইরি বা ডেইরি সংশ্লিষ্ট সমবায় সমিতির নিবন্ধন, দুগ্ধ উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান-কে রেজিস্ট্রেশনও দেবে ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, কিছুদিন আগে একজন অধ্যাপক পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত দুধে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে বলে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করলে বেশ বিতর্ক তৈরি হয়। দুধ পানের বিষয়ে সংশয়ে পড়েন সাধারণ মানুষ। দেশে সম্প্রসারণশীল দুগ্ধশিল্প ক্ষতির মুখে পড়ে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোনো সমন্বিত প্রতিষ্ঠান ছিল না। তাই সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড গঠনে জোর দিয়েছে সরকার।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রাণিসম্পদ- ২) কাজী ওয়াছি উদ্দিন এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, ‘খসড়া আইনটি নিয়ে আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর বিস্তারিত মিটিং হবে। সেখানে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষগুলো থাকবে। সেই সভায় আমরা খসড়া চূড়ান্ত করার চেষ্টা করব।’
তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগে দুধ নিয়ে কিছুটা সমস্যায় আমরা পড়েছিলাম। সবকিছু বিবেচনা করে ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড করবে সরকার।’
অতিরিক্ত সচিব আরও বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আইনের খসড়াটি আমাদের পর্যায়ে চূড়ান্ত করে এটি মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। আশা করি, সেটা আমরা পারব।’
খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, বাংলাদেশ ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড হবে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। বোর্ডের প্রধান কার্যালয় সরকার নির্ধারিত স্থানে হবে। বোর্ড প্রয়োজনবোধে সরকারের পূর্বানুমোদন নিয়ে দেশের যেকোনো স্থানে শাখা কার্যালয় স্থাপন করতে পারবে।
বোর্ডের সাধারণ পরিচালনা ও প্রশাসন পরিচালনা পর্ষদের ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক বোর্ডের অনুমোদন-সাপেক্ষে দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালিত করবেন।
পদাধিকার বলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী হবেন বোর্ডের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব পদাধিকার বলে ভাইস-চেয়ারম্যান হবেন।
এছাড়া স্পিকার মনোনীত একজন সংসদ সদস্য, অর্থ বিভাগের মনোনীত কর্মকর্তা (যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার নিচে নয়), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (পদাধিকার বলে), প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক (পদাধিকার বলে), বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক (পদাধিকার বলে), কৃষি মন্ত্রণালয়ের মনোনীত কর্মকর্তা (যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার নিচে নয়), স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় মনোনীত কর্মকর্তা (যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার নিচে নয়), পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের কর্মকর্তা (যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার নিচে নয়) পরিচালনা পর্ষদে থাকবেন।
সরকার মনোনীত গবাদিপশু পালনকারী, বাণিজ্যিকভাবে দুধ উৎপাদনকারী ও দুগ্ধজাত খাদ্যের ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকে দুজন প্রতিনিধি, যার মধ্যে অন্য একজন মহিলা প্রতিনিধি থাকবেন, তবে কোনো গ্রুপ থেকে একাধিক সদস্য মনোনয়ন দেয়া যাবে না।
এছাড়া পর্ষদে থাকবেন নিবন্ধিত দুগ্ধ সমবায় সমিতির একজন করে মোট দুজন সদস্য, যার মধ্যে একজন মহিলা হবেন। বাংলাদেশ ডেইরি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক সদস্য-সচিব হবেন।
কমপক্ষে প্রতি তিন মাস অন্তর পরিচালনা পর্ষদের একটি সভা হবে। তবে জরুরি প্রয়োজনে স্বল্পতম সময়ের নোটিশে সভা আহ্বান করা যাবে। পরিচালনা পর্ষদের সভায় কোরাম গঠনের জন্য এর মোট সদস্য সংখ্যার কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ সদস্যের উপস্থিতির প্রয়োজন হবে বলে খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক হবেন সরকারের যুগ্ম সচিব বা এর ওপরের পদমর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তা। নির্বাহী পরিচালক বোর্ডের একজন সার্বক্ষণিক কর্মকর্তা হবেন এবং তিনি প্রধান নির্বাহী হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন।
বোর্ডের কার্যাবলী
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ডেইরি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যাবলী হবে- ব্যক্তিপর্যায়ে ও বাণিজ্যিকভাবে নিরাপদ খাদ্য হিসেবে দুধ উৎপাদনের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন। ডেইরিবিষয়ক বৈজ্ঞানিক, কারিগরি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনাবিষয়ক উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেয়ার সুপারিশ। ডেইরি হেলথ, দুধ উৎপাদন, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণে প্রণোদনা দেয়া ও প্রচারণা।
এছাড়া দুগ্ধ খামার বা দুগ্ধ শিল্পাঞ্চল সৃষ্টিতে উদ্যোগ গ্রহণ এবং দুধ উৎপাদন উদ্যোক্তা সৃষ্টি, ব্যক্তি বা সমবায়পর্যায়ে দুধ উৎপাদনে বোর্ড নির্ধারিত হারে সেবা ফি গ্রহণের মাধ্যমে ঋণ প্রদান ও আদায় এবং এ বিষয়ে সমবায় ভিত্তিক উদ্যোগে সহায়তা, দুগ্ধ বাজার সৃষ্টি ও ব্যবস্থাপনা; দুধ বা দুধজাত খাদ্যের মান যাচায়ের জন্য নমুনা সংগ্রহ, পরীক্ষা এবং মানের ব্যত্যয় ঘটলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা বোর্ডের কাজ।
খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, সরকারস্বীকৃত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে দুধ উৎপাদন বা প্রক্রিয়াকারী উদ্যোক্তাদের পুঁজি সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বোর্ড। ব্যবহারের জন্য শিশু ও অন্য যেকোনো মানুষের জন্য খাদ্য হিসেবে শ্রেণিভিত্তিক দুধের মান নির্ধারণ; দুধ বা দুগ্ধজাত খাদ্যের ওপর বিভিন্ন উপাত্ত সংগ্রহ, গ্রন্থনা, সরকারকে প্রতিবেদন আকারে প্রদান এবং বোর্ডের অনুমোদন-সাপেক্ষে অন্য যেকোনো ব্যক্তিকে প্রদান; দুধ বা দুগ্ধজাত খাদ্য উৎপাদন শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রকল্প প্রণয়ন, পরিচালনা ও বাস্তবায়নের কাজও করবে বোর্ড।
বোর্ডের কাজের মধ্যে আরও রয়েছে- ডেইরি বা ডেইরি-সংশ্লিষ্ট সমবায় সমিতির নিবন্ধন; ডেইরি বিজ্ঞান, প্রাণিস্বাস্থ্য, বাছুর পালন, প্রজনন, পশুপালন, প্রাণিপুষ্টি ও ঘাসচাষ বিদ্যাসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে গবেষণাসহ অন্যান্য কার্যক্রমের উন্নয়নে সুবিধা সৃষ্টি করা; সরকারের আরোপিত ডেইরি উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট অন্য যেকোনো দায়িত্ব পালন করা।
দুগ্ধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে নিতে হবে রেজিস্ট্রেশন
‘বোর্ডের একটি তহবিল থাকবে’ উল্লেখ করে খসড়া আইনে বলা হয়েছে, তহবিলে সরকারের ঋণ ও অনুদান থেকে অর্থ আসবে। এছাড়া তহবিলের অর্থের অন্যান্য উৎসের মধ্যে রয়েছে- সরকারের অনুমতি নিয়ে কোনো বিদেশি সরকার, সংস্থা বা আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে প্রাপ্ত অনুদান; বোর্ডের সম্পত্তি বিনিয়োগ থেকে আহরিত আয় ও সংগৃহীত ফি এবং সরকার অনুমোদিত অন্য কোনো উৎস হতে প্রাপ্ত অর্থ।
আইনের কার্যকারিতা আরম্ভের তারিখের পর বাণিজ্যিকভাবে স্থাপিত হবে এমন দুধ উৎপাদনকারী (খামার) প্রতিষ্ঠান দুগ্ধ প্রক্রিয়াকারী শিল্প; দুগ্ধজাত পণ্য প্রস্তুত, বিপণন কাজে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলকভাবে নির্ধারিত হারে ফি দিয়ে বোর্ডে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
তবে যে সব প্রতিষ্ঠান আইনের অধীনে প্রণীত বিধিমালা জারির এক বছরের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে স্থাপিত হবে এমন দুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, দুধ প্রক্রিয়াকারী শিল্প, দুগ্ধজাত পণ্য প্রস্তুত, বিপণন- এসব কাজে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে রেজিস্ট্রেশন নিতে হবে। সরকার রেজিস্ট্রেশনের উদ্দেশ্য, পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে বিধি প্রণয়ন করবে।
খামার, শিল্প স্থাপন
প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, বোর্ড নিজস্ব কর্তৃত্ব পরিচালনার জন্য সরকারের অনুমোদন নিয়ে দুধ উৎপাদন প্রতিষ্ঠান, দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, দুগ্ধজাত পণ্য প্রস্তুত, বিপণন বা এসব কাজের জন্য শিল্প স্থাপন এবং ক্রয় বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে পারবে।
মানহীন দুগ্ধজাত পণ্য বিক্রিতে ২ বছরের কারাদণ্ড
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, বোর্ড দুধ বা দুগ্ধজাত খাদ্যের মান নির্ধারণ করতে পারবে। প্রয়োজনীয় পরীক্ষার পর মান সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য আবেদনকারী প্রতিষ্ঠান-কে বোর্ড নির্ধারিত ফি গ্রহণের মাধ্যমে সনদ দিতে পারবে। সনদপ্রাপ্তির পর বোর্ড নিজ উদ্যোগে বা অভিযোগের ভিত্তিতে উৎপাদনস্থল, মজুদাগার, প্রক্রিয়াকরণ কারখানা ও বাজার থেকে দুধ বা দুগ্ধজাত খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করতে পারবে এবং পরীক্ষা করে নির্দিষ্ট মানের ব্যত্যয়ে মানহীন পণ্য প্রত্যাহার ও ধ্বংসের নির্দেশ দিতে পারবে। মানহীন দুধ বা দুগ্ধজাতীয় পণ্য প্রস্তুত, মজুদ ও বিপণন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
মানহীন দুধ বা দুগ্ধজাতীয় পণ্য প্রস্তুত, মজুদ ও বিপণন করলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিতের বিধান রাখা হয়েছে। ‘ফৌজদারি কার্যবিধি আইন, ১৮৯৮’ তে যা কিছুই থাকুক না কেন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ভ্রাম্যমাণ আদালত এ দণ্ড আরোপ করতে পারবে বলে খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়েছে।
আরএমএম/এমএআর/জেআইএম