হিযবুত তাহরীরের প্রচারণা কার মদদে?
২০০৯ সালে ‘জঙ্গি সংগঠন’ উল্লেখ করে হিযবুত তাহরীর-কে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এখনও তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ‘জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) চেয়েও ভবিষ্যতে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে হিযবুত তাহরীর’- আন্তর্জাতিক একটি সংস্থার প্রতিবেদনে এমন তথ্য উল্লেখ করা হলেও সুচিন্তিত কৌশলে অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে সংগঠনটি।
সম্প্রতি রাজধানীর ধানমন্ডি, শুক্রাবাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাড্ডা, এলাকায় হিযবুত তাহরীর সমর্থকদের প্রকাশ্যে লিফলেট বিতরণ করতে দেখা যায়। এছাড়া এসব এলাকার দেয়ালে দেখা যায় তাদের উস্কানিমূলক প্রচারণা। আগের মতোই তারা সক্রিয়ভাবে পোস্টার, লিফলেট বিতরণ করে সরকারবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে।
সরেজমিন ঢাবির টিএসসির দেয়ালে লাগানো ‘হিযবুত তাহরীর-এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সদস্যবৃন্দের’ নামে ছাপানো এক পোস্টারে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আসন্ন নেতৃত্বশীল রাষ্ট্র- খিলাফতের রাশিদাহ। আপনাদের জন্য শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ ও বিশ্বমানের শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করবে।’
এছাড়া ধানমন্ডির একটি মসজিদে সম্প্রতি লিফলেট বিতরণ করা হয়। যাতে লেখা রয়েছে ‘আসন্ন খিলাফত মুক্তির একমাত্র পথ।’ এছাড়া এতে সেনাবাহিনীকে উস্কে দেয়ার মতো আক্রমণাত্মক বার্তাও লেখা ছিল। কয়েকটি পোস্টারে কাশ্মীর ইস্যুতে দেশের মানুষকে ভারতের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদের উস্কানি দেয়া হয়।
সূত্র জানায়, হিযবুত তাহরীর সদস্যরা মূলত ফজরের আজানের আগে এসব পোস্টার লাগায়। তবে শুক্রবার জুমার নামাজের পর লিফলেট বিতরণের জন্য স্থানীয় পথশিশু ও মাদকাসক্ত কিশোরদের বেছে নেয়। এজন্য তারা ৫০ থেকে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক দেয়।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট জানায়, হিযবুত তাহরীর সদস্যরা ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। তারা বর্তমানে মাঠ পর্যায়ের কর্মী সংগ্রহে গুরুত্ব দিচ্ছে।
নিষিদ্ধ এ সংগঠনটি জুলাইয়ের শেষ দিকে নিজেদের ‘ইসলামিক রাজনৈতিক দল’ দাবি করে আর্থিক জোগানের বিষয়ে একটি অনলাইন কনফারেন্স করে। এছাড়া সেখানে তারা সরকারের ‘ভালো ইমেজ’ নস্যাৎ করার জন্য সেখানে নানা পরিকল্পনা করে।
সংগঠনটি নিষিদ্ধ করার পর থেকে এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে শতাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী।
গোয়েন্দারা জানান, হিযবুত তাহরীরের ৭০ শতাংশ সদস্য প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাদের এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে যাতে তারা কোনো ক্রমেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে মুখ না খোলে। তাই সদস্যদের গ্রেফতারের পর রিমান্ডে তেমন কোনো তথ্য পায় না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তারা মূলত জেলখানা থেকে কর্মী সংগ্রহ করত।
সম্প্রতি হিযবুত তাহরীরের কয়েকজন সদস্যকে আটক করে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ জানায়, নিষিদ্ধ সংগঠনটি কয়েকদিন আন্ডারগ্রাউন্ড ও অনলাইনে তাদের কার্যক্রম চালিয়েছে। তবে বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নব্য জেএমবিসহ অন্য জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম রুখতে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এ সুযোগে হিযবুত তাহরীর সদস্যরা প্রকাশ্যে প্রচারণা শুরু করছে।
তবে কার মদদে তাদের এ প্রকাশ্য প্রচারণা- জানতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধীরাই মদদ দিচ্ছে হিযবুত তাহরীরকে।’
এ বিষয়ে ডিবির সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মো. সোলাইমান মিয়াহ বলেন, আগস্টের ১০ তারিখ রাজধানীর পল্টন এলাকা থেকে অবৈধভাবে সরকারি রেভিনিউ স্ট্যাম্পসহ হিজবুত তাহরীরের পোস্টার, লিফলেট ও বিভিন্ন বই জব্দ করা হয়। আমরা জানতে পেরেছি, যে প্রিন্টিং প্রেস থেকে এগুলো জব্দ করা হয় সেটির মালিক আহমেদ হোসেন মানিক। তার প্রেস থেকেই হিযবুত তাহরীরের লিফলেট পোস্টার ছাপানো হয়। তদন্তে জানা গেছে, আহমেদ হোসেন মানিক জামায়াতের একজন সক্রিয় সদস্য।
কাউন্টার টেররিজমের এক সদস্য জাগো নিউজকে বলেন, তারা চরম পর্যায়ের রেডিকেলাইজেশনের মাধ্যমে সদস্যদের প্রস্তুত করছে। তারা আত্মঘাতী হামলার প্রস্তুতিও নিতে পারে। এছাড়া স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিরা হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে মিশে নাশকতা চালাতে পারে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী কাউন্টার টেররিজম এক্সচেঞ্জে (সিটিএক্স) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে হিযবুত তাহরীর আইএসের চেয়েও বিপজ্জনক হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস যখন উন্মত্ততা এবং গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণে বর্বর নৃশংসতায় ব্যস্ত, তখন হিযবুত তাহরীর খিলাফত প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি হিসেবে তাদের বৈশ্বিক কাঠামো গড়ে তোলায় বিশেষ মনোযোগী। কট্টর ইসলামপন্থায় বিশ্বাসী তরুণ ও আরব বিশ্বের গভীর সমর্থনের ওপর নির্ভর করে এ কাঠামো তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে সংগঠনটি। নজরদারি এড়িয়ে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে মতাদর্শ প্রচার করছে সংগঠনটি এবং এরই মধ্যে ৫০টি দেশে তাদের সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করে ফেলেছে। বিশ্বজুড়ে হিযবুত তাহরীরের সদস্য সংখ্যা এখন ১০ লাখেরও বেশি। আইএসের সদস্য সংখ্যাও এত বেশি নয়। এ কারণে আইএসের চেয়েও বিপজ্জনক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা হিযবুত তাহরীরের রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, আইএস ও হিযবুত তাহরীরের মধ্যে মতাদর্শগত বিশেষ তফাৎ নেই। যারা আইএসকে সমর্থন করে, তারা হিযবুত তাহরীর-কেও সমর্থন করে। তবে আইএসের সঙ্গে তাদের কৌশলগত পার্থক্য রয়েছে। বর্তমানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের চেয়ে তরুণদের আকৃষ্ট ও দীক্ষিত করতেই তারা বেশি আগ্রহী। এর মাধ্যমে তারা সামাজিক মূলধন বাড়িয়ে চলেছে।
বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম নিয়ে পুলিশ সদরদফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মো. সোহেল রানা জাগো নিউজকে বলেন, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে পুলিশের জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত রয়েছে। হিযবুত তাহরীর নানা কৌশলে তাদের কার্যক্রম বিস্তারের চেষ্টা করছে। কিন্তু পুলিশের জঙ্গিবাদবিরোধী তৎপরতার কারণে সুবিধাজনক অবস্থান তারা তৈরি করতে পারছে না। ইতোমধ্যে এ সংগঠনের অনেক সদস্যকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। যে কোনো জঙ্গি বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যেন সংঘবদ্ধ হয়ে বড় ধরনের নাশকতা চালাতে না পারে সেজন্য সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ।
এদিকে বাংলাদেশে হিযবুত তাহরীরের সদস্য আটক করেছেন এবং তাদের নিয়ে তদন্ত করেছেন পুলিশের এমন এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের গ্রেফতারকৃত অধিকাংশই ছিল অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত লোকজন। কিন্তু হিযবুত তাহরীরের গ্রেফতারকৃতদের শতকরা ৯৯ জনই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অথবা পেশাজীবী।
১৯৫২ সালে জেরুজালেমে প্রতিষ্ঠিত এ দলটির সদরদফতর লন্ডনে। মধ্য এশিয়া, ইউরোপ, দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় (মূলত ইন্দোনেশিয়া) এর শাখা রয়েছে।
এআর/এএইচ/এমএস