মেয়র মনোনয়নে দুই সিটিতে বিএনপির জটলা
আসন্ন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে মনোনয়ন পেতে ইতোমধ্যে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপিতে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে। মনোনয়নের এ দৌড়ে দুই সিটিতে অন্তত এক ডজনের অধিক নেতার নাম শোনা যাচ্ছে।
বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না- এমন ঘোষণা দিলেও গতকাল শনিবার উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে অংশগ্রহণের কথা জানায় দলটি। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘১৪ অক্টোবর আট উপজেলায় যে নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।’ যদিও এর আগে পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি। এমনকি দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন পরবর্তীতে তাদের দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়।
নির্বাচনমুখী দল হিসেবে ফের রাজপথে সক্রিয় হচ্ছে বিএনপি। দলটির নেতাকর্মীরা যোগ্যতা ও সক্ষমতা অনুযায়ী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এজন্য একদিকে যেমন জনসম্পৃক্ততামূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন তারা, অন্যদিকে মনোনয়নের প্রত্যাশায় দলের হাইকমান্ডের সবুজ সংকেত পাওয়ারও তদবির করছেন।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়াদ ২০২০ সালের ১৩ মে এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়াদ একই বছরের ১৬ মে পর্যন্ত। ঢাকা উত্তরের মেয়র পদে ধানের শীষে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন- বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে বিএনপি চেয়ারপারসনের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল। তাবিথ এর আগেও এ সিটিতে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
ঢাকা উত্তরে মেয়র পদে বিএনপির হয়ে লড়ার জন্য বিভিন্নভাবে তদবির চালাচ্ছেন যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুল ইসলাম নীরব। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বন্ধু হিসেবে পরিচিত হাওয়া ভবন খ্যাত গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের আত্মীয় নীরব। নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রচারণা আছে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরোধিতা সত্ত্বেও কেবল মাত্র গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের কারণে নীরবকে যুবদলের সভাপতি করা হয়েছে। নীরবের অভিভাবক হিসেবে মামুন আছেন বলেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা থেকে তিনি মনোনয়নও পান। ঢাকা উত্তর সিটিতেও নীরব মেয়র পদে বিএনপির মনোনয়ন পাবেন। নীরবের ডামি প্রার্থী হিসেবে থাকবেন যুবদল ঢাকা উত্তরের সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর।
এছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেজর (অব.) কামরুল ইসলাম, বিএনপির বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন এবং বিএনপির শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাৎ হোসেন সেলিম ঢাকা উত্তর সিটিতে মেয়র পদে মনোনয়নপ্রত্যাশী।
এ প্রসঙ্গে সেলিম বলেন, ‘২০ দলীয় জোট থেকে ঢাকা উত্তরের মেয়র পদে নির্বাচন করতে চাই। প্রাথমিক প্রস্তুতিও শুরু করেছি। আশা করি, জোট বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেবে।’
তবে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির দপ্তর সম্পাদক এ বি এম রাজ্জাক বলেন, ‘ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সভাপতি এম এ কাইয়ুমের নির্দেশে উত্তরের সকল থানার নেতাকর্মীরা তাবিথ আউয়ালের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তাবিথ আউয়ালই ঢাকা উত্তরের বিএনপির একমাত্র মেয়র প্রার্থী, এখানে অন্য কেউ নেই।’
অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে মেয়র পদে মনোনয়নপ্রত্যাশী মির্জা আব্বাস ও আফরোজা আব্বাস দম্পতি। গত সিটি নির্বাচনের মতো মির্জা আব্বাসের মনোনয়ন বাতিল হলে তার স্ত্রী আফরোজা আব্বাস মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। পাশাপাশি আফারোজা আব্বাস ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আগামী কমিটির সভাপতি হবেন যাতে তার জন্য মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন পেতে সহজ হয়। সেই প্রত্যাশা নিয়ে এ দম্পতি সম্প্রতি লন্ডন ঘুরে এসেছেন বলে নেতাকর্মীদের মধ্যে গুঞ্জন রয়েছে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি হাবিব-উন নবী খান সোহেল দক্ষিণ সিটিতে মেয়র পদে মনোনয়নপ্রত্যাশী। ঢাকার রাজনীতিতে অস্তিত্ব সংকটে থাকা উত্তর বঙ্গের এ নেতাকে নিয়ে রংপুর- ৩ আসনে চিন্তা করা হলেও তিনি সেখানে যেতে রাজি হননি। ঢাকার রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্যে তিনি মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান বলে জানা গেছে।
অবিভক্ত ঢাকার মেয়র বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেনও ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। তার ডামি প্রার্থী হিসেবে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালামের নাম শোনা যাচ্ছে।
দক্ষিণ সিটি নির্বাচন প্রসঙ্গে ইশরাক বলেন, ‘গত ৩০ ডিসেম্বরের আগে বলেছিলাম, দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখি না। বৃহত্তর আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমরা পার্টিসিপেট করতে কিছুটা বাধ্য হয়েছিলাম। সেটার ধারাবাহিকতায় আগামীতে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দল অংশ নেবে বলে জানতে পেরেছি।’
তিনি বলেন, ‘আমার প্রতি দলের একটা নির্দেশনা ছিল যে, আমি যাতে প্রস্তুত থাকি। সেই লক্ষ্য নিয়ে আমি কাজ করে যাচ্ছি এবং সকল ধরনের প্রস্তুতি, যা নেয়া দরকার সেটা নিচ্ছি। জনসম্পৃক্ততামূলক কর্মকাণ্ড বর্তমানে করছি। আমি একজন আদর্শবাদী রাজনীতিবিদের সন্তান হিসেবে আদর্শ রাজনীতি করতে এসেছি। আমার নিজস্ব চাওয়া-পাওয়া তেমন একটা নাই। মেয়র, এমপি, মন্ত্রী- এসবের ব্যাপারে আমার আকর্ষণ নাই। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে আমি গর্বিত যে, মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। উত্তরবঙ্গে মাননীয় মহাসচিবের সঙ্গে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে গিয়েছিলাম, সেখানে মানুষের অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। বাবার কথা স্মরণ করে সাধারণ মানুষ বুকে জড়িয়ে যেভাবে ভালোবাসা দেখিয়েছেন, এটা আমার বড় পাওয়া। আমার অনুসারী অনেকেই আছেন তারা আমাকে আমার বাবার যোগ্য উত্তরসূরী মনে করছেন, তারা আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য উৎসাহ জোগাচ্ছেন।’
বিএনপিতে সাদেক হোসেন খোকার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিরা রয়েছেন। আপনার মনোনয়ন চাওয়াটা তারা কীভাবে বিবেচনা করবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে ইশরাক বলেন, ‘বিএনপির মতো বড় দলে কম্পিটিশন থাকবে, এ বছর থেকে দলের সঙ্গে গভীরভাবে ইনভলব হয়েছি। সেখান থেকে দেখেছি, বিএনপি অনেক বড় দল। বাবার যারা প্রতিদ্বন্দ্বী, আমি মনে করি, তাদের সন্তানতুল্য আমি। আশা করি তাদের সহযোগিতা পাব। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের গাইড লাইন পাচ্ছি, তাকে রাজনৈতিক গুরু মানি। তবে, দল যাকে মনোনীত করবে, দলের সবাই তার সঙ্গে থাকবে।’
এদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত দলের স্থায়ী কমিটিতে যাওয়ার আলোচনায় থাকা এক নেতা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘ভাড়াটে আর বিলাতি দিয়ে ঢাকার দুই সিটিতে মেয়র পদে বিএনপির মনোনয়ন দেয়া উচিত হবে না। এমন দুজনকে দিতে হবে যাদের সঙ্গে দুই সিটির নেতাকর্মী, ভোটার ও বাসিন্দাদের সত্যিকারের সম্পর্ক আছে। বাসিন্দাদের বাড়ির সামনে গিয়ে তাদের নাম ধরে ডাকতে পারে, দলের কোন কর্মী কোন জায়গায় গুলি খেয়েছে, কার ভাই, কার স্বামী গুম হয়েছে- এসব যার মুখস্থ তাকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়া উচিত। এসব বিবেচনায় আমার কাছে ঢাকা উত্তরের জন্য সাইফুল ইসলাম নীরব-ই মনোনয়নযোগ্য। উত্তরে এর আগে তাবিথকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। তাবিথ বেশ ভালো ছেলে। দলের আন্তর্জাতিক উইংয়ে কাজ করছে, ভবিষ্যতে সে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হবে। দক্ষিণে সাদেক হোসেন খোকা থাকলে তার বিকল্প ছিল না। তিনি যেহেতু নেই, তার ছেলেকে আব্বাসবিরোধীরা উৎসাহ দিচ্ছেন।’
‘ইশরাক ছেলে হিসেবে স্মার্ট ও বিনয়ী। ইশরাকও চেয়ারপারসনের আন্তর্জাতিক উইংয়ে কাজ করছে। তাকে নিয়ে ভবিষ্যতে আশা করা যায়। কিন্তু বর্তমান রাজনীতিতে সে একদমই কাঁচা। এ সিটিতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশিদ হাবিব মেয়র পদে দলের মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। অর্থাৎ উত্তরে নীরব, দক্ষিণে হাবিব। এ দুজনই পরীক্ষিত। তাদের সঙ্গে দলের নেতাকর্মীদের সত্যিকারের আত্মার সম্পর্ক রয়েছে, রয়েছে নাড়ির সম্পর্ক। এখন দেখা যাক, দলের হাইকমান্ড চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কী নেন।’
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের মনোনয়ন প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সিটি করপোরেশন নির্বাচনের এখনও অনেক দেরি। এনিয়ে দলের আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি।’
কেএইচ/এমএআর/জেআইএম