ঋণ পুনর্গঠনে আবারও সুবিধা পাচ্ছে প্রভাবশালী সেই ১১ গ্রুপ
ব্যাংক লুটে খাচ্ছে রাঘববোয়ালরা। ব্যবসার নামে নানা অনিয়ম করে তারা ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। যখনই এসব বড় খেলাপিরা সমস্যায় পড়ছেন তখনই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিশেষ সুবিধা আদায় করছেন। এতে লাগামহীনভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। ফলে লোকসানের পাল্লা ভারি হয়ে দুর্বল হচ্ছে ব্যাংকিং খাত। যার কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে অর্থনীতি।
জানা গেছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো খেলাপির বড় অংশই হাতেগোনা কয়েকটি শিল্প গ্রুপের হাতে আটকে রয়েছে। তারা সংঘবদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ২০১৫ সালে বিশেষ সুবিধা নেয়। এ তালিকায় রয়েছে ১১টি ব্যবসায়ী শিল্প গ্রুপ। বিশেষ সুবিধা নেয়া গ্রুপগুলো হচ্ছে- বেক্সিমকো গ্রুপ, যমুনা গ্রুপ, থার্মেক্স গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ, আবদুল মোনেম লিমিটেড, কেয়া গ্রুপ, এসএ গ্রুপ (এসএ অয়েল রিফাইনারি ও সামান্নাজ), বিআর স্পিনিং, এননটেক্স গ্রুপ, রতনপুর গ্রুপ এবং রাইজিং স্টিল।
ওই সময়ে গ্রুপগুলো বিশেষ সুবিধায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ পুনর্গঠন করে। কিন্তু এসব গ্রুপ নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেনি। শর্ত ভঙ্গ করায় আবারও তারা খেলাপি হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে চার বছর যেতে না যেতেই আবারো সুবিধা নিতে সরকারের উচ্চ মহল থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। উপায় না পেয়ে আবারও প্রভাবশালী সেই ১১ গ্রুপকে সুবিধা দিতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ২৭ আগস্ট পরিচালনা পর্ষদ সভায় এমনই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানান, বড় খেলাপিদের ঋণ পুনর্গঠনে আবারও বিশেষ সুবিধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মাত্র দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১২ বছরের জন্য তারা ঋণ নবায়নের সুযোগ পাবেন। তবে আগের সুবিধাভোগীরা সব ঋণ নবায়ন করতে পরবে না। তারা তলবি ও চলমান ঋণগুলো বিশেষ সুবিধায় নবায়ন করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে যেসব ব্যাংক থেকে গ্রুপগুলো ঋণ নিয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পর্ষদ ঋণ নবায়ন করবে কি-না তার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এরপর ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংককে জানালে তা যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেয়া হবে।
আবারও ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, আগে যখন ঋণ পুনর্গঠন করার বিশেষ সুযোগ দিয়েছিল তখনই আমরা বলেছিলাম- যারা সুবিধা নিবে তারা কিভাবে ঋণ শোধ করবে তার একটা অর্থিক পরিকল্পনা নিতে হবে। এরপর যাচাই-বাছাই করে সুযোগ দিতে হবে। ওই সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বড় খেলাপিদের সুবিধা দিয়েছিল। কিন্তু সুবিধাভোগীরা শর্ত ভঙ্গ করেছে, ঋণ শোধ করেনি। এখন আবারও খেলাপি হয়ে গেছে। তাই আবার সুবিধা চাচ্ছে। তার মানে একবার সুবিধা দিলে বারবার সুবিধা চায়। এটাই আমাদের বড় সমস্যা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত অবস্থান নিতে হবে।
তিনি বলেন, এখন যারা আবারও ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা চাইছে, তাদের বলতে হবে আগের শর্ত কেন তারা ভঙ্গ করেছে। তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি তাদের আর্থিক পরিকল্পনা ও পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে হবে। এখন যারা পুনরায় বিশেষ সুবিধা নিবে তাদের নতুন শর্ত জুড়ে দিতে হবে। এর মধ্যে এককালিন কিছু ঋণ পরিশোধ করে যেন সুবিধা পায় এ ধরনের শর্ত দিতে হবে। এতে করে কিছু অর্থ আদায় হবে।
সাবেক এ গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার বড় খেলাপিদের সুযোগ দেয়া মানে তাদের দুর্বলতা। এভাবে ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ নিতে থাকলে এক সময় ঋণের অর্থ পরিশোধ না করার পর্যায়ে চলে যাবে। এটি চলতে থাকলে আগামীতে অন্যরাও সুযোগ নিবে। তাই এখনই এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সতর্ক হতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সরকারি-বেসরকারি প্রায় ২৪টি ব্যাংক থেকে ১৫ হাজার ২১৭ কোটি টাকা সুবিধা নিয়েছিল শিল্প গ্রুপগুলো। নিয়মিত ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংকগুলোর পুঞ্জীভূত খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। যার কারণে বেশ কিছু ব্যাংক নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) ঘাটতিতে পড়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটি ব্যাংক মূলধনও খেয়ে ফেলছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলো এসব গ্রুপের কাছে জিম্মি হয়ে নাজুক অবস্থায় পড়েছে।
জানা গেছে, বিশেষ সুবিধায় বেক্সিমকো গ্রুপ সরকারি-বেসরকারি আটটি ব্যাংকের ৫ হাজার ৬৪৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা ঋণ পুনর্গঠন করে। এরমধ্যে জনতা এক হাজার ৮৪৯ কোটি ১০ লাখ, সোনালী এক হাজার ৭৫ কোটি ৪১ লাখ, ন্যাশনাল ৪৭৭ কোটি ৮৪ লাখ ও এবির ৪৮৩ কোটি, ব্যাংক এশিয়ায় ৩০ কোটি, এক্সিম ২৩৩ কোটি, অগ্রণী ৮০১ কোটি ও রূপালী ব্যাংক ৬৯২ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে।
যমুনা গ্রুপ বিশেষ সুবিধায় ১০ ব্যাংক থেকে নেয়া এক হাজার ৬৮৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ঋণ নবায়ন করে। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকের ৫৯৮ কোটি টাকা ঋণ নবায়ন করে। ইউসিবিএল ১৭৪ কোটি, আইএফআইসি ১৪১ কোটি, ডাচ্-বাংলা ১৭৫ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ৮৬ কোটি, সোস্যাল ইসলামীর ৭৩ কোটি, মার্কেন্টাইল ৫১ কোটি, ইসলামী ব্যাংক ১৮৭ কোটি, অগ্রণীর ৩২ কোটি ও প্রাইম ব্যাংকের ১৬৩ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করে।
থার্মেক্স গ্রুপের পক্ষে ঋণ পুনর্গঠনের আবেদন করে জনতা ব্যাংক। যার পরিমাণ ৬৬৬ কোটি টাকা।
শিকদার গ্রুপ তিন ব্যাংকে এক হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা, আবদুল মোনেম লিমিটেড চার ব্যাংকে ৫৭৬ কোটি ৭২ লাখ টাকার ঋণ পুনর্গঠন করে। কেয়া গ্রুপের ৮৭৯ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করে পূবালী, সাউথইস্টসহ পাঁচটি ব্যাংক।
এস এ গ্রুপের ৯২৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করে ছয়টি ব্যাংক। বিআর স্পিনিংয়ের চার ব্যাংকের ৫৭২ কোটি টাকা ঋণ পুনর্গঠন করেছিল।
এননটেক্স গ্রুপের এক হাজার ৯৪ কোটি টাকা ঋণ পুনর্গঠন করে জনতা ব্যাংক। এছাড়া রতনপুর গ্রুপ ৮১১ কোটি টাকা এবং রাইজিং গ্রুপের ৫২২ কোটি টাকা বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনর্গঠন করেছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প উদ্যোক্তাদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার জন্য ২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠনের নীতিমালা জারি করা হয়। নীতিমালায় মেয়াদি ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেয়া হয় সর্বোচ্চ ১২ বছর। আর তলবি ও চলমান ঋণ পুনর্গঠন হয় ছয় বছরের জন্য। যেসব শিল্প গ্রুপের ৫০০ কোটি টাকার ওপরে খেলাপি ঋণ ছিল তাদেরকে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে এবং যেসব শিল্প গ্রুপের ১ হাজার কোটি টাকার ওপরে খেলাপি ঋণ ছিল তাদের ১ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণ খেলাপিদের বিশেষ এ সুবিধার উদ্দেশ্য ছিল শিল্প গ্রুপগুলোর ঋণ পুনর্গঠন করে লোকসান কাটিয়ে উঠবে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলো আয় করে ঋণের অর্থ পরিশোধ করবে। ওই সময় ১১ শিল্প গ্রুপ ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ পুনর্গঠন করেছিল। যার কারণে তখন খেলাপি ঋণও কমে যায়। কিন্তু বিশেষ সুবিধা নেয়ার পরও শিল্প গ্রুপগুলো পরবর্তিতে খেলাপি ঋণ নিয়মিত পরিশোধ করেনি। ফলে পুনর্গঠন করা ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় সুদ আসলে ঋণের অংক ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। শুধু তাই নয়, উচ্চ আদালত থেকে খেলাপি ঋণের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে বড় গ্রুপগুলো অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নেয়ার অভিযোগও রয়েছে।
এসআই/এএইচ/জেআইএম