সংশোধনীতেও মিলছে ‘বিদেশে প্রশিক্ষণের’ অর্থ!
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় পাস হওয়া অনেক প্রকল্পেই বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকে। এমনকি পুকুর খনন শিখতেও বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য অর্থের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য অর্থ বরাদ্দ না চাওয়া প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের হয়তো কিছুটা আফসোস থাকতে পারে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেই আফসোসও এবার দূর হচ্ছে।
বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অযাচিত ব্যয় নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে বাজার মূল্যের তুলনায় আট লাখ টাকা বেশি খরচ দেখিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বই কেনা, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্পে একটি বালিশের দাম পাঁচ হাজার ৯৫৭ টাকা এবং তা ওঠানোর খরচ ৭৬০ টাকা নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়। সম্প্রতি বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ১৬ কর্মকর্তা পুকুর খননের বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশ সফর বিষয়টি বেশ আলোচিত হচ্ছে।
সম্প্রতি শেষ হওয়া ১২তম ও ১৩তম একনেক সভার নথি ঘেঁটে জানা গেছে, মূল প্রকল্পে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য অর্থ চাইতে ‘ভুলে’ গেলে কিংবা না চাইলেও সংশোধনীতে চাইলে তাদের অর্থ বরাদ্দ দেয়া হবে। গত ২৭ আগস্ট (মঙ্গলবার) ১৩তম এবং ২০ আগস্ট (মঙ্গলবার) ১২তম একনেক সভা অনুষ্ঠিত হয়।
১৩তম একনেক সভায় মোট ১২টি উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। এর মধ্যে পাঁচটি প্রকল্প সংশোধন করা হয়েছে। সংশোধিত ওই পাঁচটির মূল প্রকল্পের একটিতেও বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য অর্থ বরাদ্দ ছিল না। সংশোধিত তিন প্রকল্পে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয়। একনেক সভায় ওই তিন প্রকল্পের জন্য এ খাতে থোক বরাদ্দ দেয়া হয়।
এর মধ্যে ‘ট্রমা ইউনিটসহ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ স্থাপন, মানিকগঞ্জ (প্রথম সংশোধন)’ প্রকল্পের পাঁচ বছর পর, ‘ইসিবি চত্বর থেকে মিরপুর পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন এবং কালশী মোড়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ (প্রথম সংশোধন)’ দেড় বছরের বেশি সময় পর এবং ‘আলীকদম-জালানিপাড়া-কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী সড়ক (প্রথম সংশোধন)’ প্রকল্প একনেকে প্রথম অনুমোদনের আড়াই বছরের বেশি সময় পর সংশোধনীতে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য থোক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
বিদেশে প্রশিক্ষণে প্রকল্পভেদে বরাদ্দের টাকায়ও রয়েছে বড় পার্থক্য। প্রথমটিতে (হাসপাতাল) প্রকল্পে ৭৫ লাখ, দ্বিতীয়টিতে (ইসিবি থেকে মিরপুর সড়ক) ৩০ লাখ এবং তৃতীয়টিতে (আলীকদম থেকে পোয়ামুহুরী সড়ক) বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯৫ লাখ টাকা।
২৭ আগস্টের একনেক সভায় সংশোধিত পাঁচটির মধ্যে তিনটি সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প। এর মধ্যে দুটি সড়ক প্রকল্প সংশোধন করে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ নেয়া হয়েছে। সড়কের বাকি একটি প্রকল্পে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য টাকা চাওয়া হয়নি বা প্রয়োজন হয়নি। প্রকল্পটি হলো ‘বড়তাকিয়া (আবুতোর) থেকে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল সংযোগ সড়ক নির্মাণ’। বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য টাকা না নেয়া অপর প্রকল্পটি হলো ‘বেগম আমিনা মনসুর টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, কাজিপুর, সিরাজগঞ্জ’।
১২তম একনেক সভায় মোট ১২টি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। এর মধ্যে দুটি প্রকল্পের সংশোধন আনা হয়। ওই দুটির একটিতেও মূল প্রকল্পে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয়নি। সংশোধনীতে একটি প্রকল্পে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয়। সেটি অনুমোদন দেয় একনেক।
সংশোধিত প্রকল্প দুটি হলো- ‘মেঘনা নদীর ভাঙন থেকে ভোলা জেলার চরফ্যাশন পৌর শহর সংরক্ষণ (প্রথম সংশোধন)’ এবং ‘থানচি-রিমাকরি-লিকরি সড়ক নির্মাণ (প্রথম সংশোধন)’। থানচি থেকে লিকরি সড়ক নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদনের তিন বছর পর সংশোধনীতে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য এক কোটি এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেয় একনেক।
বিদেশে প্রশিক্ষণের বিষয়ে ১৩তম একনেক সভায় জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানান, বিষয়টি তার নজরে আনায় ভালো হয়েছে। তিনি প্রকল্পের খাতওয়ারি বরাদ্দগুলো আবার যাচাই-বাছাই করবেন। এরপর থেকে বিষয়গুলো সতর্কতার সঙ্গে দেখবেন।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘যেকোনো প্রকল্পের প্রণয়ন প্রক্রিয়া এবং পরবর্তীতে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় বিদেশে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে। তবে সেটা যদি যৌক্তিক হয়, তবে সেটা নিয়ে আলোচনা বা বিতর্ক হওয়ার সুযোগ নেই।’
‘কিন্তু বিদেশি কিংবা রাষ্ট্রীয় অর্থায়নের প্রকল্প মানেই যদি হয় কিছু মানুষের বিদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ, তাহলে সেটা অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ‘কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হচ্ছে বিষয়টি ভালোভাবে খতিয়ে দেখা। প্রকল্পে কেন আগে বিদেশে প্রশিক্ষণের বিষয়টি ছিল না, এখন কেন প্রয়োজন- সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। তাহলে প্রকল্পের কোথাও ঘাটতি ছিল কিনা কিংবা প্রকল্পপ্রণয় প্রক্রিয়ায় কি ঘাটতি ছিল?’
প্রকল্পগুলোতে বিদেশে প্রশিক্ষণের বিষয়টি অনুমোদনের আগে খতিয়ে না দেখলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলেও মনে করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।
পিডি/এমএআর/এমএস