আসাম সীমান্তে পুশইন হবে, ঠিক রোহিঙ্গাদের মতো
ড. তানজিম উদ্দিন খান। কূটনৈতিক বিশ্লেষক। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। আসামের নাগরিকত্ব সংকট, কাশ্মীর পরিস্থিতি, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর।
দক্ষিণ এশিয়ার শান্তির জন্য ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে হুমকি মনে করেন তিনি। ভারতের সংবিধান থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ তুলে দেয়ার ঘটনা কাশ্মীরিদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে পারে বলেও মত দেন। বহুপাক্ষিক আলোচনার মধ্যে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান করতে হবে বলে উল্লেখ করেন এ বিশ্লেষক।
দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : আসামের ১৯ লাখ বাঙালির নাগরিকত্ব বাতিল করে দিল ভারত। আসাম পরিস্থিতি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?
তানজিম উদ্দিন খান : এখানে দুটি বিষয় সামনে এনে আলোচনা করা দরকার। প্রথমত, দেখতে হবে ভারতে কী ধরনের রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আছে। নাগরিকের পরিচয় সামনে এনে রাজনীতি করা ভারতের বিজেপি সরকারের জন্য খুবই জরুরি।
যে উপায়ে আসামের মানুষদের নাগরিকত্ব চিহ্নিতের চেষ্টা করা হয়েছে, তার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ তারিখটা চিহ্নিত করে আসামের মানুষকে রাষ্ট্রহীন করা হয়েছে। এ তারিখটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরই তো সীমানা ক্রস করে এপারের মানুষ ওপারে যান।
দ্বিতীয়ত, বিজেপির মতো রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রের আড়ালে উগ্রবাদী রাজনৈতিক পরিচয়টাকেই সামনে আনে। সেটা ধর্ম বা জাতীয়তাবাদ কিংবা অন্য যেকোনো বিষয় কেন্দ্র করেই। এ উগ্রবাদের বিস্তার কিন্তু ভোটকে ঘিরেই।
যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্রই এরা ধারণ করে, সেহেতু সংখ্যাটা তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমে ৪০ লাখ মানুষের কথা শুনছিলাম। এখন ১৯ লাখ মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হলো। মুসলমান বাঙালির কথা থাকলেও এখন এ ১৯ লাখে অন্য ধর্মের মানুষও আছে। বিজেপির সংকীর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে আসামের বাঙালিদের রাষ্ট্রহীন করা হয়েছে।
জাগো নিউজ : এমন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফলাফল কী হতে পারে?
তানজিম উদ্দিন খান : এ ঘটনার দুটি দিক। প্রথমত, আমি বাংলাদেশের জন্যই বলব। একদিকে রোহিঙ্গা, অন্যদিকে নাগরিকত্বহারা আসামের বাঙালি। এ দুই জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের জন্য ভয়ঙ্কর চাপ তৈরি করছে।
আমি আবারও ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের কথা বলছি। এ তারিখ ধরেই আসামের বাঙালিদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলা হচ্ছে। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, আসাম সীমান্তে ফের পুশইন শুরু হবে, ঠিক রোহিঙ্গাদের মতো।
দ্বিতীয়ত, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ভারতে নিজেদের মধ্যকার সংকট প্রকাশ পাচ্ছে। ১৯৪৭ সালের আগের যে ভারত, তা আর নেই। কাশ্মীর থেকে আসাম, ভারতের আরেক পরিচয় মেলে ধরেছে। এজন্য আমি কাশ্মীর থেকে আসামকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে চাই না। নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপির যে জাতীয়তাবাদী আদর্শ, তার ওপর ভিত্তি করেই ভারতে নতুন ধারার রাজনীতির সূত্রপাত ঘটছে, যা খুবই ভয়ানক ও বিপজ্জনক। এ বিপদ শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর জন্য নয়, ভারত নিজের জন্যও বিপদ ডেকে আনছে। ভারত একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র। বহু ধর্মের মানুষের বসবাস সেখানে। ভারত যদি এ বহু জাতের মানুষকে ধারণ করতে না পারে, তাহলে বিশেষ সংকটের মধ্য দিয়ে দেশটিতে নতুন অস্থিরতা সৃষ্টি হবে।
জাগো নিউজ : এ অস্থিরতার মধ্য দিয়ে ভারত আসলে কোথায় যেতে চাইছে?
তানজিম উদ্দিন খান : মোদি সরকার ভারতকে আসলে সার্বজনীন রাখতে চাইছে না। তারা নির্দিষ্ট একটি ধর্মগোষ্ঠীর ভারত দেখতে চায়। নির্দিষ্ট পরিচয়ের ভিত্তিতে উগ্র জাতীয়তাবাদের যখন বিস্তার ঘটে, তখন একটি রাষ্ট্রের ভূখণ্ডগত যে অস্থিরতা, তা আরও ত্বরান্বিত হয়। ভারতে এখন তাই দেখছি।
জাগো নিউজ : কিন্তু এর ফল তো রাজনৈতিক দলগুলোর জানা থাকার কথা…
তানজিম উদ্দিন খান : এমন সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলো কখন নেয়, যখন তারা একেবারে জনবিচ্ছিন্ন বা সমাজবিচ্ছিন্ন থাকে। তখন তারা ধর্ম বা জাতীয়তাবাদ ইস্যুকে সামনে আনে। যে ইস্যু নিয়ে আসলে তর্ক করার সুযোগ রাখা হয় না। রাষ্ট্র ও সমাজে নিজেদের বৈধতার সংকট দূর করতেই ধর্ম ও জাতীয়তাবাদ সামনে আনা হয়। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি এ সংকীর্ণ রাজনীতিতেই অধিক মনোযোগ দিচ্ছে।
জাগো নিউজ : এ রাজনীতি ভারত কতদিন ধারণ করবে?
তানজিম উদ্দিন খান : বিজেপির উগ্রবাদী রাজনীতি কতদিন টেকসই হবে, তা মূলত নির্ভর করবে বিরোধী শক্তিগুলোর ওপর। উগ্রবাদী রাজনীতির বিপরীতে বিরোধীদের সক্রিয় ও সচেষ্ট হওয়ার ওপর সব নির্ভর করছে। ভারতের মানুষের এখন বোঝা উচিত, এমন রাজনীতির মধ্যে একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের কেউ-ই আসলে নিরাপদ নয়। এভাবে চলতে থাকলে সবার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে, এমনটি বুঝিয়ে বিরোধীশক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
আজ মোদির যে উত্থান, তাতে কংগ্রেসের অবদানও কম নয়। কংগ্রেস যে ধরনের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি করেছে, তা অনেকের কাছেই ভণ্ডামি বলে মনে হয়েছে। কংগ্রেস সরকারের দুর্নীতি, অপশাসন বিজেপির পথ পরিষ্কার করে দিয়েছে।
জাগো নিউজ : পশ্চিমবঙ্গেও নাগরিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে…
তানজিম উদ্দিন খান : বিজেপি যেকোনো মূল্যে তার আধিপত্য বিস্তার করবে। পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান বাঙালি ভোটব্যাংক হিসেবে কাজ করে তৃণমূল কংগ্রেসের। বাঙালি মুসলমানদের এভাবে টার্গেট করলে বিজেপি সরকারের জন্য খুবই সুবিধা হয়। এ কারণে পশ্চিমবঙ্গেও এনআরসি হবে, এটি খুবই স্বাভাবিক।
জাগো নিউজ : এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কতটুকু চাপ অনুভব করছে?
তানজিম উদ্দিন খান : বাংলাদেশের জন্য চাপ অনুভব করাটা খুবই স্বাভাবিক। তবে ভয়ের কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে যারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করছে, তাদের জন্য এটি একটি উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে তৈরি হবে। এসবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ভারতবিরোধীরা আরও শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
জাগো নিউজ : এ বিরোধিতায় ভারতের কিছু আসে-যায় কি?
তানজিম উদ্দিন খান : প্রশ্নটা এখানেই। ভারত নিজেদের এখন বিশ্বশক্তি মনে করছে। কিন্তু বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করতে হলে শুধু শক্তি দিয়ে হয় না। মানুষের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ। ভারত প্রতিবেশীর সেই সমর্থন অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, ভারত যত বেশি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত হবে, বাংলাদেশ-পাকিস্তানও তত বেশি মুসলমান রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
এমন রাজনীতির মধ্য দিয়েই আল-কায়েদা, আইএসএ’র মতো উগ্রবাদী সংগঠনগুলো একপ্রকার নৈতিক সমর্থন আদায় করার ক্ষেত্র পাবে। ভারত নিজেই দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বিপদ তৈরি করছে।
এএসএস/এনডিএস/এমএস