বিদ্যুতের চাহিদা নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করছে সরকার
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপনা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। শিক্ষকতার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী সকল প্রকার নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সক্রিয়। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করে যাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন।
গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর। দীর্ঘ আলোচনায় অর্থনীতি, জ্বালানি ও উন্নয়নের নানা অসঙ্গতির কথা তুলে ধরেন। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে দ্বিতীয়টি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
আরও পড়ুন >> গ্যাসের সংকট বাড়াতেই নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে বাপেক্সকে
জাগো নিউজ : আগের পর্বে জ্বালানি নীতির সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে তো জ্বালানিতে সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। বিশেষ করে বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়টি তো অস্বীকার করা যায় না?
আনু মুহাম্মদ : বিদ্যুতের উৎপাদন তো বাড়ছেই। তবে চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। প্রশ্ন হচ্ছে, বিদ্যুতের উৎপাদন পদ্ধতি নিয়ে। গণমানুষের ভাবনা না করে বিদ্যুতের খরচ বাড়ানো, মানুষের জীবন-জীবিকা ধ্বংস করার মতো বড় বড় বিপদ কেন হাজির করছে সরকার?
বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলে সরকার রেন্টাল-কুইক রেন্টালের মাধ্যমে যে বোঝা তৈরি করেছে, তা শুধু পরিবেশগত ক্ষতি নয়, বিশাল এক আর্থিক চাপও তৈরি করেছে।
পেট্রোবাংলা ও পিডিবি’র যে দেনা তৈরি হয়েছে, তা রেন্টাল-কুইক রেন্টালের কারণেই। অনেক কোম্পানি উৎপাদন না করেই টাকা নিয়েছে। রেন্টাল-কুইক রেন্টালে তেল নিয়েও অনেক জালিয়াতি হচ্ছে।
আর্থিক ক্ষতির বাইরে আরেকটি দিক আছে। বিদ্যুৎ খাত নিয়ে ২০৪১ সালের জন্য যে মাস্টার প্ল্যান নেয়া হয়েছে সেখানে পরিবেশের সর্বনাশ হবে। উপকূলজুড়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নেয়া হয়েছে। রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হচ্ছে। বিদ্যুতের চাহিদা কাজে লাগিয়ে সরকার ব্লাকমেইল করছে।
আরও পড়ুন >> উন্নতি চাইলে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি মেনে নিতে হবে
সরকার বলতে চাইছে, আমি তোমার বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করে দিচ্ছি। সুতরাং আমি যদি তোমার শ্বাস বন্ধ করে দেই, গুম করি, তোমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যদি পঙ্গু করে দেই তবে তুমি কিছুই বলতে পারবে না।
জাগো নিউজ : যেকোনো উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাবও আছে। পরিবেশগত ক্ষতি কিছুটা মানতেই হয়…
আনু মুহাম্মদ : মানুষের নিঃশ্বাস বন্ধ না করেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব এবং আমাদের দর-কষাকষি মূলত এখানেই। বিদ্যুৎ আমাদের প্রয়োজন। কিন্তু সরকার যে প্রক্রিয়ায় উৎপাদন করছে, তা হচ্ছে ঋণনির্ভর, কোম্পানিনির্ভর এবং পরিবেশ বিধ্বংসী।
পরিবেশ ধ্বংস না করে, ঋণ না নিয়ে এবং জাতীয় সক্ষমতার ভিত্তিতে বিদ্যুতের সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে রামপাল কেন্দ্রে। কিন্তু এখানে যে ক্ষতিটা হবে তার কোনো তুলনা হয় না। কারণ, আরেকটি সুন্দরবন তৈরি করা সম্ভব নয়। সুন্দরবনের কী ক্ষতি হবে তা বিভিন্ন গবেষণায়, ব্যাখ্যায় উঠে এসেছে। অথচ সরকার তা আমলে না নিয়ে একাধারে বলেই যাচ্ছে, সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না।
ভারতের যে কোম্পানি রামপালে এসেছে, সেই ভারত বন থেকে ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে পারবে না বলে আইন করেছে। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কা এমন একটি প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছে। কয়েক দিন আগে কেনিয়াও চীনের কয়লাভিত্তিক একটি কোম্পানির চুক্তি বাতিল করে দিয়েছে।
যদি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন লাভজনক হতো তাহলে চীন ও ভারত এখান থেকে সরে আসত না। তারা ব্যাপকভাবে কয়লাভিত্তিক প্রকল্প থেকে সরে আসছে। অথচ তাদের বেকার হয়ে যাওয়া জনবল, পরিত্যক্ত প্রযুক্তি, উদ্বৃত্ত কয়লা নিয়ে সেসব দেশে হাজির হচ্ছে, যেসব দেশের সরকারের জনস্বার্থ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। কেনিয়ার মতো দেশ চীনের কোম্পানিকে বাতিল করে দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশে এসে তারা খুব আরাম পাচ্ছে। কারণ, জনস্বার্থ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কোনো ধরনের মাথাব্যথা নাই।
আরও পড়ুন >> ভারতীয়রাই নিয়ে যাচ্ছে ১০ বিলিয়ন ডলার : ফখরুল
সুন্দরবনে পাঁচটি সিমেন্ট কারখানার অনুমোদন দেয়া হয়েছে, অথচ পরিবেশমন্ত্রী বলছেন, এতে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। এমন ব্যক্তিকে পরিবেশমন্ত্রী করা হয়েছে, যার মধ্যে পরিবেশ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নাই, নতুবা তিনি জেনেশুনেই এমন কথা বলছেন। কারণ তিনিও জানেন সিমেন্ট কারখানার কারণে শীতলক্ষ্যা নদীর কী সর্বনাশ করা হলো!
পরিবেশ, মানুষ মুখ্য নয়; চীন, রাশিয়া, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবসার জায়গা করে দিতেই সরকার মরিয়া। সরকার জিম্মি দেশীয় বহুজাতিক কোম্পানির কাছেও।
ইউনেস্কো সুন্দরবন নিয়ে কথা বলছে। অথচ সরকারের মধ্যে পরিবেশগত প্রতিরক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব পেলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ নিয়ে কোনো আলোচনা হওয়ার কথা নয়। আমাদের আন্দোলনে যাওয়ার কথা নয়। সরকারের নিজেই বাতিল করে দেয়ার কথা।
জাগো নিউজ : বিকল্প কী হতে পারে?
আনু মুহাম্মদ : আমরা ২০১৭ সালে জ্বালানি নিয়ে অল্টারনেটিভ (বিকল্প) মাস্টার প্ল্যান দিয়েছি সরকারের কাছে। জনগণের সামনেও প্রকাশ করেছি। আমরা প্রথমত, জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলেছি। দ্বিতীয়ত, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর যেসব লবিস্ট দিয়ে মন্ত্রণালয় চলে, সেটাকে বাতিল করতে বলেছি।
আমরা দেখিয়েছি, গ্যাস অনুসন্ধান যদি ঠিক মতো করা যায়, তাহলে বিদ্যুতের যে চাহিদা, তার শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ পূরণ হবে গ্যাস থেকে। বাকি অংশের বড় চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে সৌরবিদ্যুৎ থেকে।
এক লাখ কোটি টাকার বেশি খরচ করা হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে। সেখানে মাত্র দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে। অথচ এ টাকায় প্রায় ১০ গুণ বেশি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
আরও পড়ুন >> সম্মানিতে সংসার চলে, বেতন থাকে ব্যাংকে
রাশিয়া যে প্রযুক্তি নিয়ে রূপপুরে এসেছে, তা পৃথিবীর অন্য জায়গায় বাতিল বলে বিবেচ্য। রাশিয়ার ঋণ, প্রযুক্তি, জনবল দিয়ে তারাই লাভবান হচ্ছে।
অনেকেই যুক্তি দেন, ভারত পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। আমাদেরও পারমাণবিক শক্তি অর্জন করতে হবে। তাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দেখভালের দায়িত্ব ভারতকেই দেয়া হয়েছে। তার মানে, এটি ভারত ও রাশিয়ার প্রকল্প। শেষ পর্যন্ত এর কর্তৃত্ব থাকবে ভারতের হাতেই।
পারমাণবিক সক্ষমতা হচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়। অথচ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা নিয়ে জনগণ কিছুই জানেন না। পাবনার একেবারে জনবহুল জায়গায় এ বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে।
জাগো নিউজ : মুনাফার বাইরে এসব প্রকল্পে ভারতের আর কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?
আনু মুহাম্মদ : ভারত খুব কৌশলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় প্রবেশ করছে। যদিও সরকার নিজ থেকেই ভারতকে উজাড় করে দিচ্ছে। চীন, রাশিয়া ব্যবসার দিক বিবেচনা করেই বাংলাদেশে শক্তির বিকাশ ঘটাতে চায়।
যে যা চাইছে, বাংলাদেশ তা-ই দিচ্ছে। ভারত ব্যবসার পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনীতিও নিয়ন্ত্রণ করছে। নানা কৌশলেই ভারত তার আগ্রাসী নীতির প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। ট্রানজিট দেয়া হলো ভারতকে, অথচ বাংলাদেশের মানুষকে কিছুই জানানো হলো না।
ভারত বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও নিরাপত্তায় জাল ফেলছে। চীন বাংলাদেশে বিপুল ঋণ নিয়ে আসছে, যা বাংলাদেশ ফিরিয়ে দিতে পারছে না। কয়েক গুণ বেশি ব্যয়ে চীন বিনিয়োগ করছে, যার কমিশন বাংলাদেশের লবিস্টরাও পাচ্ছে। রাশিয়া গ্যাজপ্রম দিয়ে বাপেক্সকে পঙ্গু করে গেল। আর যুক্তরাষ্ট্র তো বঙ্গোপসাগরে কর্তৃত্ব দখলে গোপনে-প্রকাশ্যে নানা চুক্তি করে রেখেছে।
এর বাইরে জাপানের মতো দেশও বাংলাদেশে প্রভাব রাখছে। তারা নিজ নিজ স্বার্থে বাংলাদেশকে ভাগ-বাটোয়ারার জায়গায় ফেলে স্বার্থ হাসিল করছে। তাদের লেজ আছে, সাব-কন্ট্রাক্টর আছে এ দেশে। সরকারের আচরণে তারা সবাই খুশি। রাজনৈতিকভাবে, গণমাধ্যমে, বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকে বিশেষ সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, যারা এসব সমর্থন করেন নতুবা নীরব থাকেন।
আরও পড়ুন >> দেরি চীনা ব্যাংকের, ৬৬৫ কোটি গচ্চা বাংলাদেশের!
সুতরাং শুধু বিদ্যুতের সমস্যা সমাধানের জন্য ওইসব দেশকে সরকার ডেকে আনছে, তা নয়। নীতিগতভাবে ওইসব দেশের স্বার্থ টিকিয়ে রাখা, কমিশন ভোগ করা এবং দেশকে নয়া উদারীকরণের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
আর দেশীয় কোটিপতি, ঋণখেলাপিদের মুনাফার স্বার্থরক্ষার্থে বন, নদী, পাহাড়, জীবন-জীবিকা ধ্বংস করে হলেও প্রকল্প করতে হচ্ছে। সত্য ঢাকতে বিজ্ঞাপনী উন্নয়ন মূলত প্রচার মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে।
এএসএস/এমএআর/এমএস