ফৌজদারি অপরাধ আমলে নেয়ার ক্ষমতা চাইবেন ডিসিরা

মাসুদ রানা
মাসুদ রানা মাসুদ রানা , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪:৪২ পিএম, ১১ জুন ২০১৯

ফৌজদারি অপরাধ আমলে নিয়ে সংক্ষিপ্ত বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষমতা চাইবেন জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর প্রথম ডিসি সম্মেলনে এ প্রস্তাব উঠছে। আগামী ১৪ থেকে ১৮ জুলাই জেলা প্রশাসক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।

ইতোমধ্যে বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসকরা সম্মেলন সামনে রেখে তাদের প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছেন। প্রস্তাবগুলো সমন্বয় করে সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে জেলা প্রশাসকরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধ স্বীকার না করলে শাস্তি দিতে পারেন না তারা। পটুয়াখালী, মেহেরপুর, রাজশাহী, গাজীপুর, সিলেটসহ কয়েকটি জেলার জেলা প্রশাসকরা ফৌজদারি অপরাধ আমলে নেয়ার ক্ষমতা চেয়েছেন। ২০০৭ সালে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা হওয়ার আগে এ ক্ষমতা ছিল ডিসিদের।

বিগত বছরের ডিসি সম্মেলনগুলোতে ফৌজদারি অপরাধ আমলে নেয়াসহ বিচারিক ক্ষমতা চেয়ে আসছিলেন জেলা প্রশাসকরা। এবারও তারা সেই প্রস্তাব তুলে ধরবেন বলে জানা গেছে।

সরকারের নীতিনির্ধারক ও জেলা প্রশাসকদের মধ্যে সামনা সামনি মতবিনিময় এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য প্রতি বছর ডিসি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডিসি সম্মেলনের প্রস্তুতি চলছে। ডিসিদের পাঠানো সুপারিশগুলো সমন্বিত করা হচ্ছে।’

এবার জেলা প্রশাসক সম্মেলনে প্রথমবারের মতো প্রধান বিচারপতি, তিন বাহিনীর প্রধান ও জাতীয় সংসদের স্পিকারের সঙ্গেও জেলা প্রশাসকদের বৈঠক হবে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জেলা ও মাঠপ্রশাসন অনুবিভাগ) আ. গাফ্ফার খান বলেন, ‘ডিসি সম্মেলনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে ১৮ জুন একটি মিটিং করব আমরা।’

পটুয়াখালীর ডিসি মো. মতিউল ইসলাম চৌধুরী প্রস্তাবে লিখেছেন, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারভুক্ত এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটদের বেআইনি সমাবেশ প্রতিহত করা, অবৈধ দখল উচ্ছেদ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণসহ ‘মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯’ তফসিলভুক্ত ১০৪টি আইনে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হয়। মোবাইল কোর্টের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবগত অপরাধীরা প্রায়শই দোষ স্বীকার না করায় তাদের মোবাইল কোর্টের আওতায় বিচার করা যায় না। ফলে সাধারণ মানুষ ভুক্তভোগী হন এবং তাৎক্ষণিক ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন।

‘জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংস্থার পরিচালিত মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অপরাধ প্রতিরোধে উত্তরোত্তর সফলতা বর্তমানে দেশের সর্বস্তরের জনগণ ও সুশীল সমাজ স্বীকার করে। এ বিষয়ে নিয়মিত পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ইতিবাচক সংবাদ প্রচারিত হয়। এমনকি মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন মামলার রায়ে মোবাইল কোর্টের ইতিবাচক দিক সম্পর্কে সদয় পর্যবেক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের অপরাধ আমলে নেয়া ও সংক্ষিপ্ত বিচারের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষমতা প্রদান করা হলে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অপরাধ নির্মূল সহজতর হবে।’

বিগত জেলা প্রশাসক সম্মেলনে বিষয়টি উত্থাপিত হলে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণের দিকনির্দেশনা দেন বলে সেসময় সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রচারিত হয়। ওই নির্দেশনার ধারাবাহিকতায় এবারের সম্মেলনে প্রস্তাবটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা যেতে পারে বলেও প্রস্তাব দেন পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক।

তিনি ফৌজদারি কার্যবিধির বিধি ১৯০ এর ৪ নম্বর উপবিধি বাতিল করে ১ নম্বর উপবিধি সংশোধন করে ‘ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট অ্যান্ড এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট’ যুক্ত করার সুপারিশ করেন।

মেহেরপুরের ডিসি মো. আতাউল গনি তার প্রস্তাবে উল্লেখ করেন, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ফলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা তাৎক্ষণিকভাবে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারায় অপরাধ আমলে নিতে পারছেন না। ফলে মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, অবৈধ দখল উচ্ছেদ, সরকারি সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ, সন্ত্রাস ও দুর্নীতি দমন, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ, জনজীবনে শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখা, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড সমন্বয় সাধন, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণ, পাবলিক পরীক্ষা তদারকি, নিরাপদ সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং ভেজাল বিরোধী কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা সম্ভব হচ্ছে না।

আইন ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধ আমলে নিতে না পারলে এবং বিচারের জন্য (রেডি ফর ট্রায়াল) প্রস্তুত করার প্রয়োজনীয় ক্ষমতা না থাকায় ফৌজদারি কার্যবিধির ৬৪ ও ৬৫ ধারায় গ্রেফতারের ক্ষমতার কোনো কার্যকারিতা থাকে না।

বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ বিদ্যমান না থাকায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকালে এবং পুলিশ বাহিনী পরিচালনাকালে যথাযথ সহযোগিতা ও মনোযোগের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। ফলে মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ সার্বিক কার্যক্রমে একধরনের সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়।

মেহেরপুরের ডিসি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারায় অপরাধ আমলে নেয়ার মতামতসহ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯২ ধারা এবং মামলা বিচারের জন্য প্রস্তুত (রেডি ফর ট্রায়াল) করতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৫, ১৫৬, ১৫৯, ১৬৪, ১৬৭, ১৯৫-১৯৯, ২০০-২০৪ ধারায় ক্ষমতা প্রদানের সুপারিশ করেন।

জেলা প্রশাসকদের নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের মনোগ্রাম-সম্বলিত বিশেষ পতাকা গাড়িতে ব্যবহারের অনুমতি চান ডিসিরা।

একই সঙ্গে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের জন্য ঝুঁকিভাতা প্রদান, মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে সার্বক্ষণিক এক প্লাটুন পুলিশ ন্যস্ত করা, জেলা প্রশাসকদের স্বেচ্ছাধীন তহবিলে বরাদ্দ বাড়ানো, ইনোভেশনের জন্য জেলাপর্যায়ে বরাদ্দ প্রদান এবং জেলা প্রশাসনের অধীন প্রকৌশল ইউনিট গঠনের সুপারিশ করেন তারা।

জেলা প্রশাসকরা শিক্ষার মানোন্নয়নসহ বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে মোট অর্ধশত প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রত্যেক জেলায় একটি করে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন, পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র বহনের জন্য প্রত্যেক জেলায় নিজস্ব একটি কাভার্ডভ্যান দেয়া, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বিচারে বেসরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজের অনুমোদন এবং বিএড ডিগ্রির লাগাম টানা, দেশের চরাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষাদানের জন্য স্থানীয়ভাবে চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ, কিন্ডারগার্টেন ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন আরও সহজ করা, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিউশন ফির জন্য নীতিমালা প্রণয়ন, উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষার মান যাচাইয়ের জন্য জেলা শিক্ষা কমিটি গঠন ইত্যাদি।

আগের বছরগুলোতে জেলা প্রশাসক সম্মেলন তিন দিনব্যাপী হলেও এবার সম্মেলন হবে পাঁচ দিনব্যাপী।

রেওয়াজ অনুযায়ী, জেলা প্রশাসক সম্মেলন চলাকালে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সিনিয়র সচিব, সচিবরা বিভিন্ন অধিবেশনে উপস্থিত থেকে জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারদের উপদেশ ও দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জানা গেছে, বরাবরের মতো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সম্মেলন উদ্বোধন হবে। উদ্বোধনের পর মুক্ত আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী মাঠ প্রশাসন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে শুনবেন এবং নির্দেশনা দেবেন।

এছাড়া সম্মেলনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও দিকনির্দেশনা গ্রহণ করবেন জেলা প্রশাসকরা। এটা হবে বঙ্গভবনের দরবার হলে।

সম্মেলনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা বিভিন্ন কার্য অধিবেশনে জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেবেন। অধিবেশনগুলো হবে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে। কার্য অধিবেশনগুলোতে সভাপতিত্ব করবেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

আরএমএম/এমএআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।