বাজেট পদ্ধতির পরিবর্তন জরুরি

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৫৫ পিএম, ০৬ মে ২০১৯

ড. আকবর আলি খান। বিশিষ্ট অর্থনীতি ও শিক্ষাবিদ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব। অধ্যাপনা করছেন বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ও উন্নয়নের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর। উন্নয়ন নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করলেও নানা চ্যালেঞ্জের কথাও তুলে ধরেন।

সুশাসন ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকায় দেশের অর্থনীতি হুমকির মুখে আছে; একই প্রশ্নে সামাজিক অস্থিরতাও বাড়ছে বলে অভিমত প্রকাশ করেন। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি

জাগো নিউজ : উন্নয়ন অর্থনীতির অন্যতম আলোচনা ‘রাষ্ট্রীয় বাজেট’। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের পথে বাংলাদেশ। বাজেটের স্বরূপ আলোচনায় আপনার অভিমত জানতে চাই?

আকবর আলি খান : বাংলাদেশের সংবিধানের মূল ভিত্তি হলো গণপ্রতিনিধিদের সম্মতি ছাড়া কোনো কর আরোপ করা যাবে না। সরকারের সব আয় ও ব্যয়ে সংসদের অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশে আমরা এমন পদ্ধতি চালু করেছি, যেখানে সংসদে অর্থবহ অংশগ্রহণ সম্ভব হয় না। কেন হয় না, সেটা পরের আলোচনা।

আগামী ১৩ জুন সংসদে প্রস্তাবিত বাজেট (২০১৮-১৯ অর্থবছর) পেশ হবে। ৩০ জুনের মধ্যে বাজেট অনুমোদন দেয়া হবে। অর্থাৎ বাজেট আলোচনা হবে মাত্র ১৭ দিন। সংবিধানে আছে, ৩০ জুনের মধ্যে বাজেট অনুমোদন না হলে তিন মাসের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে আলোচনা প্রলম্বিত করা যাবে। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের নজির নেই বললেই চলে।

জাগো নিউজ : তার মানে ১৭ দিন বাজেট আলোচনা যথেষ্ট নয় বলতে চাইছেন?

আকবর আলি খান : ১৭ দিনের মধ্যে গত বছরের সম্পূরক বাজেট নিয়ে আলোচনা হবে, বর্তমান অর্থবছরের বাজেট নিয়ে আলোচনা হবে। কর প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হবে। নানা বিল অনুমোদন দেয়া হবে। বিস্তর আলোচনার দরকার পড়ে। এ বছর রোজার মধ্যে বাজেট অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্বের কোনো দেশেই এত অল্প সময়ের মধ্যে বাজেট অনুমোদন দেয়া হয় না।

জাগো নিউজ : বাজেট আলোচনায় সময়ের স্বল্পতার কথা বললেন। বাজেটে আর কোন কোন দুর্বলতার কথা গুরুত্ব দেবেন?

আকবর আলি খান : সংসদে অর্থবহ কোনো বিরোধী দল নেই। কাগজে-কলমে সংসদে বিরোধী দল আছে। কিন্তু নানা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সরকারের নেতিবাচক সিদ্ধান্তের সমালোচনা করার মতো বিরোধী দল সংসদে নেই। সুতরাং সংসদে কোনো অর্থবহ আলোচনাও হবে না। এটি বাজেট আলোচনার অন্যতম দুর্বলতা বলে মনে করি।

তৃতীয়ত, সংসদীয় কমিটিগুলোতে বাজেট নিয়ে আলোচনার কোনো বিধান নেই। অন্যান্য সংসদীয় শাসনব্যবস্থার দেশগুলোতে আলোচনা করার বিধান রয়েছে। ইংল্যান্ড, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, কানাডায় এ ধরনের বিধান ছিল না। কিন্তু ওইসব দেশে তাদের কার্যপ্রণালিতে পরিবর্তন এনে সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হওয়ার পরে সংসদে আলোচনা হয়। বাংলাদেশের কার্যপ্রণালি যে বিধি রয়েছে, তাতে সংসদীয় কমিটিতে বাজেট নিয়ে আলোচনা করার কোনো সুযোগ নেই। ফলে কমিটিগুলো কোনো অর্থবহ ভূমিকা রাখতে পারে না সংসদে।

সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে অর্থমন্ত্রী যে বাজেট পেশ করেন সেটিই কার্যকর হয়। এ বাজেটে জনগণের অংশগ্রহণ অত্যন্ত সীমিত। এ ব্যবস্থা আজকের নয়। শুরু থেকেই এ পদ্ধতি চলে আসছে।

সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে বাজেট পদ্ধতির পরিবর্তন জরুরি। গণতান্ত্রিক অধিকার দৃঢ়তর ভিত্তিতে স্থাপন করা না গেলে বাজেটে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাবে না।

জাগো নিউজ : ১৭ দিনে বাজেট অনুমোদন হলেও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর তো আলোচনা করার কথা আগে থেকেই…

আকবর আলি খান : সরকার কার সঙ্গে আলোচনা করল, সেটা দেখার বিষয় নয়। জনগণকে বাজেট আলোচনায় অংশ নেয়ার ব্যবস্থাই রাখা হয়নি। চেম্বার অব কমার্সের সঙ্গে আলোচনা করে মাত্র, তবে সেটা কর আরোপ নিয়ে। ব্যবসায়ীরা সব কর তুলে দেয়ার আহ্বান জানান। সরকার ব্যবসায়ীদের কিছু কথা শোনে, কিছু শোনে না। এসব আলোচনার আইনগত কোনো ভিত্তিও নেই। আমি মূলত এ দুর্বলতার কথাই বলতে চাচ্ছি।

জাগো নিউজ : আপনি বাংলাদেশের বাজেট পদ্ধতির তিনটি প্রধানতম দুর্বলতার কথা উল্লেখ করলেন। তাহলে বাজেটের এ বিশাল আয়োজনের অর্থ কী দাঁড়ায়?

আকবর আলি খান : বাজেট এখন সাংবিধানিক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। বিশ্বের অন্যান্য সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় বাজেট পাসে যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, সেই অনুপাতে আমাদের পদ্ধতি অত্যন্ত দুর্বল।

দিন দিন বাজেটের আকার বিশাল হচ্ছে। এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কারণ জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, মূল্যস্ফীতিও বাড়ছে।

জাগো নিউজ : মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ে তার চেয়ে অধিক হারে বাজেট বাড়ে। এর কারণ কী?

আকবর আলি খান : এর কারণ হচ্ছে বিশাল ঘাটতি বাজেট। সরকার ধার করে বাজেটের অর্থায়ন করে। করের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়, তা অর্জিত না হওয়ায় ঘাটতি পূরণে সরকারকে ধার করতে হয়।

এ কারণেই আমি বলে আসছি, মূল বাজেট হচ্ছে ধারণাগত। এটিকে কোনোভাবেই প্রকৃত বাজেট বলা যাবে না। সম্পূরক বাজেট তৈরি হলেই কেবল প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রে তা হয় না।

বাজেট পদ্ধতিতে অসঙ্গতির কারণেই আয় ও ব্যয়ের মধ্যে কোনো মিল নেই। আর ঘাটতি বাজেটের যে নেতিবাচক প্রভাব তার দায় বর্তাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর।

জাগো নিউজ : অনেক দেশেই ঘাটতি বাজেট হয়…

আকবর আলি খান : ঘাটতি বাজেট খারাপ নয়, যদি মূলধন বিনিয়োগের প্রসঙ্গ থাকে। অবকাঠামো নির্মাণের জন্য যদি ঘাটতি বাজেট হয়, তাহলে ওই বাজেট খারাপ হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে এখন রাজস্ব বাজেটের বরাদ্দ এত পরিমাণ বেড়েছে যে, বিনিয়োগের পরিবর্তে ঘাটতি বাজেট থেকে রাজস্ব ব্যয় বাড়াতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতি ভবিষ্যৎ অর্থনীতির জন্য ভালো ফল আনবে না। সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন আছে।

জাগো নিউজ : অবকাঠামো উন্নয়নের কথা বলছে সরকার। বড় বড় প্রকল্পও দৃশ্যমান করতে চাইছে…

আকবর আলি খান : অবশ্যই বড় বড় প্রকল্পের দরকার রয়েছে। কিন্তু সেই প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে বাছাই করা হচ্ছে কিনা- তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। আবার এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। আমরা দেখেছি, প্রায় প্রতিটি প্রকল্পের সময়সীমা বেড়ে যাচ্ছে এবং এতে প্রকল্পের ব্যয় বাড়াতে হচ্ছে। প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানোর জন্য অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে। এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে।

জাগো নিউজ : নানা চ্যালেঞ্জ থাকলেও বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত হচ্ছে। আশাবাদ ব্যক্ত করছে বিভিন্ন বিশ্ব সংস্থাও। এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

আকবর আলি খান : দেশের বর্তমান উন্নয়ন সন্তোষজনক। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অর্থনীতি অত্যন্ত দুর্বল ছিল। তখন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে তলাবিহীন রাষ্ট্র।’

আজ বাংলাদেশের সে অবস্থা নেই। তবুও দেশের অর্থনীতির অনেক দুর্বলতা রয়েছে।

জাগো নিউজ : যদি ব্যাখ্যা করতেন?

আকবর আলি খান : আমাদের অর্থনীতির অন্যতম দুর্বলতা দিক হচ্ছে পরিবেশগত অবনতি। দেশের নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। অপরিকল্পিত শিল্পায়নের ফলে বিষ ছড়াচ্ছে। এমন পরিবেশে ১৭ কোটি মানুষের স্বাভাবিক ও সুস্থতার সঙ্গে বসবাস নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জের বলে মনে করি।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন করলেই চলে না, যদি মানুষের জীবনযাপন ব্যাহত হয়। এ কারণেই অত্যন্ত শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামো দাঁড় করানো প্রয়োজন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, সেই উদ্যোগ কোনো রাজনৈতিক দল নিতে পারেনি।

দ্বিতীয়ত, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ থমকে গেছে। সরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে। কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না। সরকারি বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধি হলেও সেই অনুপাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। দেশের জনসংখ্যায় তরুণদের প্রাধান্য রয়েছে। তরুণরা চাকরি না পেলে তো সঙ্কটের আশঙ্কা থেকে যায়।

এ সমস্যাগুলো সমাধানে আমরা এখনও কোনো উদ্যোগ নিতে দেখিনি। আমরা বলছি, বিরাট অর্জন করে ফেলছি। কিন্তু এ ‘বিরাট’ আসলে কতটুকু, তা তলিয়ে দেখা দরকার।

জাগো নিউজ : চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমরা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশেও গেলাম বটে...

আকবর আলি খান : সার্কভুক্ত দেশগুলোর দিকে তাকান। এখনকার ছয়টি দেশই নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। শুধু নেপালকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা দেয়া হয়নি। সার্কের নিম্ন-মধ্যম আয়ের ছয়টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সবশেষে যুক্ত হয়েছে।

এ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে যেতে হলে আমাদের অর্থনীতিকে আরও সুদৃঢ় করতে হবে। যদি উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে যেতে না পারি, তাহলে আমাদের জন্য সেটি বড় ট্র্যাজেডি হবে।

এএসএস/এমএআর/পিআর

সরকারের নেতিবাচক সিদ্ধান্তের সমালোচনা করার মতো বিরোধী দল সংসদে নেই। সুতরাং সংসদে কোনো অর্থবহ আলোচনাও হবে না। এটিই বাজেট আলোচনার অন্যতম দুর্বলতা

বাংলাদেশের কার্যপ্রণালি যে বিধি রয়েছে, তাতে সংসদীয় কমিটিতে বাজেট নিয়ে আলোচনা করার কোনো সুযোগ নেই। ফলে কমিটিগুলো কোনো অর্থবহ ভূমিকা রাখতে পারে না

গণতান্ত্রিক অধিকার দৃঢ়তর ভিত্তিতে স্থাপন করা না গেলে বাজেটে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যাবে না

মূল বাজেট হচ্ছে ধারণাগত। এটিকে কোনোভাবেই প্রকৃত বাজেট বলা যাবে না। সম্পূরক বাজেট তৈরি হলেই কেবল প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়

অবশ্যই বড় বড় প্রকল্পের দরকার রয়েছে। কিন্তু সেই প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে বাছাই করা হচ্ছে কিনা- তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে

সরকারি বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধি হলেও সেই অনুপাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। তরুণরা চাকরি না পেলে তো সঙ্কটের আশঙ্কা থেকে যায়

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।