মেধা-যোগ্যতায় কর্মক্ষেত্রে সফল নারীরা

জসীম উদ্দীন
জসীম উদ্দীন জসীম উদ্দীন , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৪৪ পিএম, ০৭ মার্চ ২০১৯

নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে নারীদের। সেই সঙ্গে বদলাচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গিও। যে কারণে নারীরা এখন রাষ্ট্র, সমাজ কিংবা পরিবারের বোঝা নয়। তুলনা করলে হয়তো কর্মক্ষেত্রে এখনো পুরুষের তুলনায় নারীদের সংখ্যা কম হতে পারে কিন্তু যোগ্যতায়, মেধায় স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে নারীরা দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। সফলতার মানদণ্ডেও বেশ এগিয়ে নারীরা।

বৃহস্পতিবার (৭ মার্চ) সকালে নিজ কার্যালয়ে জাগো নিউজের মুখোমুখি হয়ে এসব কথা বলেন বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক শাখার বিশেষ পুলিশ সুপার রোমানা আক্তার।

মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের এ কৃতি সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৭ সালে প্রাণিবিদ্যায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে একটি কর্পোরেট হাউসে বছরখানেক চাকরি করেন। এরপর ২০তম বিসিএস দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন তিনি।

১৫ মাস যোগ্যতা ও সফলতার সঙ্গে জাতিসংঘ মিশনে শান্তিরক্ষী বাহিনীতেও কাজ করেছেন। গেল পুলিশ সপ্তাহে পেয়েছেন পিপিএম সেবা পুরস্কার। শুধু তাই নয়, পুলিশ দম্পতি হিসেবে তাদের স্বামী-স্ত্রীর খ্যাতি রয়েছে। তার স্বামী সুনামগঞ্জের এসপি। তিনিও এবার পেয়েছেন বিপিএম সেবা পুরস্কার।

সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে সিআইডির ফরেনসিক শাখার দায়িত্ব পালন করছেন রোমানা আক্তার। ৮ মার্চ নারী দিবস উপলক্ষে সাক্ষাৎকারে নারী উন্নয়ন, কর্মক্ষেত্রে নারীদের যোগ্যতা, বৈষম্য, পদায়ন, অধিকার ও মর্যাদা, পুলিশে নারীদের অগ্রগামিতা ও নারীদের এগিয়ে যাওয়ার কথা ব্যক্ত করেন এ পুলিশ কর্মকর্তা। জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো :

জাগো নিউজ : কেমন আছেন?

রোমানা আক্তার : জ্বি, ভালো আছি।

জাগো নিউজ : নারী দিবস আসে যায়, দিবসেই কি নারীর বৈষম্য কমানো কিংবা তাদের সফলতার চিত্র বোঝা যায়? আপনার কি মনে হয়?

রোমানা আক্তার : আমি আসলে দিবসে খুব বেশি খুশি নই। আমার কাছে তো মনে হয় এ দিবসটাই দেখিয়ে দিচ্ছে সমাজে মানুষের মধ্যে জেন্ডার বিভেদ আছে। কর্মে নারী ও পুরুষকে বিভেদ করে দেখা হচ্ছে। আসলে কিন্ত তা নয়। কর্মতো যোগ্যতার বিষয়। সেখানে নারী কি পুরুষ, সেটা বিবেচ্য নয়। কখনো বৈষম্য করে কাউকে আটকে রাখা যায় না।

জাগো নিউজ : খুব কাছ থেকে দীর্ঘদিন ধরে নিজ বাহিনীতে নারীর অবস্থা পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। কী মনে হয়, পুলিশে নারীদের অগ্রগতি হয়েছে?

রোমানা আক্তার : নারীদের প্রশিক্ষণের জন্য যে ধরনের কারিকুলাম থাকা দরকার আমাদের সময় তার ঘাটতি ছিল। কিন্তু ট্রেনিংয়ের ক্ষেত্রে নারীরা কখনো পিছিয়ে ছিল না। তবে শুধু একটি সেশনে কনসিডার করা হয়েছিল। কিন্তু সেই সুযোগ নিতে গিয়ে আমরা বরং ভোগান্তিতে পড়েছিলাম। আমাদের ১১ জনের মধ্যে ১০ জনকেই অনুপস্থিত দেখানো হয়। সেটা কাভার করতে গিয়ে ৬ মাস বেশি ট্রেনিং করতে হয়েছিল। হয়তো ওইটা একটা অভিজ্ঞতা বটে। কারণ এরপর আর কোনো নারীকে ট্রেনিং সেশনে বিশেষ সমস্যায় পড়তে হয়নি। এখন সমান তালে কাজ করে চলেছে নারীরা। নারীদের নিয়োগ শুরু হওয়ার পর সরকারের আস্থার প্রতিদান দিয়েছে নারী পুলিশ সদস্যরা। এখন আর এটা বলার সুযোগ নেই নারীরা পারবে না। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মানসিকতা অর্জন করেছে নারীরা। সেটার প্রমাণ তো স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে গেলে পাবেন।

SP-ROMANA-1

জাগো নিউজ : নারীদের সম-অধিকার ও মর্যাদা পাওয়ার ক্ষেত্রে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে আপনি কতোটা দায়ী করবেন?

রোমানা আক্তার : দেখুন আমার পরিবারের তিন বোন এক ভাই। আমরা সবাই প্রতিষ্ঠিত। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার। এটা হতো না, যদি পরিবার বাধা দিত। আর পরিবার যদি সহযোগিতা করে তবে কোনো বাধাই বাধা নয়। সেটা আমি পেয়েছি। আমার মতো এখন অসংখ্য নারীই পাচ্ছে। আমার স্বামীও পুলিশে আছেন। তিনিও এসপি। তবে কখনো তার কারণে কিংবা বাবার কারণে আমি বাধার মুখোমুখি হয়নি। তবে বাধা তো আছেই। আমি হয়তো বাধার মুখোমুখি হইনি। কিন্তু সব পরিবার এক নয় বলেই নারীরা এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে আসেনি। সেটার পরিবর্তন জরুরি তো বটেই।

জাগো নিউজ : পুলিশে কি নারী কর্মকর্তারা মেধা-যোগ্যতার সঠিক প্রতিফলন ঘটাতে পারছেন? অবস্থানগত বা মর্যাদায় কি কোনো বাধা আছে?

রোমানা আক্তার : যোগ্যতা ও মেধা নারীর যথেষ্ট রয়েছে। নারীদের পিছিয়ে থাকার ক্ষেত্রে বাধা তো নারীর মানসিকতাই। সেটারও পরিবর্তন ঘটছে। আমাকে কর্মকর্তা হিসেবেই ট্রিট করা হচ্ছে, নারী হিসেবে নয়। সুতরাং যোগ্যতাটাই এখানে মুখ্য। নারী কী পুরুষ তা বিবেচ্য নয়। আমাকে যদি নারী হিসেবেই মূল্যায়ন করতে চান তবে দেখবেন অনেক পুরুষের তুলনায় আমি বেশি কাজ করছি। মুখের কথায় নয়; কাজেই সেটার প্রমাণ দিয়েছি। নারী কিংবা পুরুষের বিভেদটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ আপনার যোগ্যতা, মেধা। আমি সক্ষম যোগ্য বলেই আমাকে এ পদে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

আর পুলিশেও এখন বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্নদের বিশেষায়িত বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। যেমন টেকনিক্যাল বিভাগগুলোতে টেকনিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ডের জনবলদের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। তেমনিভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া পুলিশ সদস্যদের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে এবং এমবিবিএস পাস করা পুলিশ কর্মকর্তাদের পুলিশ হাসপাতালে বদলি বা পদায়ন করা হচ্ছে। এতে ওইসব কর্মকর্তাও সেটিসফাইড, বাহিনীও।

জাগো নিউজ : সিআইডির ফরেনসিক বিভাগে কাজ কতটা চ্যালেঞ্জিং?

রোমানা আক্তার : সিআইডির ফরেনসিক বিভাগে কাজ করা সত্যি চ্যালেঞ্জিং। আমি ২০১৬ সাল থেকে ফরেনসিক বিভাগে দায়িত্ব পালন করে আসছি। ফিঙ্গারপ্রিন্ট, হ্যান্ডরাইটিং, ফটোগ্রাফি, জালনোট ও মেকি মু্দ্রা, ব্যালিস্টিকস, ক্রাইম সিন রাসায়নিক পরীক্ষাগার ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাব এবং সাইবার ট্রেনিং সেন্টারের কর্মকাণ্ড গতিশীল করতে ভূমিকা পালন করতে হয়। আমার অধীনে সারাদেশে ৫০৪ জন কাজ করছেন। দুদক, নারকটিক্স কিংবা ব্যাংকের মতো অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান ও দেশের নানা প্রান্ত থেকে তথ্য আসে। বস্তুগত প্রমাণাদি পাঠানো হয় এখানে। আমরা সেটা করে দেই। আমার টিমই এসব করে থাকে।

SP-ROMANA-2

জাগো নিউজ : বেগম রোকেয়া, ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, জাহানারা ঈমামরা নারী জাগরণের জন্য লড়াই করেছেন। আজ দেশে-বিদেশে নারীরা উদ্যোগী হচ্ছে। যোগ্যতার প্রমাণ রাখছে। ব্যবসা, চাকরি, শিক্ষা, রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে নারী উদ্যোগ আন্তর্জাতিকভাবেও এর স্বীকৃতি পেয়েছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?

রোমানা আক্তার : মূল্যবোধ বা দৃষ্টিভঙ্গিটাই আসল। দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারলে বদলানো যায় সব। আর নারীদের মধ্যে সেই মূল্যবোধ জন্মেছে। দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এখন নারীরাই উদগ্রীব। নারীরা অংশীদারিত্ব পেয়েছে, যেখানেই দায়িত্ব পালন করছে সেখানেই সফলতা এসেছে। তবে আমার মনে হয়, বাংলাদেশ পুলিশের সদস্য হিসেবে নারীদের আরও বেশি বেশি জাতিসংঘ মিশনে অংশ নেয়া উচিত। নিজ অভিজ্ঞতায় বলতে পারি মিশনে নারীদেরই বেশি সুযোগ সুবিধা। এ সুযোগটা নারী কর্মকর্তাদের যোগ্যতার সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত।

জাগো নিউজ : নারীদের এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আপনার ব্যক্তিগত অভিমত কী?

রোমানা আক্তার : ব্যক্তিগত উদাহরণই দেব। আমি যখন এসপি হিসেবে যোগদান করি তখন আমার বাবাই প্রশ্ন তুলেছিলেন, আরও ক্যাডার থাকতে পুলিশ কেন? তবে মা সহযোগিতা করেছেন। আমি কিন্তু যোগ্যতা দিয়ে ‘নারীর প্রশ্নে’যে বাধা তা কাটিয়েছি। তবে আমার মনে হয়, নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নারীদেরই বেশি সহযোগী হওয়া উচিত। যেমন সন্তান-স্বামী পরিবার ছেড়ে মিশনে যেতে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। ওই সময় আমার মা সহযোগিতা করেছেন। আমার সন্তানদের দেখভাল করেছেন।

জাগো নিউজ : নারীদের এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা কি সন্তোষজনক?

রোমানা আক্তার : স্বাধীনতার পর থেকে একটু একটু করে এগিয়েছে নারীরা। বৈষম্য কমেছে। যদিও এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে আসেনি নারীর অবস্থান। তবে নারীদের এগিয়ে নিতে বর্তমান সরকারের নারীবান্ধব কর্মসূচি বেশ কাজে দিচ্ছে। বাধাকে উপেক্ষা করার মতো বেশ কিছু সাহসী ট্রেনিং সেশন চালু করেছে সরকার।

জাগো নিউজ : আপনাকে ধন্যবাদ, সময় দেয়ার জন্য।

রোমানা আক্তার : জাগো নিউজকেও ধন্যবাদ। আশা করছি জাগো নিউজও নারীদের এগিয়ে নেয়ার কাজে অংশীদার হবে।

জেইউ/এনডিএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।