দেশেই বিশ্বসেরা চিকিৎসা দেয়া সম্ভব

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৪৫ এএম, ০৫ মার্চ ২০১৯

ড. সামন্ত লাল সেন। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে আসা আগুনে পোড়া রোগীদের অতি আপনজন তিনি। 

হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে চিকিৎসক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও স্বাধীনতার পরপরই সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগ দেন। ১৯৮০ সালে ঢামেক হাসপাতালে বদলি হয়ে আসেন ডা. সেন। স্বপ্ন ছিল প্লাস্টিক সার্জন হওয়ার। মানুষের চেহারা সুন্দর করা যাবে, অনেক টাকা-পয়সা রোজগার করা যাবে, বাড়ি-গাড়ি করা যাবে। কিন্তু পোড়া রোগীদের কষ্ট দেখে জীবনটা যেন বদলে যায়, বড়লোক হওয়ার ভূতও বিদায় নেয়। দগ্ধ অসহায় দরিদ্র মানুষের জন্য কী করা যায়- এমন চিন্তায় ১৯৮৬ সালে প্লাস্টিক সার্জন অধ্যাপক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর অনুপ্রেরণায় বার্ন ইউনিট করার প্রস্তাব করেন সরকারের কাছে। স্বপ্নপূরণ হয় ২০০১ সালে। ঢামেক হাসপাতালে ৫০ শয্যা নিয়ে প্রতিষ্ঠা হয় আলাদা বার্ন ইউনিট, যা বর্তমানে উন্নীত হয়েছে ৩০০ শয্যায়। 

আগুনে দগ্ধ একজন মানুষের সঙ্গে পুড়ে যায় শত মানুষের মনও। একটি বাড়িতে একজন মানুষ আগুনে পুড়ে গেলে ওই বাড়ি থেকে শান্তিই উড়ে যায়

বিজ্ঞাপন

এখন তৈরি হচ্ছে ৫০০ শয্যার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট। আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তিসংবলিত এ ইনস্টিটিউটে ৫০০ শয্যা, ৫০টি ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট, ১২টি অপারেশন থিয়েটারবিশিষ্ট হবে। বিশ্বের বৃহত্তম বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এটি পরিণত হবে। চিকিৎসা, গবেষণা ও অধ্যয়নের কেন্দ্র হিসেবে বিভিন্ন দেশের শিক্ষক, চিকিৎসক ও গবেষক এখানে এসে অধ্যয়ন, চিকিৎসা ও গবেষণার সুযোগ পাবেন বলে বিশ্বাস করেন ড. সামন্ত লাল সেন।  

পেশা, দায়িত্ব আর নানা অভিজ্ঞতা নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। মতামত দেন বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার সার্বিক বিষয়ে। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

মাত্র পাঁচটি বেড নিয়ে যে চিকিৎসাসেবা শুরু, সেই সেবার উন্নয়নে আজ ১৮ তলার ইনস্টিটিউট। কল্পনার বাইরেই বলা যায়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বার্ন হাসপাতাল এখন বাংলাদেশে

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

জাগো নিউজ : আগুনে পোড়া মানুষের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। পোড়া মানুষের পরিষেবা দিয়ে স্বনামে পরিচিত আপনি। এবার চকবাজারের ট্র্যাজেডি কেমন দেখলেন? 

সামন্ত লাল সেন : আগুনে পোড়া সব মানুষের কষ্ট একই বলে আমার বিশ্বাস। যে আগুনে পুড়েছেন, সেই কেবল এর যন্ত্রণা অনুভব করতে পারেন। আমার মনে হয়, এর চেয়ে বেশি কষ্ট অন্য কোনো রোগীর ক্ষেত্রে প্রকাশ পায় না।   

এখন বোঝানোর সময় এসেছে বাংলাদেশেও ভালো চিকিৎসা হয়। আমি বিশ্বাস করি, বিদেশ থেকেও ডাক্তাররা এখানে আসবেন প্রশিক্ষণ নিতে

আগুনে দগ্ধ একজন মানুষের সঙ্গে পুড়ে যায় শত মানুষের মনও। একটি বাড়িতে একজন মানুষ আগুনে পুড়ে গেলে ওই বাড়ি থেকে শান্তিই উড়ে যায়। মনে হবে সবার মনই যেন পুড়ে গেছে। পোড়া মানুষের সেবা আর অন্য রোগীর সেবা ঠিক একধরনের নয়। পোড়া শরীর নিয়ে একজন রোগী যেমন হতাশায় থাকেন, তেমনি তার স্বজনরাও। শেষ পর্যন্ত কী ঘটবে, তা বলা মুশকিল হয়ে যায়। এ পরিস্থিতির ব্যতিক্রম ছিল না চকবাজার ট্র্যাজেডিরও। 

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

চকবাজারের কান্না সত্যিই ভোলার মতো নয়। এক মুহূর্তেই শত মানুষকে পুড়িয়েছে। যদিও ঘটনার ভয়াবহতার তুলনায় এবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে কমসংখ্যক আহত এসেছেন। এখানে এবার ১৮ রোগী ভর্তি হন। এর মধ্যে নয়জনকে ওইদিনই চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি পাঠানো হয়। বাকি নয়জনের অবস্থা গুরুতর ছিল। এর মধ্যে তিনজন মারা যান। তিনজনকে এখনও চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে দুজনের অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। 

অনেকেই চকবাজারকে মৃত্যুকূপ বলছেন। আমি তো মনে করি, প্রতিটা বাড়িই এখন মৃত্যুকূপ 

তবে ওইদিন রাতে স্বজনদের যে আহাজারি দেখেছি, তা অনুভব করে এখনও আঁতকে উঠি। আগুনে পুড়ে অঙ্গার চকবাজার। নিখোঁজ স্বজনদের সন্ধান না পেয়ে সবাই ভিড় করছেন ঢামেকের বার্ন ইউনিটে। কারণ মানুষ তো আর আগুনের কাছে যেতে পারেনি। সবাই এখানে এসে হারানো মানুষের সন্ধান চেয়েছেন। আমি তাদের আর্তনাদ দেখেছি। হাজার হাজার মানুষ দিগ্বিদিক ছুটছেন। কোথায় গেলে প্রিয়জনের সন্ধান মিলবে, তা কেউ বলে দিতে পারছে না। সত্যিই, সে রাতের দুঃখকথা কখনই ভোলার নয়। 

জাগো নিউজ : পোড়া মানুষের গন্ধে ভারী হচ্ছে বাতাস। এখন পরিস্থিতি কেমন দেখছেন? 

বিজ্ঞাপন

samanto-lal-sen-02

সামন্ত লাল সেন : প্রতি বছর বাংলাদেশে ছয় লাখ মানুষ আগুনে পুড়ছে। আগুনে পোড়া মানুষ মানসিকভাবে সবসময় হতাশায় থাকে। একজন মানুষের শরীরের ৩০ ভাগও যদি পুড়ে যায়, তবুও ওই পরিবারের সবাইকে ব্যস্ত থাকতে হয়। সারাজীবন তাকে মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকতে হয়। এ কারণে আমরা সবসময় বলে থাকি, আগুন থেকে সাবধান! মানুষের শরীর যেন আগুনে পুড়ে না যায়। 

জাগো নিউজ : চার দশকেরও বেশি সময় ধরে চিকিৎসা দিচ্ছেন আগুনে দগ্ধ রোগীদের। অনেক কিছুর সাক্ষীও বটে। আগুনে পোড়া মানুষের চিকিৎসাসেবা শুরুতে কেমন দেখেছেন, এখন কেমন দেখছেন? 

বিজ্ঞাপন

সামন্ত লাল সেন : স্বাধীনতার পরপরই আমার ক্যারিয়ার শুরু। তখন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ছোট একটি ইউনিট ছিল, যেখানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। 

বঙ্গবন্ধু যুক্তরাষ্ট্র থেকে অর্থোপেডিকের সার্জন ডা. আর জে কাস্ট (রোনাল্ড জোসেফ কাস্ট) নামের এক চিকিৎসককে নিয়ে আসেন। ওই চিকিৎসকই তখন অনুধাবন করেন যে, বাংলাদেশে একটি বার্ন ইউনিট জরুরি। ১৯৭৪-১৯৭৫ সালে প্রথম সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে বার্ন প্লাস্টিক সার্জারির শুভ সূচনা হয়। 

আমি তখন একেবারেই তরুণ চিকিৎসক হিসেবে বার্ন ইউনিটে যোগ দেই। আমি গ্রামে ছিলাম। বদলি হয়ে ঢাকায় আসি। প্লাস্টিক সার্জন হওয়া আমারও বড় স্বপ্ন ছিল।

বিজ্ঞাপন

মাত্র পাঁচটি শয্যা দিয়ে বার্ন ইউনিটের যাত্রা। এ কারণে আমি এখন সবসময় বলি পাঁচ থেকে ৫০০। 

জাগো নিউজ : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগ দিলেন কখন? 

সামন্ত লাল সেন : আশির দশকের গোড়ার দিকে আমি ঢাকা মেডিকেলে যোগ দেই। তখন আগুনে পোড়া রোগীর চিকিৎসা ঠিক এখনকার মতো ছিল না। এ ধরনের রোগীরা সাধারণত বেড পেতেন না। অন্য রোগীদের এতই চাপ ছিল যে, পোড়া রোগীরা ওয়ার্ড পেতেন না। তারা হয়তো বারান্দায়, নতুবা বাথরুমের পাশে পড়ে থাকতেন। 

বিজ্ঞাপন

পোড়া রোগী দেখতে অন্যরকম। গন্ধ হয়। মশারি খাটিয়ে থাকতে হয়। অধিক জায়গাও লাগে। একেবারেই অবহেলার চোখে দেখা হতো তাদের।

তখন উপলব্ধি হয়, আগুনে পোড়া রোগীদের জন্য আলাদা কিছু করতে হবে। ঢাকা মেডিকেলের পুরনো ভবনে আমরা পোড়া রোগীদের সেবা দিতাম। আমার শিক্ষক ছিলেন প্রফেসর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। প্রফেসর কবিরউদ্দীন ছিলেন জেনারেল সার্জন। তারা দুজনই গত হয়েছেন। আমি তখন রেজিস্ট্রার হিসেবে কাজ করি। মূলত ওই দুই মহান ব্যক্তির উদ্যোগেই বার্ন ইউনিটের সফলতার যাত্রা শুরু। তারা খুবই উদ্যোগী ছিলেন। আর আমি তখন তাদের কথায় দৌড়াচ্ছি। 

১৯৯১ সালের পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার বার্ন ইউনিটে আগুনে পোড়া রোগীদের দেখতে আসেন। তখন তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রী। আমার সঙ্গে কথা হয় চিকিৎসার সার্বিক বিষয় নিয়ে। এরপর ১৯৯৬ সালে তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন একবার এসে বর্তমান বার্ন ইউনিটের জায়গা দেখিয়ে বললেন, এখানে কিছু করা যায় কিনা। তখন ওই জায়গাটা ডোবার মতো ছিল। আশপাশে ছিল বস্তি। শেখ সেলিম তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

কেন এমন ঘনবসতিপূর্ণ জায়গায় কেমিক্যাল? গ্যাস বা বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ কতগুলো, তার কোনো হিসাব আছে? অনেক দেখলাম, অনেক বললামও। এখন ভয়ও লাগে, লজ্জাও লাগে

বস্তি উচ্ছেদ করে হাসপাতালের ভবন হবে জেনে বস্তিবাসীরা খুবই প্রতিবাদ শুরু করলেন। অনেকেই হুমকি দিতে শুরু করলেন। এমনকি আমার জীবনের ওপরও হুমকি এলো। তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী শেখ সেলিম সে সময় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। তিনি বস্তির নেতাদের সঙ্গে বসলেন। তাদের অধিকাংশই ছিলেন মেডিকেলের স্টাফ। এলিফ্যান্ট রোডে স্থানান্তরের প্রতিশ্রুতি দিলে তারা জায়গা ছেড়ে দেন। এরপরই বর্তমান বার্ন ইউনিট ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়। 

প্রথমে ৫০ বেড দিয়ে শুরু। এরপর তিনতলা ভবন হলো। এখন এ ভবন ছয়তলা। বার্ন ইউনিটের জন্য আলাদা ভবন করা হয়েছে আলাদা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। বলতে পারেন, আমি এখানকার সব কিছুর-ই সাক্ষী।

আগুনে পোড়া রোগীদের যে বিশেষ চিকিৎসা দরকার, তা মূলত রাষ্ট্রপক্ষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম। ওই প্রচেষ্টায় অন্যতম ভূমিকা রেখেছে গণমাধ্যম। আমরা এসিডে দগ্ধ রোগীদের বিশেষ সেবায় নজর দিতাম। তখন ভোরের কাগজের রিপোর্টার ছিলেন মুন্নী সাহা। তিনিসহ অনেকেই এসিডদগ্ধদের খবর নিতে আসতেন। মূলত সাংবাদিকদের লেখালেখির কারণে সরকার বুঝতে পারলো যে, আলাদা একটি ইউনিট করা দরকার। সবার প্রচেষ্টায় বার্ন ইউনিট এখন ৫০০ বেডের ইনস্টিটিউট। 

জাগো নিউজ : বার্ন ইউনিট নিয়ে এখন কী বলবেন? 

সামন্ত লাল সেন : ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি, নির্বাচন ঘিরে যে সহিংসতা হলো, তাতে শত শত মানুষ আগুনে দগ্ধ হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগুনে পোড়া মানুষদের দেখতে এলেন। প্রধানমন্ত্রী সমস্যার কথা জানতে চাইলেন। আমি বললাম, প্রথমত বেডের সমস্যা। এরপর সমস্যা জনবলের। পর্যাপ্ত ডাক্তার নাই। 

তখন আমি প্রস্তাব দিলাম, আমার একটা বার্ন ইনস্টিটিউট চাই। প্রধানমন্ত্রী বললেন, জায়গা খোঁজেন। কুর্মিটোলা, কুড়িলসহ নানা জায়গায় আমরা খোঁজ নিলাম। মিললো না। এই যে বার্ন ইউনিটের পাশেই (অর্থাৎ ঢাকা মেডিকেলের পাশের সড়কের পরই) একটি পুরনো ভবন ছিল। সিদ্ধান্ত হলো, এখানেই বার্ন ইনস্টিটিউট নির্মাণ সম্ভব। হয়ে গেল। 

মাত্র পাঁচটি বেড নিয়ে যে চিকিৎসাসেবা শুরু, সেই সেবার উন্নয়নে আজ ১৮ তলার ইনস্টিটিউট। কল্পনার বাইরেই বলা যায়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বার্ন হাসপাতাল এখন বাংলাদেশে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, কোনো দেশে এত সংখ্যক মানুষ আগুনে পোড়ে না।  

বার্ন ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবার সফলতার কথা বলে। আমি অবসরে গেছি। এরপরও প্রধানমন্ত্রী আমাকে সমন্বয়ক করে রেখেছেন। আমি চাই, পরবর্তী প্রজন্ম এ সেবায় আলো নিয়ে আসুক। 

জাগো নিউজ : বার্ন ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম কবে নাগাদ শুরু হবে?

সামন্ত লাল সেন : প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে উদ্বোধন করেছেন। কিছু সমস্যার কারণে এখনও কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। বিদ্যুতের সংযোগ নিয়ে জটিলতা ছিল। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার অবসান ঘটেছে। আশা করছি, মাসখানেকের মধ্যে বিদ্যুতের কাজ সম্পন্ন হবে। এরপরই যন্ত্রপাতি স্থাপন করতে পারব। অধিকাংশ যন্ত্রই চলে এসেছে। জনবল নিয়োগও প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। সম্ভবত চলতি বছরের ২২ জুন আমরা এখানে কাজ শুরু করতে পারব।

ভবনটি দ্রুত নির্মাণের জন্য কৃতিত্ব দেব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে। মাত্র দুই বছরে এত বড় ভবন নির্মাণ, সত্যিই অবিশ্বাস্য! 

জাগো নিউজ : এক্ষেত্রে চিকিৎসাসেবার উন্নয়ন ঘটলো কতটুকু? 

সামন্ত লাল সেন : আমি যখন ক্যারিয়ার শুরু করি তখন প্লাস্টিক সার্জন ছিলেন মাত্র দুজন। এখন বাংলাদেশে প্রায় ৭০ জন প্লাস্টিক সার্জন রয়েছেন। আমরা খালি চোখে অপারেশন করতাম। এখন মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে অপারেশন হচ্ছে। চিকিৎসার অত্যাধুনিক ব্যবস্থার সবই আছে এখন বাংলাদেশে। 

নতুন ভবনে গেলে আধুনিকমানের অনেক কিছুই মিলবে। ব্লাডব্যাংক দেখেছেন, স্কিনব্যাংক আছে- এটা হয়তো অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেন না। মানুষের চামড়া ৩০ কী ৪০ ভাগ পুড়ে গেলে এবং গভীর ক্ষত হলে চামড়া ফেলে দিতে হয়। স্কিনব্যাংক থেকে তাৎক্ষণিক নতুন চামড়া লাগাতে পারলে ক্ষতিটা তেমন হয় না। অনেক বেওয়ারিশ লাশ থাকে, তাদের অনেকেরই হদিস মেলে না। তাদের চামড়া সংরক্ষণের ব্যবস্থা হচ্ছে। এটা আগুনে পোড়া রোগীদের বড় উপকারে আসবে। মানুষ মরণোত্তর চক্ষু, কিডনি দান করে থাকেন। চামড়া দান করলে আরেকজন মানুষের জীবন বাঁচবে- এটা যদি আমরা সামাজিকভাবে মানুষকে বোঝাতে পারি, তাহলে ব্লাডের মতো চামড়াও সহজে মিলবে। একজন মানুষের মৃত্যুর পর ছয় কী সাত ঘণ্টার মধ্যে তার চামড়া সংরক্ষণ করতে পারলে তা অন্যের শরীরে লাগানো সম্ভব। নবগঠিত বার্ন ইনস্টিটিউটে এর সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়ে গেছে এবং এটা আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থায় বড় অর্জন বলে মনে করি। ঠোঁটকাটা, তালুকাটার চিকিৎসা এখন আমরা নিজেরাই দিয়ে থাকি।

samanto-lal-sen-03

আমরা নতুন ভবন প্রাঙ্গণে একটা হেলিপ্যাড করেছি। ২৪ ঘণ্টা জরুরি বিভাগ থাকছে। দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে, যেকোনো মুহূর্তে আক্রান্ত মানুষকে যাতে এখানে আনা যায় এবং চিকিৎসাসেবা দেয়া যায় সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর কোনো সরকারি হাসপাতালে এমন ব্যবস্থা নাই। ১০ বছর পর আজকের বাংলাদেশ থাকবে না। উন্নয়নের সব পরিকল্পনাই এখন ভবিষ্যৎকে সামনে রেখে করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সেভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। দেশেই এখন বিশ্বসেরা চিকিৎসা দেয়া সম্ভব।

মানুষ সার্জারির মাধ্যমে তার চেহারা সুন্দর করতে পারবেন এখানেই। বোঁচা নাক খাড়া করতে পারবেন। টাক মাথায় চুল লাগাতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তুলনা করে যে ব্যবস্থা দরকার, তাই করতে হবে। তিনি এখানে অর্থ বরাদ্দে কোনো কার্পণ্য করেননি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের সব দিয়েছেন। এখন আমাদের দেশকে দেয়ার পালা এবং এটাই আমি আমার সহকর্মীদের বলে আসছি। এখন বোঝানোর সময় এসেছে বাংলাদেশেও ভালো চিকিৎসা হয়। আমি বিশ্বাস করি, বিদেশ থেকেও ডাক্তাররা এখানে আসবেন প্রশিক্ষণ নিতে। 

জাগো নিউজ : বছরে ছয় লাখ মানুষ আগুনে পুড়ছে, বলছিলেন। অভিজ্ঞতা থেকে বলবেন কী, আগুন থেকে রক্ষা পেতে কোনটি বেশি আবশ্যক?

সামন্ত লাল সেন : অসাবধানতার কারণেই অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত, নিজ অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। সচেতন হলে ৯০ ভাগ মানুষ আগুন থেকে রক্ষা পাবেন বলে আমার বিশ্বাস। মানুষ নিজ থেকে যদি আগুনের ভয়াবহতা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে না পারে, তাহলে ১৮ তলা চিকিৎসাকেন্দ্র করে কোনো লাভ হবে না।  
এখন রাজধানীজুড়ে সচেতনতার যে আওয়াজ উঠেছে, তা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। এরপরও আমি মনে করি, সচেতনতার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে বার্ন ইউনিট করা জরুরি। আগুনে পোড়া রোগীর প্রথম ২৪ ঘণ্টা হচ্ছে গোল্ডেন আওয়ার। আগুনে পোড়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সুচিকিৎসা করা না গেলে আর কোনো উন্নত চিকিৎসাই কাজে আসে না। রংপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কেউ পুড়ে গেলে তাকে ঢাকায় আনতে আনতে অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। গরিব মানুষ গাড়ি ভাড়ার অভাবে ঢাকায় আসতেও পারেন না। 

আমার মতে, গরিব মানুষই বেশি আগুনে পুড়ে মরছে। কাজের মেয়ে গামলায় করে গরম পানি নিয়ে যায়। সামান্য ধাক্কা লাগলেই সর্বনাশ। অথচ বালতিতে করে নিলে হয়তো এমন দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। আমার এখানে যদি ১২০টা আগুনে পোড়া রোগী ভর্তি হয়, তাহলে দেখবেন ১০০টাই অসাবধানতার কারণে পুড়েছে। রান্নার সময় শাড়ি পেঁচিয়ে রান্না করলে অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। অনেকেই চকবাজারকে মৃত্যুকূপ বলছেন। আমি তো মনে করি, প্রতিটা বাড়িই এখন মৃত্যুকূপ। রান্নাঘরে ভেন্টিলেশন নাই। জানালা বন্ধ। গ্যাসের লাইনে যদি সামান্য ছিদ্র হয় তাহলে আগুন লাগাতে গেলেই সর্বনাশ ঘটে যাবে। পুরো বাড়িই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।

এসব ঘটনা বোঝানোর বিষয়। এক্ষেত্রে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আগুন থেকে রক্ষা পেতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। ডাক্তার, সাংবাদিকসহ সমাজের সব শ্রেণির প্রতিনিধি এখানে ভূমিকা রাখতে পারেন। 

আপনি দেখেন, গোটা শহরে বৈদ্যুতিক তারের কী অব্যবস্থাপনা! পিলারগুলোয় চোখ রাখলে দম বন্ধ হয়ে আসে। বৈদ্যুতিক শকে জীবন হয়তো বেঁচে যায় কিন্তু ভুক্তভোগীর শরীরে মারাত্মক এক ক্ষত তৈরি হয়। আমরা কোনো কোনো রোগীর দুই হাত অথবা দুই পা পর্যন্ত কেটে ফেলেছি। চাইলেই এগুলো বন্ধ করা সম্ভব। অনেক হিন্দু নারী আগুনে পুড়ে এখানে আসেন। পুজো করতে গিয়ে প্রদীপের আগুনে অসাবধানতাবশত পুড়ে গেছেন। চার্জে দিয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলাও দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। মোবাইল বিস্ফোরণে আহত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেধাবী ছাত্র এখানে মারা গেছেন। যেকোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকেই এমন দুর্ঘটনা হতে পারে। 

জাগো নিউজ : দায় রাষ্ট্রেরও। অন্তত নিমতলী ও চকবাজার থেকে এর প্রমাণ মিলছে… 

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

সামন্ত লাল সেন : অবশ্যই। নিমতলীতে অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে পারেনি। চকবাজারে সিলিন্ডার নাকি কেমিক্যাল বিস্ফোরণে আগুন, তা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। সমস্যা তো সবখানেই। কয়টা সিলিন্ডার ঠিক তার কোনো হদিস আছে? কেন এমন ঘনবসতিপূর্ণ জায়গায় কেমিক্যাল? গ্যাস বা বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ কতগুলো, তার কোনো হিসাব আছে? অনেক দেখলাম, অনেক বললামও। এখন ভয়ও লাগে, লজ্জাও লাগে।

এএসএস/এমএআর/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।