গুজবে টালমাটাল শেয়ারবাজার

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৫০ এএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

মুদ্রানীতিতে টেনে ধরা হয়েছে বেসরকারি ঋণের লাগাম। মার্চে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ আমানত অনুপাতের (এডিআর) ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করবে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ায় শেয়ারবাজারে দেখা দিয়েছে নেতিবাচক প্রভাব।

তবে শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, মুদ্রানীতি ও এডিআর ইস্যুতে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার বাস্তবভিত্তিক কোনো কারণ নেই। অনৈতিক ফায়দা লুটতে বিশেষ চক্র পরিকল্পতিভাবে গুজব ছড়িয়ে দরপতন ঘটানোর চেষ্টা করতে পারে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশের শেয়ারবাজারে ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়। এতে এক মাসের মধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স সাতশ পয়েন্টের ওপরে বৃদ্ধি পায়।

তবে ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণার পর হঠাৎ করেই পতনের ধারা দেখা দেয় শেয়ারবাজারে। মুদ্রানীতি ঘোষণার দিন থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লেনদেন হওয়া ৯ কার্যদিবসের মধ্যে সাত কার্যদিবসেই দরপতন ঘটে। এতে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক কমেছে ১৯১ পয়েন্ট।

এদিকে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংক ঘুরে জানা গেছে, বাজারে গুজব ছড়িয়েছে আগামী মার্চে এডিআরের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কড়াকড়ি আরোপ করবে, এরই অংশ হিসেবে মুদ্রানীতিতে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি কমানো হয়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মুদ্রানীতি ও এডিআর নিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে।

মো. রফিকুল ইসলাম নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানতে পেরেছি মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংক এডিআর নিয়ে কড়াকড়ি আরোপ করবে। যেসব ব্যাংকের এডিআর নির্ধারিত সীমার বেশি তাদেরকে ৩১ মার্চের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। এতে বাজারে অর্থের ফ্লো কমে তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে। শেয়ারবাজারের জন্য এটা অবশ্যই এক ধরনের আতঙ্কের বিষয়।

সোহাগ নামের অপর এক বিনিয়োগকারী বলেন, এডিআর সমন্বয়নের জন্য ৩১ মার্চের পর যদি ব্যাংকগুলোকে নতুন করে সময় না দেয়া হয়, তাহলে তো কিছু ব্যাংকের বিনিয়োগ উঠিয়ে নিতে হবে। এর প্রভাব অন্য ব্যাংকগুলোর ওপরও পড়বে। শুনছি বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন করে সময় না বাড়ানোর বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিবে। এরই অংশ হিসেবে মুদ্রানীতিতে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি আগের থেকে কমিয়ে ধরা হয়েছে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, এডিআর নিয়ে এর আগেও শেয়ারবাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ঋণ প্রবৃদ্ধি ব্যাপক হারে বাড়তে থাকায় গত বছরের ৩০ জানুয়ারি ব্যাংকগুলোর ঋণ-আমানত অনুপাত কমিয়ে একটি নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নির্দেশনায় ৩০ জুনের মধ্যে এডিআর কমিয়ে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর জন্য ৮৩ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য ৮৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে বলা হয়। আগে যা ৮৫ ও ৯০ শতাংশ ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই নির্দেশনা জারির পর শেয়ারবাজারে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এতে এক মাস না যেতেই ওই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি আরেকটি নির্দেশনা জারির মাধ্যমে এডিআর সমন্বয়ের সময় বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর করা হয়। তবে ব্যাংক মালিকদের পক্ষ থেকে এডিআর সমন্বয়ের সময় আরও বাড়ানোর দাবি জানানো হয়।

এ পরিস্থিতিতে গত ১ এপ্রিল ব্যাংক মালিকদের সংগঠন ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) সঙ্গে রাজধানীর একটি হোটেলে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে গভর্নর ফজলে কবিরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। বৈঠকে বিএবির সদস্যরা এডিআর সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ানোর দাবি জানালে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়।

তবে মুদ্রানীতি ও এডিআরের কারণে শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়াকে ভিত্তিহীন মনে করছেন শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিজিট অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকি জাগো নিউজকে বলেন, মুদ্রানীতির সঙ্গে পুঁজিবাজারের কোনো সম্পর্ক নেই। আর এডিআর বাড়ালে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। এতে শেয়ারবাজারের কী যায়-আসে। মুদ্রানীতি বা এডিআরের কারণে শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কোনো কারণ নেই। মানুষ এসব গুজব বাজারে ছড়ায়।

তিনি আরও বলেন, শেয়ারবাজার সব সময় উঠা-নামার মধ্যেই থাকবে। বাজার টানা ঊর্ধ্বমুখী বা দরপতন ভালো লক্ষণ নয়। তবে এখনো পর্যন্ত বাজার যতটুকু পড়ছে তাতে ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু এরপরও যদি বাজার টানা পড়তে থাকে তাহল সেটা ভালো হবে না।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, মুদ্রানীতির কারণে শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কোনো কারণ নেই। কারণ শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এমন কিছু নতুন মুদ্রানীতিতে নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৮-১৯ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের যে মুদ্রানীতি দিয়েছে তাতে আগের মুদ্রানীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়েছে। মুদ্রানীতির কারণে বাজারে তারল্য সংকট হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারা শেয়ারবাজারে গুজব ছড়াচ্ছে তা খুঁজে বের করে পদক্ষেপ নিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের পর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে সক্রিয় হয়েছে। বিদেশিদের বিনিয়োগ বাড়ার কারণেই ভোটের পর বাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। আমার ধারণা বিদেশিদের বিনিয়োগ সামনে আরও বাড়বে। কারণ অনেক ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ার দাম এখনো বেশ কম।

এমএএস/এএইচ/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।