শেষ সময়ে অনলাইনে জমজমাট প্রচারণা
আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিগত ১০টি নির্বাচনের চাইতে এবারের নির্বাচনের গুরুত্ব যেমন বেশি, তেমনি প্রচার-প্রচারণায়ও এসেছে বেশ পরিবর্তন। অনলাইনের কল্যাণে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে নির্বাচনী প্রচারণায়। কার্যত আজ মাঠের প্রচারণার শেষদিন হলেও এখন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে না গিয়েও তাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে প্রার্থীদের বার্তা।
নির্বাচনী প্রচারণার প্রথমদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দলীয় কর্মী-সমর্থকরা নিজ নিজ ওয়ালে প্রচারণার কাজ চালালেও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তা পেয়েছে পরিকল্পিত রূপ। প্রার্থীরাও বুঝতে শুরু করেছেন, সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব কিংবা ব্লগের মাধ্যমে ভোটারদের কাছে নিজেদের বক্তব্য খুব দ্রুত পৌঁছে দেয়া যায়, যা ঘরে বসেই সকল ভোটারের কাছে দৃষ্টিগোচর হয়।
অনলাইনই অল্প সময়ে এবং সল্প খরচে ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর সবচেয়ে সহজ মাধ্যম। এছাড়া দমন-নিপীড়নে কোণঠাসা বিরোধী পক্ষ এ মাধ্যমেকে সবচেয়ে কার্যকর মনে করছে।
সর্বশেষ বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচনী প্রচারণার জন্য একটি ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ খুলেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। অল্প সময়ের মধ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ফেসবুক পেজের লাইক দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখের কাছাকাছি।
অবশ্য তাদের প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে লাইকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এর সংখ্যা ২৫ লাখ ৩০ হাজারের কাছাকাছি। নিবন্ধন হারানো দল জামায়াতের ফেসবুক পেজে লাইকের সংখ্যা ১১ লাখ হলেও তাদের জোটের সবচেয়ে বড় দল বিএনপির ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে লাইকের সংখ্যা নয় লাখ ৫৬ হাজার।
বড় দলগুলো ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও বার্তা ও লাইভ প্রচারণায় সরব রয়েছেন প্রার্থীরা। ফেসবুকের পাশাপাশি ইউটিউব, টুইটারে সরব অনেকে।
জানা যায়, দেশে এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা নয় কোটি। এর মধ্যে ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছেন তিন কোটি। নির্বাচন কেন্দ্রীক ইউটিউবে চ্যানেল রয়েছে কয়েক’শ। টুইটারে সক্রিয় প্রায় লক্ষাধিক অ্যাকাউন্ট।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সাইন্স বিভাগের অধ্যাপক হানিফ সিদ্দিকি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমানে রাজপথ বন্ধ রেখে মানুষকে কষ্ট প্রদান করে রাজনৈতিক কর্মসূচি কিংবা প্রচার-প্রচারণা খুব বেশি কার্যকর পন্থা না। ১০ বছর আগে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৯০ লাখ, এখন প্রায় নয় কোটি। ব্যবহারকারী বাড়ায় নির্বাচনে অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় প্রচার মাধ্যম হলো অনলাইন। নির্বাচনকে সামনে রেখে শুরু থেকে এ মাধ্যমে পরিকল্পিত কাজ শুরু করে আওয়ামী লীগ। এ মাধ্যমে মূলত তরুণ ভোটারদের টার্গেট করা হয়েছে।’
এদিকে, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রচারণা শুরুর পর থেকে হামলার শিকার হচ্ছে ছেলেরা। এমনকী আমার ওপরও হামলা হয়েছে; যা আমার রাজনৈতিক জীবনে কখনও ফেস করিনি। হাজার হাজার পোস্টার বাসায় পড়ে আছে, লাগাতে পারছি না। লাগালেও ছিঁড়ে ফেলছে। তাই এখন একমাত্র অনলাইন প্রচারণাই আশার স্থল। সরকার সেখানেও থাবা মারতে বসে আছে। ফেসবুকে পোস্ট করলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, মারধর করছে।’
সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, অনলাইন প্রচারণায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ-সংগঠনগুলো। তাদের কাজেও দেখা গেছে সুস্পষ্ট পরিকল্পনার ছাপ। তবে দেরিতে হলেও বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মাঠ ধরার চেষ্টায় আছে।
কোনো দল বা গোষ্ঠী নির্বাচনের বিষয়ে কোনো পোস্ট দিলে সঙ্গে সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা। দিচ্ছেন পক্ষে-বিপক্ষে মতামত।
প্রার্থীরা নিজেরা যেমন ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্টে প্রচারণার ছবি ও ভিডিও শেয়ার করছেন, তেমনি লাইভে আসছেন অনেকে। নির্বাচিত হলে কী কী করবেন- এমন বিষয়ও তুলে ধরে ভিডিও পোস্ট করা হচ্ছে। খোলা হয়েছে প্রার্থীদের নামে ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব অ্যাকাউন্ট। আসন ভিত্তিক প্রচারণাও চোখে পড়ার মতো।
চট্টগ্রাম-৯ আসনে আওয়ামী লীগের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তার ব্যক্তিগত একটি ফেসবুক পেজ আছে। পেজটিতে এখন পর্যন্ত তার বিভিন্ন এলাকায় করা নির্বাচনী গণসংযোগ, মতবিনিময়, পথসভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির ছবিসহ তথ্য দেয়া হয়েছে। এছাড়া ‘চট্টগ্রাম-৯ এর কোতোয়ালি-বাকলিয়া’ নামে আলাদা ফেসবুক পেজ ও ‘কোতোয়ালি-বাকলিয়া (চট্টগ্রাম-৯)’ নামে একটি গ্রুপ থেকেও তার পক্ষে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
সম্প্রতি বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর) আসনের বিএনপি প্রার্থী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী তার ফেসবুক পেজে এক ভিডিও বার্তা প্রচার করেছেন। যেখানে তিনি এ নির্বাচনকে গণতন্ত্রের লড়াই, জনগণের অধিকার আদায়ের লড়াই উল্লেখ করে বলেন, ‘শুধুমাত্র ৩০ ডিসেম্বর একটি দিন কষ্ট করুন, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনুন, আপনাদের অধিকার ফিরিয়ে আনুন।’
এছাড়া চট্টগ্রাম-৭ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী ড. হাসান মাহমুদ ও ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী নুরুল আলম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভোটারদের প্রতি নিজ নিজ প্রতীকে ভোট চেয়েছেন। অনলাইনে বেশ সরব চট্টগ্রাম-১৬ আসনের জাপার প্রার্থী মাহমুদুল হাসান চৌধুরী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আপেল মার্কার জহিরুল ইসলাম। মিরসরাই নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্রে নিজের স্বপ্নের কথা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম-১ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।
নিজ এলাকাবাসীর কাছে ভোট চেয়ে অনলাইনে বার্তা প্রচার করেছেন চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনের ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম ও মহাজোট প্রার্থী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ।
এছাড়া নির্বাচন উপলক্ষে ‘নৌকায় ভোট দিন’, ‘ধানের শীষে ভোট দিন’- এমন নামের একাধিক ফেসবুক পেজ খোলা হয়েছে। এসব পেজে বিভিন্ন ভিডিও বার্তাও দেয়া হচ্ছে ভোটারদের। এসব প্রচারণার বৈশিষ্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ অনলাইনে নির্বাচনী প্রচারণায় গত ১০ বছরের উন্নয়নের বিভিন্ন দিকের পাশাপাশি ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরার চেষ্টা করছে।
বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গত দশ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরছে। আলোচনায় আসছে ডেসটিনি, হলমার্ক, রিজার্ভচুরিসহ নানা বিষয়। এছাড়া নিজ নিজ দলের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রচারেও মনোযোগী প্রার্থীরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রচারণার এসব পোস্টকে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে ‘বুষ্ট’ করা হচ্ছে।
তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার একটি বড় জায়গা করে নিয়েছে বলে দাবি অধিকাংশ ব্যবহারকারীর। এ বিষয়ে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মুনীর হোসাইন খান জানান, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণার সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়মাবলির কথা নির্বাচন কমিশনের আইনে নেই। তবে সব ধরনের গুজোব প্রতিরোধে সচেষ্ট তারা।’
আবু আজাদ/এমএআর/আরআইপি