আগের উদ্যোগ ব্যর্থ, রাজাকারদের তালিকা নতুন প্রক্রিয়ায়

মাসুদ রানা
মাসুদ রানা মাসুদ রানা , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:৫০ পিএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮
১৯৭১ সালে মুক্তিবাহিনীর হাতে আটক একদল রাজাকার

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করা রাজাকারদের তালিকা করতে সরকার এতদিন যে প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছিল সেই প্রক্রিয়া ভেস্তে গেছে। এখন নতুন প্রক্রিয়ায় হবে রাজাকারদের তালিকা।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা ব্যক্তিদের সাধারণভাবে রাজাকার বলা হয়। পাকিস্তানিদের সহযোগী আরও দুটি সংস্থার নাম ছিল আলবদর ও আল শামস। পাকিস্তানিদের নানা অপকর্ম যেমন- হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন তারা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর এত বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের তালিকা করা হয়নি।

বর্তমান সরকার ভাতা প্রাপ্তির সূত্র ধরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন ও থানায় থাকা নাম থেকে রাজাকারদের তালিকা করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তা ভেস্তে গেছে। এখন উপজেলা পর্যায়ে তিনটি কমিটি ও একটি কেন্দ্রীয় কমিটির মাধ্যমে রাজাকারদের তালিকা করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এজন্য আইনও প্রণয়ন করা হবে।

এই বিষয়ে প্রাথমিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদনও নেয়া হয়েছে বলে জাগো নিউজকে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। যিনি সম্প্রতি ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্বও পেয়েছেন।

আগের প্রক্রিয়ার ভেস্তে যাওয়ার কথা জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘রাজাকারের তালিকা করার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমে আশা করেছিলাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হয়তো তাদের তালিকা থাকবে। কারণ রাজাকাররা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ভাতা নিতেন। ১৯৯৬ সালে আমরা যখন সরকারে ছিলাম তখন এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ছিল বলে শুনেছি। ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে নিজামী-মুজাহিদরা যখন মন্ত্রী হয়েছেন তাদের লোকজনের প্রভাব-আধিপত্য দেশবাসীর জানা আছে। এরা খুব সুকৌশলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সহায়তায় এগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে উধাও করে ফেলেছে। এখন তা পাওয়া যাচ্ছে না। গত ৫ বছর আগে থেকেই আমি এ বিষয়ে খোঁজ নিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘রাজাকারদের তালিকা তদানীন্তন ১৭/১৮টি জেলায় ডিসি সাহেবদের কাছেও ছিল। আমরা ডিসিদের কাছেও তালিকা চেয়েছিলাম। মাত্র একটা জেলা থেকে তালিকা পেয়েছিলাম। এরপর আমরা তৃতীয় নির্ভরযোগ্য স্থান ধরে নিয়েছি থানা। কিন্তু সেখান থেকেও রেকর্ড ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে, পাওয়া যায়নি।’

নতুন প্রক্রিয়া তুলে ধরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বলেন, ‘প্রতিটি উপজেলায় আমরা তিন পর্যায়ের কমিটি করব রাজাকারদের তালিকা করার জন্য। কারণ এই ৪৮ বছরে অনেক রাজাকারের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক, আত্মীয়তা হয়ে গেছে। আমরা হয়তো তাদের নাম বাদ দিতে চেষ্টা করব। কেউ হয়তো রাজাকার ছিল না কিন্তু আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি ঘটছে আমি তাকে রাজাকার বানানোর চেষ্টা করব। এই ধরনের প্রবণতা থাকতে পারে। এছাড়া ওই সময়ের প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই মারা গেছেন।’

‘প্রথম আমরা কমিটি করব, যারা মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য-প্রমাণসহ রাজাকারদের তালিকা করবে। আরেকটি কমিটি এই তালিকা সঠিক কিনা তা তদন্ত করে দেখবে। তারা তদন্ত করে মতামতসহ আরেকটি কমিটির কাছে দেবে। এই কমিটি ফাইনাল করবে যাদের তালিকা করা হয়েছে তারা রাজাকার নাকি রাজাকার নয়।’

মোজাম্মেল হক বলেন, ‘প্রথম কমিটি মুক্তিযোদ্ধা ও প্রশাসনের সমন্বয়ে করা হবে। পরের কমিটি করা হবে সিভিল সোসাইটির লোকজনকে নিয়ে। এরপরের বা শেষের কমিটি হবে বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে। আমরা চেষ্টা করব প্রক্রিয়াটি যাতে কোনোভাবেই বিতর্কিত না হয়। কোন নির্দোষ লোক যাতে অভিযুক্ত না হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই তিনটি কমিটি চূড়ান্ত করার পর এটি জামুকার মতো আরও একটি কমিটিতে উপস্থাপন করা হবে। তবে সেটি কী হবে তা এখনও ঠিক করিনি। পুরো প্রক্রিয়ার জন্য একটি কেন্দ্রীয় কমিটি করার সঙ্গে সঙ্গে আইন করারও চিন্তা-ভাবনা আছে আমাদের। সেই কমিটিকে আমরা সাবেক বিচারপতিদের রাখার চেষ্টা করব। যাতে বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গিটা কাজে লাগে।’

তালিকা করার পর কী করা হবে- জানতে চাইলে মোজাম্মেল হক বলেন, ‘কিছুই না। ইতিহাসের স্বার্থে এটা থাকা উচিত। আবার সময় আসতেও পারে। কারণ বিভিন্ন সময়ে দাবি উঠেছে রাজাকারের বংশধররা সরকারি চাকরি পাবে না। এটা আমার অপিনিয়ন। পরবর্তী সময়ে দেশ সেটা নিয়ে চিন্তা করব।’

‘নির্বাচনে আমরা যদি আসি ইনশাআল্লাহ আমরা এটা করার চেষ্টা করব’ বলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক।

মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকাও হল না

মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করার উদ্যোগের বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই যেটা করেছি, আমাদের যে নীতিমালা অনুযায়ী যেভাবে রিপোর্ট করার কথা, যে ছক দেয়া ছিল, সেই ছক অনুযায়ী মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ আমরা পেয়েছি। ৯৭ ভাগ ক্ষেত্রে শুধু মতামত দিয়ে পাঠিয়েছে, কিন্তু কেন হ্যাঁ বা না বলব সেটা না বলে পাঠিয়েছে। উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি থেকে ত্রুটিপূর্ণ রিপোর্ট পাঠানোর কারণে অনুমোদিত হয়নি। পুনরায় কোনটির কী অসুবিধা সেটি তদন্তে করে জেনে উল্লেখ করার জন্য বলেছি। আমরা এই তথ্য চেয়ে আবার চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘এই মেয়াদে এটি আর হচ্ছে না। আমি চেষ্টা করেছিলাম। আমরা উপজেলা থেকে রিপোর্টটা পাইনি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা মনগড়াভাবে করেছে। মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও নীতিমালাটা তারা সঠিকভাবে অনুসরণ করেনি।’

মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের যে সার্ভেটা রয়েছে। সেই অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাদ হতে পারে, যারা মুক্তিযোদ্ধা নয়, কিন্তু তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন। একই সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা যুক্তও হতে পারে। আরও ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার বাতিল হতে পারেন, ইতোমধ্যে ১৫ হাজারের বেশি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করা হয়েছে।’

মোজাম্মেল হক আরও বলেন, ‘জামুকার মিটিংয়ে অনুমোদনের পর গেজেট হওয়ার কথা। কিন্তু দেখা গেছে, কেউ লিখে দিয়েছে সেটার গেজেট হয়ে গেছে। নীতিমালা অনুসরণ করে যেগুলো তালিকাভুক্তি হয়নি সেগুলো বাতিল করছি।’

মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা করা যায়নি। এজন্য বর্তমান সরকার স্বচ্ছতার সঙ্গে গ্রহণযোগ্য একটি তালিকার করার উদ্যোগ নেয়।

এ বিষয়ে আগে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ‘তালিকা করে আমরা সিল করে দেব না। সেটার জন্য একটা আইনও করতে চাই যে, এই এইভাবে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। কেউ যদি বাদ পড়ে তার প্রতি তো আমি অবিচার করতে পারি না।’

মোজাম্মেল হক আরও বলেন, ‘এটা করার পরই বিশ্বের সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে আট ধরনের বারকোড দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ তৈরি করা হবে। বাংলাদেশে হয়তো টাকা জাল করা সহজ হবে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ জাল করা সোজা হবে না।’

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা এক লাখ ৮০ হাজার জনের মতো।

আরএমএম/জেএইচ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।