ভান্ডারীকে রুখতে ‘বিদ্রোহী’ আ.লীগের পেয়ারু

আবু আজাদ
আবু আজাদ আবু আজাদ , নিজস্ব প্রতিবেদক চট্টগ্রাম
প্রকাশিত: ০৩:১১ পিএম, ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮
বিদ্রোহী এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম, মহাজোটপ্রার্থী নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী ও ইসলামী ফ্রন্টের সাইফুদ্দিন মাইজভান্ডারী

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে মহাজোটের প্রার্থী তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সংসদ সদস্য নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে বেশ প্রভাব থাকার পরও নির্বাচনী এলাকায় তিনি এখন কোণঠাসা। ফটিকছড়ি আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ নির্বাচনে আগে থেকে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার। এমনকী দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বহিষ্কারের খড়গ মাথায় নিয়ে এ আসনে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এবার চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন ২৫ জন। যাদের সবাই নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর বিপক্ষে। এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার পর তাকেই সমর্থন দিয়েছেন বাকি মনোনয়নবঞ্চিতরা। ১৯৮৯ সালে উপজেলা নির্বাচনেও বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম।

নির্বাচনের বাতাস বইবার আগে থেকেই ফটিকছড়িতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দুই ধারায় বিভক্ত। গত দুই বছর ধরে একটি উপজেলা আওয়ামী লীগ, অপরটি আওয়ামী পরিবার নাম দিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। আওয়ামী পরিবার হলো মূলত স্থানীয় এমপি তরকিত ফেডারেশনের সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর অনুকূলে। উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে রয়েছেন ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন মুহুরী। বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাকর্মী বিদ্রোহী এ টি এম পেয়ারুল ইসলামের জন্য মাঠে নেমেছেন।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাজিমুদ্দিন মুহুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনেক দিন ধরে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলন করে আসছেন। ফটিকছড়িতে এবার বিতর্কিত প্রার্থী নজিবুল বশরকে চাই না, আমরা দলীয় প্রার্থী চাই। আশা করছি, শেষ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী এ আসনে দলীয় প্রার্থীর হাতেই নৌকা প্রতীক দেবেন।’

উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা মামুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত পাঁচ বছর দল ক্ষমতায় থাকলেও ফটিকছড়ি আওয়ামী লীগ ছিল বিরোধী দলে। আমাদের কোনো বিপদে-আপদে এমপিকে কাছে পাইনি। এসব কারণে অগ্রহণযোগ্য ও বিতর্কিত নজিবুল বশরকে মনোনয়ন না দেয়ার দাবিতে আন্দোলন করছেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। যদি তার মনোনয়ন বাতিল করা না হয় তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সবাই বিদ্রোহী হবে।’

দলীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ, নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী গত পাঁচ বছর অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন। এলাকায় দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করেননি। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক তো রাখেননি বরং বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরোধ উস্কে দিয়েছেন। গত ৪ অক্টোবর ফটিকছড়ির আজাদী বাজারে গণ্ডগোল পাকিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের পথসভা বানচালের জন্যও নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীকে দায়ি করছেন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা।

পরে ১৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর নামে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ফলক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপজেলা আওয়ামী লীগকে দাওয়াত না দেয়ায় সেই বিরোধ আরও চরম রূপ নেয়। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা রুখে দেয় ভান্ডারীর পথসভার আয়োজন। পরে বাধ্য হয়ে গতিপথ ঘুরিয়ে এমপি ভান্ডারী ও তার অনুসারীরা নাজিরহাট-সুয়াবিল-কাজীরহাট হয়ে হেঁয়াকোতে যান।

সর্বশেষ গত শনিবার (০১ ডিসেম্বর) সকালে ফটিকছড়ি উপজেলা সদরে মহাজোটের প্রার্থী নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীকে নৌকার প্রার্থী দেয়ার প্রতিবাদে এবং আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী ঘোষণার দাবিতে জুতা মিছিল করে উপজেলা আওয়ামী লীগ।

ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীদের দাবি, শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে যেন থাকেন এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম। ইতোমধ্যে তারা নানা দেন-দরবার শুরু করেছেন। সিনিয়র নেতাদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করছেন তৃণমূল নেতারা।

মহাজোট প্রার্থী ভান্ডারীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণ জানতে চাইলে এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এমপি ভান্ডারী এলাকার সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীদের নিয়ে রাজনীতি করছেন। ২০০১ সালে তিনি বিএনপি থেকে নির্বাচন করে হেরে যান। তখন তিনি জামায়াত-শিবিরের ক্যাডারদের সংগঠিত করেন। গতবার মহাজোট থেকে এমপি হয়ে ফটিকছড়ি আওয়ামী লীগের মধ্যে বিরোধের জন্ম দেন ভান্ডারী।’

তিনি আরও বলেন, ‘দলের হাইকমান্ড থেকে বলা হয়েছে, মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার জন্য। মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছি। নির্বাচন থেকে সরে যাবার আপাতত কোনো সিদ্ধান্ত নেই। প্রয়োজনে আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লড়বো। দল বহিষ্কার করলে করুক।’

প্রসঙ্গত, ১৯৮৯ সালের উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আফতাব উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেলেও তিনি বিএনপিপ্রার্থী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নিকট পরাজিত হন। ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন নবাগত খাদিজাতুল আনোয়ার সনিকে দেয়া হলে এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম তার গ্রামের বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন। যদিও পরে তিনি নির্বাচনে অংশ নেননি। তবে ওই নির্বাচনে মহাজোটের প্রার্থী নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হন আওয়ামী লীগে নেতা মরহুম ড. মাহমুদ হাসান।

ভন্ডারীকে ঠেকাতে মাঠে আরেক ভান্ডারী :

চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে মহাজোটের প্রার্থী তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীর বিরোধী শিবিরে হঠাৎ করে জড়িয়ে পড়েছেন আরেক ভান্ডারী। তবে তিনি নৌকা প্রতীক নিয়েও লড়তে চান। নজিবুল বশরকে চ্যালেঞ্জ জানাতে নির্বাচনের মাঠে নেমেছেন সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমদ মাইজভান্ডারী। সম্পর্কে তারা চাচা-ভাতিজা। নজিবুল বশর ভোটে লড়ছেন নৌকা প্রতীকে। আর ইসলামী ফ্রন্টের মোমবাতি প্রতীকে মনোনয়ন নিয়েছেন সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমদ মাইজভান্ডারী। তিনি প্রথমবারের মতো ভোটের মাঠে নেমেছেন।

স্থানীয়দের দাবি, ফটিকছড়ি আসনে মাইজভান্ডারী তরিকতপন্থীদের প্রায় এক লাখ ভোট আছে যেখানে এবার ভাগ বসাবেন সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমদ মাইজভান্ডারী। ফলে মহাজোটপ্রার্থী নজিবুল বশরের জন্য ভোটের তরী পাড়ি দেয়া আরও কঠিন হলো।

নিজের প্রার্থিতা নিয়ে সাইফুদ্দিন মাইজভান্ডারী বলেন, ‘চট্টগ্রাম-২ ও ঢাকা-১৪ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছি। প্রথমত নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করতে চাই। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাও হচ্ছে। তবে বিকল্প হিসেবে মোমবাতি প্রতীকও রেখেছি।’

তবে মহাজোট প্রার্থী নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী মনে করেন, আওয়ামী লীগ অনেক বড় সংগঠন। দলের ভেতর নানা মত থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। এখানে দলের চাইতে মার্কা বড়। তাই নৌকা যেহেতু তাকে দেয়া হয়েছে, সবাই তার পক্ষেই কাজ করবেন।

গত পাঁচ বছরে ফটিকছড়িতে কয়েক’শ কোটি টাকার উন্নয়ন হয়েছে। অনেক বড় বড় প্রকল্পের কাজ এখনও চলমান। মানুষ শান্তিতে আছে। নিশ্চয়ই এসবের মূল্যায়ন করবেন ভোটাররা- যোগ করেন তিনি।

বিগত নির্বাচনের ফলাফল

১৯৯১ সালে ফটিকছড়ি থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী। ১৯৯৬ সালে তার পরিবর্তে আওয়ামী লীগের তৎকালীন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের অর্থ বিষয়ক সম্পাদক রফিকুল আনোয়ারকে মনোনয়ন দেয়া হলে তিনি জয়ী হন। এরপর সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী বিএনপিতে যোগ দেন।

২০০১ সালে রফিকুল আনোয়ার ও নজিবুল বশরের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। জয়ী হন আওয়ামী লীগপ্রার্থী রফিকুল আনোয়ার। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে নৌকার প্রার্থী চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এ টি এম পেয়ারুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিশাল জয় পায় বিএনপি। এরপর নজিবুল বশর তরিকত ফেডারেশন গঠন করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাঁধেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে বিএনপিবিহীন নির্বাচনে তরিকত ফেডারেশন এ আসন থেকে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হয়।

আবু আজাদ/এমএআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।