সংসদে গৃহীত হয় সিদ্ধান্ত প্রস্তাব, বাস্তবায়ন হয় না

সিরাজুজ্জামান
সিরাজুজ্জামান সিরাজুজ্জামান , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৩:০৭ পিএম, ১৭ নভেম্বর ২০১৮

স্বাধীনতার পর সংসদে এমপিদের ভোটে ২৩টি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে বিদায়ী দশম জাতীয় সংসদেই চারটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু যত সমারোহে সিদ্ধান্ত প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করা হয়, তত গুরুত্ব দিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আইন করা বা ব্যবস্থা নেয়া হয় না। সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটির বিষয়ে মন্ত্রী কী ব্যবস্থা নিলেন-সেটি সংসদে জানানোর জন্য আইন আছে। কিন্তু কোনো মন্ত্রীই সেই নিয়ম মানেননি। জাতীয় সংসদ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সংসদে প্রথম পাস বা গৃহীত সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি ছিল- ‘বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্ত্রের রাজনীতি বন্ধ করে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হউক।’ কিন্তু এটা এখনও শতভাগ বাস্তবায়ন হয়নি।

সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি ১৪৩ এর (২) ধারা অনুযায়ী, গৃহীত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কোনো ব্যবস্থা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী পরে সংসদে তা জানাবেন। কিন্তু দশম সংসদে চারটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব পাস হলেও এ সম্পর্কে মন্ত্রীরা কে কী করেছেন-তা সংসদে জানানো হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিদ্ধান্ত প্রস্তাব সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা সংসদে জানাবেন-এটাই আইন। সেটা না মানাটা সংসদীয় চর্চার বড় ব্যাঘাত।’ 

সংসদের আইন শাখা-২ এর সূত্র জানায়, সিদ্ধান্ত প্রস্তাবগুলো সংসদ চলাকালীন বৃহস্পতিবার বেসরকারি দিবসে আনা হয়। এমপিদের আনা সিদ্ধান্ত প্রস্তাবে মন্ত্রী একমত না হলে তিনি ব্যাখ্যা করে সেই সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন। আর গ্রহণ করার হলে গ্রহণ করেন। তবে সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ বা প্রত্যাখান-দুটোই হ্যাঁ বা না ভোটে দিয়ে পাস করে নিতে হয়। ফলে এটি এক ধরনের আইনও বলা যায়। 

স্বাধীনতার পর যত সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ

জানা যায়, স্বাধীনতার পর সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহীত হয়েছে ২৩টি। সংসদের প্রথম সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি ছিল তৃতীয় সংসদে। এটি আনেন অ্যাডভোকেট মো. আছাদুজ্জামান (মাগুরা-২)। ১৯৮৭ সালে ৫ ফেব্রুয়ার আনা প্রস্তাবটি পাস হয় একই বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি। 

১৯৮৮ সালে চতুর্থ সংসদে বেগম হাসনা মওদুদ সিদ্ধান্ত প্রস্তাব আনেন-‘সংসদের অভিমত এই যে, বিনা অনুমতিতে বিপজ্জনক মাদকদ্রব্য প্রস্তুত, আমদানি, রফতানি, বিক্রয় ও বহন করিবার বা দখলে রাখিবার জন্য সর্বনিম্ন শাস্তি হিসেবে সাত বৎসরের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করে আইন করা হোক। এই প্রস্তাবটি পাস হওয়ার ৩০ বছর পর বর্তমান সরকারের শেষ সময়ে এসে ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮’ নামে একটি আইন করা হয়েছে। তারপরও বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ভয়াবহ মাদক ছোবল হেনেছে। 

১৯৮৯ সালে চতুর্থ সংসদে মিয়া আব্বাছউদ্দিন দেশের জনসংখ্যা সমস্যা ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি সংসদের বর্তমান অধিবেশনে আলোচনার জন্য সিদ্ধান্ত প্রস্তাব আনার পর তা পাস হয়। 

১৯৯০ সালের চতুর্থ সংসদে আবদুচ সাত্তার মাস্টার ‘কমন ফ্যাসিলিটি সেন্টার’ চালু করে লেদার ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের মসৃন (ফিনিশড) চামড়া উৎপাদনের সুযোগ দেয়ার প্রস্তাব আনার পর তা পাস হয়। 

মিয়া আব্বাছউদ্দিন চতুর্থ সংসদে লবণাক্ত পানি বন্ধের জন্য পানগুছি নদীর উভয় তীরে বেড়িবাঁধ নির্মাণ, একই বছরের একই সংসদে আদুর রাজ্জাক খান পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটায় একটি পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, মোক্তার হোসেন রেল যোগাযোগের ব্যবস্থা খুলনার রূপসা সেতু নির্মাণ, মসলেম উদ্দিন মোমেন রাজবাড়ি-কুষ্টিয়া মহাসড়ক পাকা করার কাজ ১৯৯১-৯২ অর্থ-বছরের মধ্যে শেষ করা নিয়ে সিদ্ধান্ত প্রস্তাব আনার পর তা পাস হয়। 

পঞ্চম সংসদে সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল (নরসিংদী-৪) দেশের প্রত্যেকটি হাসপাতালে নারীদের মৃতদেহ রাখার জন্য পৃথক মর্গের ব্যবস্থা, নুরুল ইসলাম মনি (বরগুনা-২) উপকূলীয় এলাকায় জলদস্যু দমনে নৌ-পুলিশ বাহিনী গঠন, আব্দুর রব চৌধুরী (লক্ষ্মীপুর-৪) লক্ষ্মীপুর জেলা সদর থেকে রামগতি সড়কটি পুরাতন থানা সদর রামগতি হাট পর্যন্ত সম্প্রসারণ, এবাদুর রহমান চৌধুরী (মৌলভীবাজার-১) মৌলভীবাজার জেলার অধীন সড়ক ও জনপথ বিভাগের মালিকানাধীন জুড়ী-বড়লেখা-শাহবাজপুর সড়কের বড়লেখা-শাহবাজপুর অংশ অবিলম্বে পাকা করার সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করে সংসদ।

একই সংসদে এ কে এম ফজলুল হক (ময়মনসিংহ-৪) ময়মনসিংহ জেলার শম্ভুগঞ্জ সেতুর নিকট থেকে ভাটি কান্দর-এর মধ্যদিয়ে চুরখাইয়ের কাছে ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ে পর্যন্ত বাইপাস রাস্তা নির্মাণের প্রস্তাব গ্রহণ করে সংসদ।

অষ্টম সংসদে মাত্র একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। মো. হাফিজ ইব্রাহিম (ভোলা-২) দেশের কৃষকদেরকে কৃষিকাজে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থাবিষয়ক সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি আনেন।

নবম সংসদে মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর (সিলেট-৩) আনা দেশের যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ, ইসরাফিল আলমের (নওগাঁ-৬) মুক্তিযোদ্ধা নয় এমন ব্যক্তিদের মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে নাম বাদ দিয়ে তালিকায় প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভুক্তকরণ, বেনজীর আহমদের (ঢাকা-২০) সংসদ কার্যক্রম যথাযথভাবে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরার জন্য ‘সংসদ বাংলাদেশ’ নামে একটি টিভি চ্যানেল স্থাপন করা বিষয়ে প্রস্তাব আনার পর তা গৃহীত হয়। এ ছাড়া বেনজীর আহমদের (ঢাকা-২০) আনা আরেকটি প্রস্তাব ছিল ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য যারা বাধাগ্রস্ত করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হোক’- তা-ও সংসদে গৃহীত হয়।

একই সংসদে জুনাইদ আহমেদ পলকের (নাটোর-৩) আনা অবিলম্বে দেশের সকল উপজেলা সদরে অন্তত একটি করে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করার প্রস্তাব পাস হয় বা গৃহীত হয়। এসব প্রস্তাবের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হয়েছে ও অনেকে দণ্ড পেয়েছেন। চালু হয়েছে সংসদ টিভিও। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা নয়-এমন ব্যক্তিদের মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ দেয়ার প্রস্তাব গত ১০ বছরেও চূড়ান্ত করতে পারেনি সরকার। প্রতিটি উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধও নির্মাণ হয়নি। 

দশম সংসদ যত সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ

বিদায়ী দশম জাতীয় সংসদে চারটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু একটিও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১৪ সালের ৩ জুলাই (দ্বিতীয় অধিবেশন) জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ (ঢাকা-৬) একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব আনেন। পরে তা পাসও হয়। তার সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি ছিল ‘যুদ্ধকালীন আদর্শিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা বিএলএফ-এর ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্যদের তালিকাটি জরুরিভিত্তিতে আনা হউক।’ কিন্তু আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

২০১৫ সালের ২৯ জানুয়ারি (পঞ্চম অধিবেশন) আওয়ামী লীগের মো. মনিরুল ইসলাম (যশোর-২) আরেকটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব আনেন। তার প্রস্তাবটি ছিল ‘অবিলম্বে মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনাদের একটি তালিকা করিয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হউক।’ এ সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের পর এ নিয়ে কাজ শুরু হলেও এখনও তা শেষ হয়নি। 

২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর (১২তম অধিবেশন) আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত নারী আসনের বেগম ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি আরেকটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব আনেন। ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের এবং যুদ্ধাপরাধীদের ও সকল মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী ব্যক্তিদের সকল স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হউক’-এ সিদ্ধান্ত প্রস্তাবটি বাস্তবায়ন করার জন্য আইন করার দরকার হলেও এখনও সেই উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

২০১৭ সালের ৪ মে (১৫তম অধিবেশন) আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত নারী আসনের বেগম ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি আরেকটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব আনেন। ‘গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারীদের শাস্তির জন্য আইন প্রণয়ন করা হউক’ এ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত প্রস্তাব পাস হলেও আইন হয়নি আজও। 

মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এ বিষয়ে জাগো নিউজকে বলেন, ‘সবগুলোরই যে কাজ হয়নি তা নয়, কিছু কিছু কাজ চলছে। সবগুলো বাস্তবায়ন হলেই সংসদকে অবহিত করা হবে।’

সংসদ নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী ড. ইফতেখারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘জাতীয় সংসদ একটি মহান জায়গা। এর গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু সেখানে গৃহীত কাজগুলো যদি গুরুত্ব না পায়, তাহলে জনগণের অধিকার খর্ব হয়। কারণ জনগণের প্রতিনিধিরাই সেখানে এসব সিদ্ধান্ত নেন।’

তিনি বলেন, ‘সংসদীয় কার্যক্রমকে শক্তিশালী করতে অবশ্যই সিদ্ধান্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবয়ন করতে হবে। বাস্তবায়ন যদি না করা হয়, টাকা খরচ করে এগুলো গ্রহণ করার দরকার কী!’

এইচএস/এসআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।