কঠিন হলেও বিরোধীপক্ষ খেলতে চাইবে এবার

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:০৭ পিএম, ০৬ নভেম্বর ২০১৮

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। রাজনীতি ও সমাজ বিশ্লেষক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।

নির্বাচন, সংলাপ ও রাজনীতির চলমান প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে পরিস্থিতি ফের সংঘাতের দিকে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের শেষটি থাকছে আজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ : সংলাপ ঘিরে সংকট উত্তরণের পথ খুঁজছেন অনেকে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সংলাপ থেকে আসলে বেশিকিছু কি আশা করা যায়?

আরও পড়ুন >> ফের ৫ জানুয়ারির কৌশল নিলে সংকট বাড়বে

হোসেন জিল্লুর রহমান : অন্ধকার পরিস্থিতিতে আলোর আশা করা যেতেই পারে। তবে সংলাপ থেকে ফল আসবে- এমন ধারণা বদ্ধমূল হলে ভুল হবে। একপ্রকার চাপ থেকে সংলাপের আয়োজন। কিন্তু যেভাবে সংলাপ আলোচনা ফিকে হচ্ছে, তা মূলত চাপকেই দুর্বল করা হচ্ছে।

জাগো নিউজ : চাপ বলতে কী বোঝাবেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান : বাংলাদেশের নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের পর্যবেক্ষণ আছে। আবার রাজনীতির নতুন মেরুকরণ ঘটেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে। সভা-সমাবেশের প্রসঙ্গও সামনে আসছে, যদিও এটি নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার।

সব মিলিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে আকাঙ্ক্ষার চাপ আছে। সরকার বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে খেলে সেই চাপ দুর্বল করার চেষ্টা করছে। সংলাপে সরকার খানিক চাপমুক্ত।

জাগো নিউজ : তাহলে বলতে চাইছেন, নির্বাচন ঘিরে সরকার চাপমুক্ত হতে পারছে?

হোসেন জিল্লুর রহমান : না। সরকারের কৌশলে খানিক দুর্বল হতে পারে চাপ। কিন্তু জনআকাঙ্ক্ষার চাপ দূর হয়নি। তবে মুহূর্তের যে চাপ ছিল, তা থেকে সরকার কিছুটা রেহাই পেয়েছে। চাপমুক্ত হবে, নাকি আরও তীব্র হবে- তা নির্ভর করবে বিরোধীপক্ষের সামনের দিনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং কৌশলের ওপর।

জাগো নিউজ : চাপ তীব্র হওয়া আবার দুর্বল হওয়ার এমন পরিস্থিতির মধ্যে রাজনীতি যাচ্ছে কোথায়?

হোসেন জিল্লুর রহমান : আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে। সংসদ ভেঙে না দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে না। সংসদ ভেঙে না দিয়ে তফসিল ঘোষণা করলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতেই পারে। কারণ এখন ট্র্যাডিশন হয়েছে, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করার। ছোট পরিসরে সরকার থাকতেই পারে। কিন্তু সংসদ না ভাঙলে নির্বাচনের মাঠ সমান্তরাল হবে না। আর এটিই মূলত জটিলতা সৃষ্টি করবে।

আরও পড়ুন >> রাষ্ট্র নয়, উন্নয়ন করছে সাধারণ মানুষ

কারণ অসমান্তরাল মাঠে বিরোধীপক্ষ কীভাবে খেলবে, সেটাই এখন চ্যালেঞ্জ। সরকার তাদের দাবি না মানলে খেলা তো আর থেমে থাকবে না। কঠিন হলেও বিরোধীপক্ষও খেলতে চাইবে এবার।

জাগো নিউজ : এমন খেলায় কী ফল আসবে?

হোসেন জিল্লুর রহমান : প্রশ্ন হচ্ছে, সংলাপের মাধ্যমে কিছু দাবির সমাধান, নাকি রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা তৈরি করা বা অক্ষুণ্ন রাখা! সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা চালিয়ে নেয়ার কোনো বিকল্প নেই।

জাগো নিউজ : এই মুহূর্তে বিএনপি বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কোন পথে হাঁটতে পারে বলে মনে করেন?

হোসেন জিল্লুর রহমান : আমার মনে হয়, ক্ষমতাসীনরা না মানলেও বিএনপি এখন এই দাবিগুলো নিয়ে দ্বারে দ্বারে যাবে। অফিসিয়ালি না মানলেও দাবির প্রতি জনসমর্থন আদায় করতে চাইবে এবং রাজনীতির মাঠে নিজেদের শক্ত অবস্থান দাঁড় করাতে পারবে।

কিন্তু বিএনপিও অবস্থান পরিষ্কার করতে পারেনি। যেমন- খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে নির্বাচন, নাকি তিনি জেলে থাকা অবস্থায়ই নির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি; এটি কিন্তু এখনও সুরাহা করতে পারেনি। এ দোটানা বিএনপির জন্য সংকট এবং ক্ষমতাসীনদের জন্য সুবিধারও বটে। যদিও প্রার্থী বাছাই, আসন বণ্টনসহ নানা প্রশ্নে উভয় জোটই সংকটে পড়বে।

জাগো নিউজ : বলা হচ্ছে, সরকারের কোর্টে বল। তাহলে কী বল নিয়ন্ত্রণে রেখে ‘৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন...

হোসেন জিল্লুর রহমান : কী ঘটবে তা বলা মুশকিল। সরকার আরও বেপরোয়া হতে পারে। আরও অসহিষ্ণু আচরণে বিরোধী শক্তিকে নিশ্চিহ্নের চেষ্টা করতে পারে। এর বিপরীতে বিরোধী জোটও অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে পারে। এই অনিশ্চয়তা তো আছেই।

আরও পড়ুন >> আসামের বাঙালি সংকট রোহিঙ্গা সমস্যাকেও ছাড়িয়ে যাবে

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন হবে না, তা বলা যেতে পারে। মৌলিক প্রশ্নে তখন আর এখনকার মধ্যে তফাৎ আছে। সরকার জুলুম করে, একতরফা নির্বাচন করে আর গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। সরকারও জানে, ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচনে গেলে বাংলাদেশ সইতে পারবে না। এমনকি আওয়ামী লীগের মধ্যকার অস্বস্তি আরও বাড়বে। এ কারণে সরকারও চাইছে নিয়ন্ত্রণে রেখে একধরনের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক।

সরকারের মধ্যে আর আগের ব্যাখ্যাও কাজে দিচ্ছে না। একতরফা নির্বাচনের দিকেও যেমন হাঁটতে পারে সরকার আবার তার ফলাফল নিয়েও শঙ্কিত তারা।

পাঁচ বছর চালিয়ে যেতে পারলেও পরবর্তী সময়ে সরকারের মধ্যে দ্বিচারিতা আছে।

জাগো নিউজ : বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক ধারা দুভাবে বিভাজিত। এক ভারত, আর বাকি বিশ্ব। বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের মনোবলের পরিবর্তন তো হচ্ছে না।

হোসেন জিল্লুর রহমান : সময় একদিন গড়ালেই বিশ্ব রাজনীতির পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত-চীন-আমেরিকার মধ্যে বাংলাদেশের ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্ব মিলেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে এখন অধিকমাত্রায় সম্পৃক্ত। এ কারণে ভারতনীতি সবসময় এক থাকবে, তা মনে করারও কোনো কারণ নেই।

জাগো নিউজ : তাহলে এই অনিশ্চয়তার মধ্যে বাংলাদেশ যাত্রার শেষ কোথায়?

হোসেন জিল্লুর রহমান : শেষ কোথায়, তা এক বাক্যে বলা যাবে না। অনিশ্চয়তার মধ্যেই হয়তো আশার আলো ফুটবে।

জাগো নিউজ : চলমান সংকট উত্তরণে আপনার পরামর্শ কী?

হোসেন জিল্লুর রহমান : সরকার নানা উন্নয়নের কথা বলে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। ভালো কথা। কিন্তু গণতন্ত্র আড়ালে রেখে উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না। আমি আশা করি, ক্ষমতাসীনরাও এখন তা বুঝতে পারছেন।

আরও পড়ুন >> দায় বাংলাদেশের সুবিধা নেবে ভারত

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে দ্বি-মাত্রিক সংকট রয়েছে। একটি হচ্ছে নির্বাচন ব্যবস্থাকেন্দ্রিক আরেকটি হচ্ছে উন্নয়ন ধারণার সংকট। উন্নয়নের নামে বৈষম্য, দুর্নীতি আর দুঃশাসন যেভাবে রাষ্ট্র, সমাজকে গ্রাস করছে তা অত্যন্ত ভয়ের কথা। সাধারণ মানুষ এই উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কর্মসংস্থান বাড়ছে না। বৈশ্বিক উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তরুণরা হতাশ হচ্ছে।

নির্বাচন সংকটের আলোচনায় উন্নয়ন ধারণার যে সংকট, তাও আড়ালে পড়ে যাচ্ছে। অথচ উন্নয়ন ভাবনা নিয়ে আরও জোরালো আলোচনা হওয়ার কথা। শিক্ষার মান নিয়ে আলোচনা নেই, ব্যাংক লুট হচ্ছে- আলোচনা নেই; অর্থপাচারের আলোচনা নেই, শেয়ারবাজারের হাজার হাজার কোটি টাকা চলে গেলো, আলোচনা নেই। এসব আলোচনা গুরুত্ব পেলেই রাজনীতির আলোচনা অর্থবহ হতো।

আমি মনে করি, রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির ব্যবস্থা নিয়ে সমান্তরালে আলোচনা হওয়া উচিত। এটি শুধু রাজনীতিবিদদের হাতে ছেড়ে দিলে হবে না, নাগরিক সমাজেরও দায়িত্ব আছে।

বাংলাদেশের শেষ কোথায়- এমন প্রশ্নে হতাশা না বাড়িয়ে বরং সার্বিক বিষয়ে প্রশ্ন তুলে সমাধানের পথ বের করাই এখন সময়ের দাবি। আমাদের সমাধান আমাদেরই বের করতে হবে।

এএসএস/এমএআর/পিআর

যেভাবে সংলাপ আলোচনা ফিকে হচ্ছে, তাতে মূলত চাপকেই দুর্বল করা হচ্ছে

সংসদ না ভাঙলে নির্বাচনের মাঠ সমান্তরাল হবে না। এটিই মূলত জটিলতা সৃষ্টি করবে

প্রার্থী বাছাই, আসন বণ্টনসহ নানা প্রশ্নে উভয় জোটই সংকটে পড়বে

সার্বিক বিষয়ে প্রশ্ন তুলে সমাধানের পথ বের করাই এখন সময়ের দাবি। আমাদের সমাধান আমাদেরই বের করতে হবে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।