লোকসানের ভারে ন্যুব্জ বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো

রফিক মজুমদার
রফিক মজুমদার রফিক মজুমদার , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৫:৩৩ পিএম, ২৪ অক্টোবর ২০১৮

একসময় নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ ছিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বিরুদ্ধে। লোকসানের বোঝায় ন্যুব্জ ছিল দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি। ধারাবাহিক ভর্তুকি ও সরকারের নানা উদ্যোগে ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে বিমান। ওই বছর লোকসান কাটিয়ে ৪৭ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করে সংস্থাটি। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিমানের মুনাফার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩২৪ কোটি টাকা।

বিমানের সেবার মান বিশ্বমানে উন্নীত করতে সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। ইতোমধ্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে গত আগস্টে যুক্ত হয়েছে প্রথম ড্রিমলাইনার ‘আকাশবীণা’। আসছে নভেম্বরে যুক্ত হচ্ছে দ্বিতীয় ড্রিমলাইনার। এছাড়া বিমানের ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ীকরণসহ নেয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ।

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটির ধারাবাহিক উন্নয়নে এতো উদ্যোগ নেয়া হলেও আকাশ পথে উন্নত যাত্রীসেবা নিশ্চিত করে আসা বেসরকারি খাতের এয়ারলাইনসগুলো বর্তমানে লোকসানের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বেসরকারি খাতের এয়ারলাইনসের যাত্রা শুরু হয় নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে। আকাশ পরিবহন সেবায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে নেয়া হয় নানা উদ্যোগ। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান থেকে যখন মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয় ঠিক তখন মানুষকে আকাশ পথে চলায় অভ্যস্ত করতে বিরাট ভূমিকা রাখে বেসরকারি এ খাত।

বৈরী ও প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে অগ্রসরমান বেসরকারি এ খাত একপর্যায়ে ‘শ্বেতহস্তী’ পুষতে পুষতে বাণিজ্যিকভাবে লোকসানের মুখে পড়তে থাকে। বিশ্ববাজারের তুলনায় বাংলাদেশে জেট ফুয়েলের মূল্য ও ল্যান্ডিং চার্জ বেশি হওয়ায় লোকসানের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়া ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, জিএমজি এয়ারলাইনস, বেস্ট এয়ার, এ্যারো বেঙ্গল এয়ারলাইনস, এয়ার পারাবাত মুখ থুবড়ে পড়ে।

সিভিল এভিয়েশনের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০ বছরে মোট ১২টি এয়ারলাইন্স অনুমতি পেলেও পরিচালনা শুরুর পর বন্ধ হয়ে যায় সাতটি। দুটি প্রতিষ্ঠান অনুমতি নিলেও কখনই পরিচালনায় আসেনি। এখন টিকে আছে মাত্র তিনটি বেসরকারি এয়ারলাইনস। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে বর্তমানে ইউএস-বাংলা, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ ও নভোএয়ার ফ্লাইট পরিচালনা করছে।

US-Bangla-02

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৯৫ সালে বেসরকারি এয়ারলাইনস এ্যারো বেঙ্গলকে আকাশপথে চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়। অনুমতি পেয়ে যাত্রা শুরু করতে সংস্থাটির দুই বছর সময় লাগে। ১৯৯৭ সালে প্রথম যাত্রী পরিবহন শুরু করলেও ১৯৯৮ সালে তাদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

যথেষ্ট আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় ইউনাইটেড এয়ারলাইনস ২০১৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়।

দেশের বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোর বর্তমান অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘দেশে জেট ফুয়েল ও উড়োজাহাজের ল্যান্ডিং চার্জ তুলনামূলক বেশি। সেই তুলনায় যাত্রী ভাড়াও কম। যে কারণে বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো অভ্যন্তরীণ রুটে তেমন লাভ করতে পারছে না।’

‘তবে দেশের মানুষকে আকাশ পথে চলায় অভ্যস্ত করতে বিরাট ভূমিকা পালন করছে বেসরকারি সংস্থাগুলো। আমরা লাভের চিন্তা না করে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অর্থাৎ দেশের পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে কানেকটিভিটি বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করছি।’

অভ্যন্তরীণ রুটে আকাশ পরিবহনে মানুষের আগ্রহের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও ঢাকা-সৈয়দপুর রুটে সবমিলে সপ্তাহে তিনটি ফ্লাইট চলাচল করতো। চাহিদা বাড়ায় বর্তমানে চলছে নয়টি ফ্লাইট।’

নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুল রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বেসরকারি এয়ারলাইনস খাত শুরু থেকেই নানা প্রতিকূল পরিবেশ আর প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে পথ চলছে। আধুনিক ও সুস্পষ্ট নীতিমালার অভাব এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।’

‘এয়ারলাইনসের মতো একটি অগ্রগামী ও ব্যতিক্রমী খাতের জন্য আমলাতন্ত্রের যে সম্যক ধারণা থাকার প্রয়োজন ছিল, তা কখনও দেখা যায়নি। ফলে শুরু থেকে বেসরকারি এয়ারলাইনস খাত একটি বৈরী ও প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে অগ্রসরমান। আবেদনের পরও হ্যাঙ্গার তৈরির জন্য স্থান বরাদ্দ হয়নি। অথচ এয়ারলাইনস ব্যবসা বিশাল পুঁজিনির্ভর।’

তিনি বলেন, ‘এ খাতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। ভর্তুকিনির্ভর হওয়ায় বিমান বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কমে টিকিট বিক্রি করে। কিন্তু বেসরকারি এয়ারলাইনসের সেই টাকায় টিকিট বিক্রি করে টিকে থাকা অসম্ভব। জনগণের করের টাকায় একটি অদক্ষ সংস্থাকে সুরক্ষা দিয়ে কার্যত ধনী গোষ্ঠীকে ভর্তুকি দেয়া কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়।’

US-Bangla-03

‘এ খাতের বাজার সম্প্রসারণে সরকারি নীতি-সহায়তার পাশাপাশি কিছু দাবি মানা হলেই বদলে যেতে পারে সার্বিক চিত্র’- যোগ করেন মফিজুল ইসলাম।

এ বিষয়ে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এ এম মোসাদ্দিক আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান। লাভ করা বিমানের একমাত্র লক্ষ্য নয়।’

‘রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিমান অনেক সুবিধা ভোগ করে। পাশাপাশি বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো কম সুবিধা পায় বলে বাণিজ্যিকভাবে সফল হচ্ছে না। অভ্যন্তরীণ গন্তব্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সঙ্গে বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোর একটা প্রতিযোগিতা আছে। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটির ভাড়ার পরিমাণও কম। এক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থাগুলো ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এভিয়েশন খাতে যার প্রভাব পড়ছে।’

প্রতিযোগিতামূলক বাজারে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের ভাড়ার পরিমাণ কম হওয়া প্রসঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মুখপাত্র শাকিল মেরাজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবাসী শ্রমিকদের গুরুত্ব অপরিসীম। এসব শ্রমিকের বিদেশে যাওয়া এবং দেশে আসার জন্য বিমান সর্বদা গ্রহণযোগ্য ভাড়া নির্ধারণ করে। বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোকে টার্গেট করে বিমান ভাড়া নির্ধারণ করে না।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে শাকিল মেরাজ বলেন, ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের তৈরি করা পাইলট ও ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো চলে। বিমান হচ্ছে একটি ইন্ডাস্ট্রি, যেখানে উৎপাদিত জনবল এ দেশের এভিয়েশন খাতকে সমৃদ্ধ করছে।’

আরএম/এমএআর/পিআর

দেশে জেট ফুয়েল ও উড়োজাহাজের ল্যান্ডিং চার্জ তুলনামূলক বেশি। সেই তুলনায় যাত্রী ভাড়া কম। যে কারণে বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো অভ্যন্তরীণ রুটে তেমন লাভ করতে পারছে না

জনগণের করের টাকায় একটি অদক্ষ সংস্থাকে সুরক্ষা দিয়ে কার্যত ধনী গোষ্ঠীকে ভর্তুকি দেয়া কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।