শৃঙ্খলা ফেরেনি সড়কে, শুধরায়নি পথচারী-চালক

আদনান রহমান
আদনান রহমান আদনান রহমান , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০১:১২ পিএম, ২০ অক্টোবর ২০১৮

>> বেড়েছে ওভারটেকিং, বন্ধ হয়নি পথচারীদের রাস্তা পারাপার
>> প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নির্দেশনাও মানা হচ্ছে না
>> ফুটপাত থাকলেও হাঁটার জায়গা নেই দোকানের জন্য
>> করিডোর ভিত্তিক সড়ক ব্যবস্থাপনা নির্মাণের পরামর্শ

প্রায় প্রতিদিনই ঢাকার সড়কে ঘটছে দুর্ঘটনা। এতে কেউ কেউ প্রাণ হারাচ্ছেন। আবার কাউকে বরণ করতে হচ্ছে চিরদিনের পঙ্গুত্ব। গত জুলাইয়ে বাসচাপায় রাজধানীর শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহতের পর আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। কোমলমতি শিশুদের দেখানো পথে কিছুদিন হাঁটা শুরুর পর আবারও চিরচেনা রূপ রাজধানীর সড়কে। বেড়েছে বাসের ওভারটেকিং, বন্ধ হয়নি পথচারীদের হাত দেখিয়ে রাস্তা পারাপার। শুধরায়নি কেউ, শৃঙ্খলা ফেরেনি রাজপথে।

সরেজমিন রাজধানীর গুলশান-১ ও ২ নম্বর গোল চত্বরে গিয়ে শত শত লোককে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হতে দেখা যায়। দীর্ঘদিন ধরে একই অবস্থা চলছে রাজধানীর হাতিরঝিল সড়কেও। কোনো ধরনের সিগন্যাল কিংবা হাত না দেখিয়েই সড়কের মাঝের বিভক্তির গাছের ঝাড় থেকে হুটহাট নেমে রাস্তা পার হতে দেখা যায় পথচারীদের।

road

একই অবস্থা ঢাকার দৈনিক বাংলা মোড়, কাকরাইল, বিজয় সরণি, বনানী কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, পুরানা পল্টন, সোনারগাঁও মোড়, গুলিস্তান, শাহবাগ, বাড্ডা লিংক রোড এলাকার। এসব সড়কের সিগন্যালে ঝুঁকি নিয়ে পথচারীরা রাস্তা পার হচ্ছেন। সড়কগুলোর কয়েকটিতে নেই জেব্রা ক্রসিং, যেগুলোতে আছে সেগুলো ব্যবহার না করে মাঝ সড়ক দিয়ে পার হতে দেখা যায় পথচারীদের।

হাতিরঝিলে মাঝ সড়ক দিয়ে পার হওয়ার কারণ জানতে চাইলে সোহেল রানা আকাশ নামে এক পথচারী বলেন, ‘প্রয়োজনীয় স্থানে নেই ফুটওভার ব্রিজ। নেই ওভারপাস, জেব্রা ক্রসিং। তাই হেঁটে পার হওয়া ছাড়া উপায় নেই। তবে এটা ঠিক, সড়কে হাত দেখিয়ে আমাদের পারাপার হওয়া উচিত নয়।’

কারওয়ান বাজারের সোনারগাঁও মোড়ের জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পার হওয়া গৃহবধূ মাহবুবা রহমান নূপুর বলেন, ‘সড়কে চলাচলে চালক-পথচারী উভয়ের মনোযোগ সমান হওয়া জরুরি। তবে অনেক রাস্তায় জেব্রা ক্রসিংয়ের দাগ নেই, থাকলেও সেগুলো অগুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে। অনেক স্পিড ব্রেকারের ওপরও সাদা দাগ দেয়া নেই। ওভারব্রিজ তো অনেক জায়গায়ই নেই। ফুটপাত থাকলেও দোকানের জন্য হাঁটার জায়গা নেই। এ ব্যাপারে পুলিশ কার্যকর ব্যবস্থা নিলে পথচারীরাও সচেতন হবে।’

road

ঢাকার সড়ক ও ফুটপাত কতটুকু পথচারীবান্ধব? জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমান সড়ক ব্যবস্থাপনা পথচারীবান্ধব নয়। একে পথচারীবান্ধব করতে হলে করিডোর ভিত্তিক সড়ক ব্যবস্থাপনা নির্মাণ করতে হবে। পথচারীর প্রয়োজন, পথচারীর স্বাচ্ছন্দ্য, যানবাহন ও পথচারীর সংখ্যা অনুযায়ী যেমন বাসস্টপ ছাউনি, অন্যান্য নাগরিক সুবিধা যেমন- টয়লেট, পানি পানের জায়গা এবং প্রতিবন্ধী ও বৃদ্ধদের জন্য সেই উপযোগিতা সংযোজিত চলার ব্যবস্থাকে পথচারীবান্ধব বলা যাবে। এছাড়া কোনো সড়কে যদি গাড়ির চেয়ে পথচারী বেশি হয় তাহলে সেই সড়কে ফুটপাতের পরিমাণ গাড়ির চেয়ে বেশি হবে- এমন অনুপাতে ফুটপাত ও সড়ক তৈরি করতে হবে। এটি সমীক্ষানির্ভর পেশাজীবীদের কাজ। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সড়ক পথচারীবান্ধব করতে হলে এ কাজ নিশ্চিত করতে হবে।’

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর বাসের বেপরোয়া চলাচল অনেকটা কমে এসেছিল। বর্তমানে তা আবারও বেড়েছে। ২৯ সেপ্টেম্বর সকালে মহাখালীর জাহাঙ্গীর গেটের সামনে ভিআইপি পরিবহনের একটি বাস একাত্তর টিভির মার্কেটিং বিভাগের কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেনকে ধাক্কা দেয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে মৃত্যু হয় তার। পরবর্তীতে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ভিআইপি পরিবহনের বাসটি বেপরোয়া গতিতে একটি সিএনজিকে ধাক্কা দিয়ে পালানোর সময় সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আনোয়ার ও তার মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়।

২ সেপ্টেম্বর মিরপুরে ঈগল পরিবহনের একটি র‌্যাকার করা বাসের চাপায় উত্তম কুমার নামে পুলিশের এক উপ-পরিদর্শক (এসআই) নিহত হন। বাসটি ঘটনার দু’দিন আগে আরেকটি মোটরসাইকেলকে চাপা দিয়েছিল। এটি জব্দ করে থানায় নিয়ে যাচ্ছিলেন উত্তম। পেছন থেকে তাকে ধাক্কা দেয় বাসচালক।

road

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সড়ক নিরাপদ রাখতে বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দেয়া হয়। তবে প্রথম কয়েকদিন মানলেও বর্তমানে সেগুলো অবজ্ঞা করছে বাসগুলো। নির্দেশনার মধ্যে ছিল- বাসের দরজা বন্ধ ও স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠা-নামায় নিষেধাজ্ঞা, বাসে দৃশ্যমান দুটি স্থানে চালক ও হেলপারের ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর, মোবাইল নম্বর প্রদর্শন, চালক ও যাত্রীর সিটবেল্ট ব্যবহার এবং পরিবহন মালিকদের সিটবেল্ট সংযোজন, যেসব সড়কে ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাস রয়েছে সেসব স্থানের উভয় পাশে ১০০ মিটারের মধ্যে রাস্তা পারাপারে নিষেধাজ্ঞা। তবে এগুলোর কোনোটিই মানছেন না বাসচালক-মালিক ও পথচারীরা।

কথা হয় মতিঝিল থেকে মোহাম্মপুর রুটে চলাচলকারী দীপন পরিবহনের একটি বাসের চালক মাহবুব হোসেনের সঙ্গে। ১৩ বছর ধরে বাস চালালেও সিটবেল্ট পরা তো দূরের কথা কখনও বাসে সিটবেল্ট দেখেননি তিনি। জাগো নিউজকে মাহবুব বলেন, ‘কোনো গাড়িতেই সিটবেল্ট থাকে না। সিটবেল্ট থাকলে পরবো। ‘আমরা বেপরোয়া গাড়ি চালাই না, অনেক সড়কে রিকশা আর সিএনজি অটোরিকশা চলে। তাদের কারণে আমাদের সাইড কেটে যেতে হয়।’

এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অনেক মালিক এখনও চুক্তিতে চালকদের বাস চালাতে দিচ্ছেন। এতে স্ব স্ব কোম্পানির বাসের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা দেখা যায়, চালকরা বেপরোয়া হচ্ছেন, বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। সিএনজিচালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ।

road

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি রুস্তুম আলী খান বলেন, ‘চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চলাচল বন্ধে আমাদের সাংগঠনিকভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে সংগঠনের নির্দেশ অমান্য করে কিছু কিছু গাড়ি এখনও চুক্তির ভিত্তিতে চলাচল করছে- এটা আমি অস্বীকার করি না। আমরা যাচাই-বাছাই করছি। কেউ নির্দেশ অমান্য করে চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালালে তাদের লাইন (রুট) বন্ধ করে দেয়া হবে।’

‘নির্দিষ্ট স্টপেজে না থেমে যেখানে-সেখানে থামা, বেপরোয়া গতি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশ অমান্য করা’- কেন বন্ধ হচ্ছে না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের একার দোষ নয়। একজন যাত্রী নির্ধারিত স্টপেজে নামতে চান না। যে যেখানে যাবে ঠিক সেখানেই নামাতে বলে, চালকদের ওপর প্রভাব খাটায়। চালকদের বাধ্য হয়ে সেখানে থামতে হয়। এককভাবে আমরা ঠিক হলে শৃঙ্খলা আসবে না, যাত্রী ও পথচারীকেও সচেতন হতে হবে।’

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহানগর সিএনজিচালিত অটোরিকশা মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ আহ্বায়ক বরকত উল্লাহ ভুলু জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা চালকদের প্রতিনিয়তই শৃঙ্খলা মেনে গাড়ি চালাতে বলি। ডানে-বামে দেখে ওভারটেকিং করতে বলি। ঢাকা শহরে মুখ দিয়ে অনেক কিছু বলা যায় কিন্তু বাস্তবে রাস্তায় গেলে দেখা যায় সব উল্টো। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় রাস্তার পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল, এখন আবার পূর্বের চিত্র। একটু ফাঁক পেলেই একটা গাড়ি মাথা ঢুকিয়ে রাস্তা আটকে দেয়। বিশেষ করে মোটরসাইকেলগুলো যা ইচ্ছা তাই করছে। একটা দুর্ঘটনা ঘটলে যাত্রী-চালকের পাশাপাশি মালিকেরও ক্ষতি হয়। তাই আমরা সবসময় তাদের শৃঙ্খল হতে বলি।’

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘পরিবহন খাতের সর্বাঙ্গে সমস্যা, সর্বাঙ্গে ব্যথা। এ থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের সময় লাগবে। কেননা আমাদের চালক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় গলদ রয়েছে, ফিটনেস প্রক্রিয়ায় গলদ রয়েছে। নিরাপদ পরিবহনের জন্য তিনটা অর্গান রয়েছে। নিরাপদ চালক, নিরাপদ যানবাহন এবং নিরাপদ রাস্তা- এ তিন জায়গায় আমাদের গলদ। আমরা লক্ষ্য করেছি, এসব জায়গায় যতক্ষণ পর্যন্ত সংশোধন না করা হবে ততক্ষণ সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না।’

এআর/এনডিএস/এমএআর/এমবিআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।