বেরোবির গবেষণা ইনস্টিটিউটের নামে দুটি ট্রেড লাইসেন্স

মুরাদ হুসাইন
মুরাদ হুসাইন মুরাদ হুসাইন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৫:৩৮ পিএম, ১৮ অক্টোবর ২০১৮

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) দশম সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মো. আবদুল হামিদ যখন বলেছিলেন শিক্ষাকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত না করার কথা। ঠিক তখনই উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) ড. ওয়াজেদ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের নামে দুটি ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া হয়েছে।

বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটাকে ব্যবহারের পাঁয়তারা চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। আর এ ট্রেড লাইসেন্স নেওয়ার অভিযোগ উঠছে ইনস্টিটিউটের পরিচালক উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বলছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সুপারিশ ও আচার্যের অনুমোদন নিয়ে ২০০৯ সালে ড. ওয়াজেদ রিসার্স ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ২০১১ সালের মার্চ মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭তম সিন্ডিকেট সভায় এ ইনস্টিটিউটে এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি করানোর সিদ্ধান্ত হয়। যার মূল কাজ গবেষণা, উচ্চ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়া । কিন্তু সম্প্রতি ইনস্টিটিউটকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের আওতায় নিয়ে আসা হয়।

এর অংশ হিসেবে রংপুর সিটি কর্পোরেশন থেকে দুটি ট্রেড লাইসেন্সে নেওয়া হয়। যেখানে প্রোপাইটর হিসেবে রয়েছেন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অর্থাৎ উপাচার্য নিজেই। ট্রেড লাইসেন্সের একটিতে ব্যবসার ধরনে উল্লেখ রয়েছে ‘শিক্ষামূলক কনসালটেন্সি’ আর একটিতে ‘রিসার্চ সেন্টার’ হিসেবে। লাইসেন্স দুটির মেয়াদ আগামী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত থাকবে বলেও লাইসেন্সে উল্লেখ করা হয়েছে।

ট্রেড লাইনসেন্স দুটির মধ্যে একটির নম্বর ইখ-২০১৮-১৯০০০২৪১ এবং অন্যটির নম্বর ইখ-২০১৮-১৯০০০২৪২। এছাড়াও চলতি বছরের আগস্টে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে ইনস্টিটিউটকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে খোলা হয়েছে ট্যাক্স পেয়ারর্স ও বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর।

ইনস্টিটিউটের বোর্ড অব গভর্নর ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোরশেদ হোসেনের কাছে জানতে চাওয়া হয়। বৈধভাবে যেকোনো ব্যবসা পরিচালনার জন্য ট্রেড লাইসেন্স করা বাধ্যতামূলক। ব্যবসা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এটি ব্যবহারযোগ্য নয়। তবে কেন ইনস্টিটিউটের নামে ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা বাণিজ্যিকীকরণের মতো কোনো বিষয় নয়। ইনস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য ট্রেড লাইসেন্স এবং ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (টিআইএন) দরকার হয়। বিভিন্ন প্রজেক্ট জমাদানে এসব কাগজপত্র চাওয়া হয়। ইনস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ প্রদান ও কনসালটেন্সির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপার্জন বাড়াবে বলেও জানান তিনি। এক্ষেত্রে ইউজিসির অনুমতির প্রয়োজন নেই বলেও জানান তিনি।

যোগাযোগ করলে ইনস্টিটিউটের আরেক বোর্ড অব গভর্নর সদস্য ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সরিফা সালোয়া ডিনা এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি ব্যস্ত আছেন বলে জানান।

তবে ড. ওয়াজেদ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. মো. রোকনুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাধারণতো লাভজনক প্রতিষ্ঠান যেমন এনজিওর ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক লাইসেন্স (ট্রেড লাইসেন্স) প্রয়োজন হয়। কারণ তারা ট্রেনিং দেন অর্থ উপার্জনের জন্য। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। লাভের আশায় ইনস্টিটিউট পরিচালনা করলে গবেষণা থেকে প্রতিষ্ঠানটির বিচ্যুতি ঘটবে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও ইনস্টিটিউটের একাডেমিক কমিটির সদস্য ড. গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনিও এ বিষয়ে সদুত্তর দিতে পারেননি। পরে জেনে জানাবেন বলে জানান।

রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার কাছে জানতে চাওয়া হয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান না হয়েও কেন ইনস্টিটিউট এবং ট্রেনিং সেন্টারের নামে পৃথক দুটি ট্রেড লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এর উত্তরে মেয়র বলেন, ‘ওই প্রতিষ্ঠানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রেড লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার এখতিয়ার সিটি কর্পোরেশনের রয়েছে।’

এদিকে, ২০০৯ সালের ৩ ডিসেম্বর ড. ওয়াজেদ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রথম গবেষক ভর্তি করা হয় ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে। ১৫ জন এমফিল ও আটজন পিএইচডি কোর্সে আবেদনকারীর নাম, তাদের গবেষণার শিরোনাম ও তত্ত্বাবধায়কের নাম অনুমোদিত হয়। যার সিলেবাস প্রণয়ন হয় ২০১৮ সালে এসে। ইনস্টিটিউটি ২০১২ সালের পর সম্প্রতি ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের এমফিল ও পিএইচডি ভর্তির আবেদনও গ্রহণ করেছে।

অপরদিকে ৯ মাস ধরে কাজ বন্ধ রয়েছে ড. ওয়াজেদ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের। এ নিয়ে গত ২৯ সেপ্টেম্বর ‘শেখ হাসিনা হল ও ড. ওয়াজেদ ইনস্টিটিউটের নির্মাণ কাজ বন্ধ’শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে জাগো নিউজ।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মতিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনার ধারণা যায় না। কারণ এটা কোনো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত নয়। যদি কেউ ব্যবসায়িক লাইসেন্স নিয়ে থাকেন তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ ইব্রাহীম কবীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইনস্টিটিউটের ব্যাপারে শুধু তার পরিচালক (উপাচার্য) বলতে পারেন।’ লাইসেন্স নেওয়ার ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না বলেও জানান।

সার্বিক বিষয়ে জানতে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

এদিকে ইউজিসির সদস্য (সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) দীল আফরোজা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘কেমন করে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য ট্রেড লাইসেন্স নিলেন সেটা আমাদের জানা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ইনিস্টিউটের নামে কোনো ট্রেড লাইসেন্স নিতে পারে না। এখন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ট্রেড লাইসেন্স নেই। বেগম রোকেয়াতে কেন উপাচার্য এমন ট্রেড লাইসেন্স নিলেন তা আমরা খোঁজ খবর নেব। যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান করার প্রমাণ পাওয়া যায় তবে ইউজিসির পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এমএইচএম/সজীব হোসাইন/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।