বদলে যাচ্ছে হাজারীবাগ

আবু সালেহ সায়াদাত
আবু সালেহ সায়াদাত আবু সালেহ সায়াদাত , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:২৭ পিএম, ১৪ অক্টোবর ২০১৮

একসময় রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকায় অবস্থিত ট্যানারিগুলোর বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্যে ক্রমাগত দূষিত হতো পরিবেশ। মাত্রাতিরিক্ত দূষণে হাজারীবাগের পানির রঙ হয়ে উঠেছিল কালো, ধূসর ও গাঢ় নীল। বেশিরভাগ কারখানায় ছিল না বর্জ্য পরিশোধনাগার। কারখানাগুলোর বর্জ্য সরাসরি ফেলা হতো নদীতে। যত্রতত্র ট্যানারি বর্জ্যের উৎকট দুর্গন্ধে এ এলাকায় বসবাস করাই ছিল দায়।

ক্রমাগত পরিবেশ দূষণ ও স্থানীয়দের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে গত বছর থেকে হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সেখানে ২০০ একর এলাকাজুড়ে পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগর গড়ে তোলা হয়।

এদিকে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় পাল্টে যাচ্ছে এলাকার সার্বিক চিত্র। কিছুদিন আগেও কেউ এখানে বসবাসের চিন্তা করতেন না। এলাকাটি ছিল ট্যানারি শ্রমিক ও নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস। কিন্তু এখন চিত্র পাল্টে গেছে। যে জমি বিনামূল্যে দিলেও কেউ নিতে চাইতেন না সেই হাজারীবাগ এখন হীরার টুকরায় পরিণত হয়েছে। হীরার দাম দিয়েও মিলছে না হাজারীবাগের এক টুকরা জমি।

jagonews

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা হাজারীবাগ ঘিরে নানা উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ইতোমধ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) হাজারীবাগ ট্যানারি এলাকার ভূমি পুনঃউন্নয়নের মাধ্যমে বসবাসের উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করেছে। এখানে বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

একটি উন্নত আবাসিক এলাকার মতো এখানে থাকবে পার্ক, খেলার মাঠ, কমিউনিটি সেন্টার, মার্কেট, ইনডোর গেমস, সুইমিংপুল, ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়সহ নানা ব্যবস্থা।

এ বিষয়ে রাজউকের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, হাজারীবাগ ট্যানারি এলাকার ভূমি উন্নয়নের মাধ্যমে বসবাসের উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে আমরা গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে ট্যানারি মালিক অ্যাসোসিয়েশন, স্থানীয় বাসিন্দা ও নগর পরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, আমরা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছি। তারা জানিয়েছেন, হাজারীবাগ ট্যানারি এলাকায় যে কোনো প্রকল্প হাতে নেয়ার পূর্বে সেই এলাকার ভূমির মান বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরীক্ষা করতে হবে। এখানকার ভূমির পুনঃউন্নয়নে পর্যাপ্ত উন্মুক্ত স্থান রাখার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা গুরুত্বারোপ করেছেন। উন্মুক্ত স্থান বা জনসমাগমস্থল যেমন- পার্ক, খেলার মাঠগুলোতে সব শ্রেণি-পেশার, বয়স ও পক্ষাঘাতগ্রস্তদের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা রেখে নকশা করতে হবে। বাসযোগ্য পরিবেশ নিশ্চিতে পর্যাপ্ত জলাধার ও গাছপালা রাখার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।

‘বিশেষজ্ঞরা জানান, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার উপযোগী করে ভবনের নকশা করতে হবে। ভূমিকম্প প্রতিরোধী হিসেবে ভবন নির্মাণ এবং সেগুলো থেকে জরুরি প্রস্থানের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এছাড়া নির্ধারিত স্থানে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রেখে পুরো এলাকার গাড়ির চলাচল নিয়ন্ত্রণে রেখে হাঁটা ও সাইকেল ব্যবহারের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।’

jagonews

আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘বিশেষজ্ঞরা একটি কমিউনিটি ভবনের ধারণা দিয়েছেন। যেখানে একই ভবনে কমিউনিটি সেন্টার, মার্কেট, ইনডোর গেমস, সুইমিংপুল ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় থাকবে।’

হাজারীবাগ এলাকা ঘিরে রাজউক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে এবং বিশেষজ্ঞদের আরও মতামত নেয়া হচ্ছে বলেও জানান রাজউকের এই ইমারত বিশেষজ্ঞ। হাজারীবাগ এলাকায় প্রাথমিক জরিপ সম্পন্ন হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জরিপে দেখা গেছে, হাজারীবাগ ট্যানারি এলাকার আয়তন ৫৯.৩৫ একর। এখানে ইমারতের মোট সংখ্যা ৮৫৫টি। এর মধ্যে শিল্প-কারখানা প্রায় ৬০০টি।’

স্থানীয়রা জানান, প্রায় ৭০ বছরের পুরনো হাজারীবাগের চামড়াশিল্প। রাজধানীর বুড়িগঙ্গাঘেঁষে গড়ে ওঠে এটি। চামড়ার দুর্গন্ধ নিয়ে বসবাস ছিল এ এলাকার মানুষের। চামড়া প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য, লবণ ও অপরিশোধিত বর্জ্যের কারণে এ এলাকার আকাশ-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তীব্র দুর্গন্ধ। দূষিত হয় পরিবেশ। হাজারীবাগ ছাড়িয়ে আশপাশের আবাসিক এলাকায়ও এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

হাজারীবাগের পাশেই অভিজাত এলাকা ধানমন্ডি। হাজারীবাগের চামড়া নগরীর বিরূপ প্রভাব ধানমন্ডি এলাকায়ও পড়তে শুরু করে। সবদিক বিবেচনা করে সরকার ও বিদেশিদের আর্থিক সহায়তায় এ শিল্পনগরী স্থান পায় সাভারে। এতদিন অনেকেই মনে করেছিলেন, সাভারে যতই চামড়া শিল্পনগরী হোক না কেন, বাপ-দাদার তৈরি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কেউ ছেড়ে যাবেন না। কিন্তু সরকারের চাপে তারা বাধ্য হন হাজারীবাগ ছাড়তে।

স্থানীয় ষাটোর্ধ্ব হাজি করম আলী জাগো নিউজকে জানান, ব্যবসায়ীদের হাজারীবাগ ছাড়ার ঘোষণার পরপরই এ এলাকার আবাসিক জমির গ্রাহক বেড়ে গেছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে জমির দাম।

তিনি জানান, নব্বই দশকে এ এলাকায় প্রতি শতাংশ জমির মূল্য ছিল মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। কিছুদিন আগেও নামমাত্র মূল্যে বেচাকেনা হয়েছে জমি। কিন্তু ট্যানারি স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরুর পরপরই এক লাফে যেন আকাশছোঁয়া মূল্য। বর্তমানে কোটি টাকায়ও এক শতাংশ জমি পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণের জন্য ডেভেলপাররা এসব জমির মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছেন।

jagonews

‘৮-১০ বছর আগে হাজারীবাগ ট্যানারির আশপাশের প্রতি শতাংশ জমি বিক্রি হতো নয় থেকে ১০ লাখ টাকায়। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে কোটি টাকায়। আগে জমি ছিল, ক্রেতা ছিল না। এখন ক্রেতা আছে কিন্তু বিক্রির মতো জমি নেই’- বলেন হাজি করম আলী।

ট্যানারি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর নারায়ণগঞ্জ থেকে বাংলাদেশে ট্যানারি কারখানার সূত্রপাত । পরে নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্যানারি কারখানা স্থানান্তর করে ১৯৫০ সালে হাজারীবাগের ট্যানারি অঞ্চলে আনা হয়। বাঙালি মালিকানায় থাকা ঢাকা ট্যানারি এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিগ্রহণে থাকা ২১টিসহ মোট ২২টি প্রতিষ্ঠান দিয়ে হাজারীবাগে শুরু হওয়া ট্যানারি শিল্প ধীরে ধীরে জমজমাট হয়ে ওঠে। ১৯৬৬ সালের দিকে ট্যানারির সংখ্যা বেড়ে ২০০ ছাড়িয়ে যায়। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৬ সালে পাকিস্তান সরকারের অধিগ্রহণে থাকা ২১টি ট্যানারি বেসরকারি খাতে দেয়া হয়। ১৯৭৬ সালের পর ছোট ছোট কিছু ট্যানারি গড়ে উঠলেও বড় কোনো ট্যানারি গড়ে ওঠেনি।

যত্রতত্র ট্যানারি নির্মাণ ও বর্জ্য শোধনাগারের ব্যবস্থা না থাকায় হাজারীবাগসহ আশপাশের এলাকা ব্যাপকভাবে দূষিত হতে থাকে। একপর্যায়ে এলাকাটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে ওঠে। এছাড়া ট্যানারি থেকে নির্গত দূষিত বর্জ্য সরাসরি বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলায় বিষাক্ত হয় এর পানি। ২০০১ সালে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কারখানাগুলো সরিয়ে নিতে ২০০৩ সালে সাভারে পরিবেশবান্ধব চামড়াশিল্প নগরী নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার।

jagonews

কিন্তু আদালতের নির্দেশনা ও সরকারের শত চেষ্টা উপেক্ষা করে হাজারীবাগে চলতে থাকে ট্যানারির কার্যক্রম। অবশেষে গত বছর ৩০ মার্চ হাজারীবাগে থাকা ট্যানারিগুলোর সব কার্যক্রম ৬ এপ্রিলের মধ্যে বন্ধ করা হলে জরিমানা মওকুফের বিষয়টি বিবেচনার কথা জানান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে ট্যানারি কারখানাগুলোর গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্নের আদেশও বহাল রাখেন আদালত। পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে হাজারীবাগে সব ধরনের ট্যানারি কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হন মালিকরা।

এএস/এমএআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।