জয়ের এলাকার পরাজিত সৈনিক নয়া মিয়া


প্রকাশিত: ০১:০৩ পিএম, ১৩ আগস্ট ২০১৫

সময় তখন ঠিক দুপুর দুইটা।  রংপুর থেকে মোটরসাইকেলযোগে গিয়ে থামলাম পীরগঞ্জের ড. ওয়াজেদ আলী তোরণের সামনে একটি গাছের নিচে। প্রচণ্ড রোদ ছিল সেদিন।  পাশের একটি হোটেলে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হলাম।  এরপর হোটেলে বসতেই জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম আনুমানিক ৭০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি ভ্যানের ওপর বসে ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছেন।  দেখে মনে হয়েছিল হাঁপানি রোগী তিনি।  এরপর ভাবলাম কোনো পথচারী হয়তোবা রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভ্যানটি ফাঁকা পেয়ে বসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন।  কিন্তু মন মানছিল না।

বারবার মনে হচ্ছিল কাছে গিয়ে দেখি সমস্যা কি? এমন সময় মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগলো, হতে পারে ভ্যানের ওপর বসে থাকা ওই বৃদ্ধই ভ্যানের চালক। মাথার মধ্যে এই প্রশ্নটা জাগামাত্রই উঠে গেলাম ভ্যানটির কাছে।  কাছে গিয়ে দেখলাম ঘাঁমে তার সারা শরীর ভিজে গেছে।  মাথার দুপাশ থেকে চুয়ে চুয়ে ঘাঁমের পানির ফোটাগুলো মাটিতে পড়ছে।  যে স্থানটিতে ঘাঁমের ফোটাগুলো পড়ছে সেদিনের প্রচণ্ড রোদের কারণে দ্রুত মাটি তার ঘাঁমগুলো চুষে নিচ্ছে।  ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো কথায় হয়নি তার সঙ্গে।  চেয়ে চেয়ে শুধুই দেখছিলাম বৃদ্ধ এই চাচার ক্লান্তি ভরা মুখের অংশটুকু।  কালো এই মানুষটিকে রোদের কারণে সেদিন আরো কালো লাগছিল।  অনেকক্ষণ চাচার দিকে চেয়ে থেকে জানতে চাইলাম, চাচা ভ্যানের মালিক কই।  তিনি বললেন, কেন, কোথায় যাবেন? চাচার এই উত্তর আমাকে নিশ্চিত করলো তিনিই ভ্যানটির চালক।

চাচা আপনিতো খুব ক্লান্ত, রোজা আছেন? জিজ্ঞেস করতেই চাচা বললেন, বুড়া বয়সে রোজা না করে পারা যায়।  তবে খুব কষ্ট হয় বাবা।  রোজা রেখে ভ্যান চালানো খুব কষ্টকর।  জানতে চাইলেন, কোথায় যাব? কোথাও না বলাতেই কেমন যেন খুশী হলেন তিনি।

ঘটনাটি গত রমজানের।  সময়ের অভাবে চাচার এই কাহিনী লিখতে বসতে পারিনি।  দেরিতে প্রকাশ করায় আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

ফিরে আসি আগের কথায়।  এরপর চাচার অনুমতি নিয়ে ভ্যানের ওপরে গিয়ে বসলাম।  চাচা আপনার সঙ্গে একটু গল্প করি? চাচা বললেন, কি আর গল্প করবেন।  গল্প করার মতো সময় কি আর আমাদের আছে বাবা।  চাচা রোজা রেখে ভ্যান চালানো খুব কঠিন, বাড়িতে কি কেউ নেই আপনার। উত্তরে বললেন, এক মেয়ে ছিল বিয়ে দিয়েছি।  এখন বাড়িতে শুধু আপনার চাচি আর আমি।  সারাদিন ভ্যান চালিয়ে যা হয় তা দিয়েই সংসার চলে।  তবে ভ্যানটি নিজের হওয়ায় অনেক রক্ষা পেয়েছি।  কারণ অনেক দিন ভাড়া পাওয়া যায়না।  ভ্যানটি মালিকের হলে সেদিনও জমা দিতে হতো।

প্রধানমন্ত্রীর শ্বশুর বাড়ির এলাকার মানুষ আপনি, এখনো এতো কষ্ট করতে হচ্ছে আপনাকে।  এ কথা বলাতেই রেগে গেলেন তিনি।  বললেন, সেজন্যতো আজো একটি বয়স্ক ভাতার কার্ড পাইলাম না।  ১০ বছর ধরে একটি কার্ডের জন্য ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে গেছি।  ওই কার্ড আর মরার আগে জুটবে না। শেষ দিন পর্যন্ত রিকশা চালিয়েই সংসার চালাবো।

তিনি বলেন, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়েছে ঠিকই।  কিন্তু, এ এলাকার কোনো দরিদ্র মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি।  ঘটেছে শুধু নেতাদের।

worker

দুজনের আলাপচারিতা প্রায় একঘণ্টা কেটে গেল।  কিন্তু শেষ হচ্ছেনা চাচার কষ্টে ভরা কথাগুলো।  দীর্ঘ এই আলাপচারিতা আমাকে বুঝিয়ে দিল পীরগঞ্জের হতদরিদ্র মানুষগুলোর মুখে ক্লান্তির ছাপ কতটা স্পস্ট।  এরমধ্যে সবচেয়ে বড় ছাপটি হলো রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার দোবরাজপুর গ্রামের ৬৮ বছর বয়সি নয়া মিয়ার।  এরমধ্যে ৫০ বছর তিনি পীরগঞ্জেই ভ্যান ও রিকশা চালিয়ে কাটিয়েছেন।  পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় নয়া মিয়া। অন্যসব ভাই-বোনরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন বিভিন্ন জেলায়।  কিন্তু, এলাকা ছাড়েন নি তিনি।  শত অভাব অনটনের মাঝেও আকড়ে ধরে আছেন পীরগঞ্জের মাটি।

৫৫ বছরে অনেকের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটলেও সামান্যতম পরিবর্তন আসেনি পীরগঞ্জের প্রতক্ষ্যদর্শী এই বৃদ্ধের।  তার ভাষায় তিনি এই এলাকার পরাজিত সৈনিক।

সাংবাদিক পরিচয় জানার পর নয়া মিয়া বলেন, ওয়াজেদ সাহেবের ছেলে জয় এলাকার সন্তান।  অথচ এলাকার কোনো মানুষ তার কাছে ভিড়তে পারছে না।  ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, জয়কে দেখতে হলে অনেক দূর থেকে দেখতে হয়।

চাচা আপনি কি জানেন, আপনার এলাকায় প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে এমন প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলেন, কি হবে ওটা দিয়ে। এখনো এলাকার অনেক বাড়ি অন্ধকারে থাকে।  কারেন্ট নাই।  আগে আলো ছড়াক জয়। তারপর অন্যচিন্তা। একথা বলার পরেই এক যাত্রী পেয়ে গেলেন নয়া মিয়া।

এমএএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।