ডেঙ্গুতে আক্রান্ত স্বামী : সন্তান নিয়ে লড়ছেন স্ত্রী
* ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার কমছে না
* সতর্ক হওয়ার পরামর্শ
স্বামীর পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন ময়না বেগম। পিছনেই এক বছরের ছোট মেয়ে আফিয়া মা মা বলে ডাকছে। হয়তো সে কিছু বলতে চায়। কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই ময়না বেগমের। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত স্বামীর ছটফটানি দেখছেন। কী করলে বেচারা (স্বামী) একটু আরাম পাবে সেই চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তার।
রোববার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ১ নং ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায় এ চিত্র। রোগীর নাম রবিউল ইসলাম, পেশায় ব্যবসায়ী। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ১০ দিন ধরে ভুগছেন। দুই সন্তান ও স্ত্রীসহ থাকেন মিরপুরের পীরেরবাগে। স্ত্রী ময়না বেগমের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া।
ময়না বেগম জানান, ঢাকায় পরিবার বা আত্মীয়-স্বজন বলতে কেউ নেই। ফলে স্বামীর জন্য খাবার ও ওষুধ আনা কিংবা বাচ্চা সামলানোর কাজটা তাকেই করতে হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন রবিউল। তাই নিজের আর সন্তানদের চিন্তা বাদ দিয়ে স্বামীর সেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন। আড়াই বছরের বড় মেয়েকে এক প্রতিবেশীর কাছে বিশেষ অনুরোধে রেখে এসেছেন।
জাগো নিউজকে রবিউল জানান, ফুটপাতে ব্যবসা করি। ১০/১২ দিন আগে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছি। এরপর থেকে বিছানায়। ভালো না হওয়ায় শেষমেষ হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হয়েছি। ডাক্তার বলেছেন রক্ত লাগবে, অবস্থা ভালো না। কাল সকালে ডাক্তার আবার আসলে জানা যাবে কয় ব্যাগ রক্ত লাগবে।
কথার এক পর্যায়ে রবিউল ধীর গলায় বলেন, ‘ভাই-মন থেকে আমার জন্য একটু দোয়া করবেন। বাচ্চা দুইটা নিয়া খুবই বেকায়দায় পড়েছি। আল্লাহ যেন ভালো করে দেন ‘এ সময় করুণ দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন ময়না বেগম। তারও যেন একই আকুতি।
একই ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছে এসএসসি পরীক্ষার্থী রবিউল ইসলাম। মিরপুরে শ্যামলী আইডিয়াল স্কুলে পড়ে। এবার টেস্ট পরীক্ষা দিচ্ছিল। ৬টি পরীক্ষা শেষে হতেই জ্বরে আক্রান্ত হয়। বাকি পরীক্ষা আর দিতে পারেনি।
পাতলা গড়নের রবিউল ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আরও শুকিয়ে গেছে- এ কথা জানিয়ে পাশে থাকা চাচা আলিম বলেন, স্কুলে রবিউলের জ্বরের বিষয়ে ইনফর্ম করা হয়েছে। স্যাররা বলেছেন, পরে তার জন্য আলাদা ব্যবস্থায় পরীক্ষা নেবেন।
তিনি জানান, জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর রবিউল খেতে পারছে না। ফলে কিছুটা সমস্যায় পড়ে গেছি। এভাবে চললে সে দাঁড়াতেই পারবে না।
ওই ওয়ার্ডে সহকারী রেজিস্টারের দায়িত্বে আছেন ড. অরুনাভ পাল। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, প্রতিদিনই ৪-৫ জন করে ডেঙ্গু রোগী এই ওয়ার্ডে ভর্তি হচ্ছেন। এখানে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা থেকে রোগী আসছে। এর মধ্যে মিরপুর থেকে বেশি আসছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ পর্যন্ত কোনো ডেঙ্গু রোগী মারা যায়নি। তবে দুই একজনের অবস্থা খারাপ ছিল, বিশেষ ট্রিটমেন্ট দিয়ে তাদেরকে সুস্থ করা হয়েছে।
রোববার ওয়ার্ডটিতে ৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিলেন। ছুটি নিয়ে বাসায় গেছেন আরও ২ জন।
ওয়ার্ডের ১৩ নম্বর বেডে শায়িত ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান জানায়, গত ২৫ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। বাবা নেই, দুই ভাই চাকরি করেন। রাজধানীর লালকুঠি এলাকায় বাসা। এখানে সার্বিক দায়িত্ব পালন করছেন মা মাসুদা পারভিন।
মাহমুদুল জানায়, শরীর অনেক দুর্বল। ডাক্তার বলছে রক্ত দিতে হবে। এখনো রক্ত সংগ্রহ হয়নি। তবে কাল সকাল নাগাদ একজন আসতে পারেন বলে জানিয়েছে।
সরকারি এই হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে ঢুকে দেখা যায়, সকাল থেকে দুপুর ১টা নাগাদ ৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। তারা হলেন ২৪ বছর বয়সী রুপালী বেগম, ২৬ বছরের মাসুদ ও ৩২ বছর বয়সী পারভিন। তাদেরকে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া জ্বরে আক্রান্ত তিন জনের ডেঙ্গু হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়েছে। তাদেরকেও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য হাসপাতালে ভর্তি দেখানো হয়েছে।
কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. জাহানারা পারভিন বলেন, প্রতিদিন গড়ে ৫-৭ জন রোগী আসেন ভর্তির জন্য। বাকি অনেকের ডেঙ্গু হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়। এমন অনেককে লক্ষণ দেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। অবস্থা খারাপ হলে ভর্তি করা হয়।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু হলে রোগীর রক্তের প্লাটিলেট কমে যায়। মাত্রাতিরিক্ত কমে গেলে রোগী মারাও যেতে পারে। এজন্য আমরা এই বিষয়টি নিয়ে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছি।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে গড়ে প্রতিদিন ৯২ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইর্মাজেন্সি অপারেশনস অ্যান্ড কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৪১ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। এরমধ্যে বেশ কয়েক জনের মৃত্যর খবরও গণমাধ্যমে বেরিয়েছে।
ডেঙ্গু বিষয়ে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানালেও বাস্তবে সেটি তেমন নজরে আসছে না। ফলে এ বিষয়ে সবাইকে নিজে থেকে সচেতন হওয়া উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. সালাহউদ্দীন বলেন, এটি মশাবাহিত রোগ। যে কেউ যে কোনো জায়গায় আক্রান্ত হতে পারেন। নরমালি এই রোগে আক্রান্ত হলে অনেকে গায়ে শক্তি পায় না। আমরা সাধারণত বিশ্রাম ও তরল খাবার গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডেঙ্গু মশার যেন জন্ম না হয়, বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। সচেতন করতে হবে। এর বিকল্প নেই।
এদিকে রাজধানীতে মশাবাহিত ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া রোগের বিষয়ে সচেতন করতে প্রতিটি ওয়ার্ডে গানে গানে স্লোগান ও করণীয় বোঝানোর উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। রোববার কারওয়ান বাজারে সংস্থার আঞ্চলিক কার্যালয়ের সামনে থেকে এমন সচেতনতামূলক কর্মসূচির উদ্বোধন করেন প্যানেল মেয়র-৩ আলেয়া সারোয়ার ডেইজী।
সপ্তাহব্যাপী এই কর্মসূচি ছাড়াও নিয়মিত মশা নিধনে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা ডিএনসিসির পক্ষ থেকে বিশেষ এই কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। আমাদের কাজ হবে গানে গানে জনগণকে সচেতন করা।
তিনি আরও বলেন, রাজধানীর বেশিরভাগ মানুষই জানেন, এডিস মশার বংশবিস্তার ঘটে স্বচ্ছ জমে থাকা পানিতে। তারপরও অনেকেই হয়ত মানেন না বা সচেতন হন না। তাই আমরা নাগরিকদের সচেতন করতে ব্যতিক্রমধর্মী এই কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। আমাদের প্রতিটি ওয়ার্ডে এই ‘রোড শো’ হবে।
এমএ/এমএমজেড/পিআর