বাউনিয়া খাল গিলছে সরকারি দুই প্রতিষ্ঠান

জসীম উদ্দীন
জসীম উদ্দীন জসীম উদ্দীন , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:৩৪ এএম, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

একসময় অবৈধ দখলে থাকা রাজধানীর হাতিরঝিলকে সাজানো হয়েছে দৃষ্টিনন্দন আর সৌন্দর্যের প্রতীকরূপে। হাতিরঝিল লেক এখন ঢাকাবাসীর পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। তবে এ ঢাকায় এখনও রয়েছে সেই দখলের আরো চিত্র। বেদখল খাল উদ্ধার করে সৌন্দর্য বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও খোদ সরকারি দুই প্রতিষ্ঠান ঢাকায় খাল দখলে লিপ্ত।

মিরপুরে প্রবাহমান বাউনিয়া খাল ভরাট করে সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে দুটি আবাসন প্রকল্প। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ও ভূমি মন্ত্রণালয়। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি), ঢাকা ওয়াসার বিরোধিতা আর হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশনাকে তোয়াক্কা করছে না সরকারি ওই দুই প্রতিষ্ঠান।

রাজধানীর মিরপুর-১৪ এলাকার প্রবাহমান বাউনিয়া খালটি ৬০ মিটার থেকে কমতে কমতে এখন কোথাও কোথাও নালায় পরিণত হয়েছে।

ঢাকা ওয়াসা ও ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, বাউনিয়া খালটির সম্প্রসারিত অংশ ইব্রাহিমপুর খালের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে। খালটি মিরপুর-১৪ নম্বর থেকে ভাষানটেক, মাটিকাটা, মানিকদী, বালুঘাট হয়ে আশুলিয়ার তুরাগ নদে গিয়ে মিশেছে। খালের একটি শাখা বাইশটেকি হয়ে প্যারিস রোড খাল নামেও পরিচিত।

southeast

ওয়াসার তথ্যানুযায়ী, মিরপুর-১৪ নম্বর বাসস্ট্যান্ডের পাশ থেকে বাউনিয়া খালের শুরু। প্রায় আট কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ খালের মিরপুর-১৪ নম্বর থেকে জয়নগর পর্যন্ত এক হাজার ১৮২ মিটারের মতো অংশের মালিক জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। বাকিটুকুর মালিক ঢাকা ওয়াসা। ওয়াসার হিসেবে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খালটির প্রস্থ হওয়ার কথা ৬০ ফুট। তবে খালটি দখল করে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ‘জয়নগর প্রকল্প’ ও ভূমি মন্ত্রণালয়- ‘ভাষানটেক প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, বাসস্ট্যান্ডের পাশে ওয়াসার পানির পাম্পের পেছন থেকে সামনে বাগানবাড়ী বস্তির শেষ পর্যন্ত খালের দুই পাড় বাঁধাই করা। পুলিশস্টাফ কলেজের পেছনে সারি সারি টংঘর। এরপরই ভাষানটেক পুনর্বাসন প্রকল্প (বিআরপি)। বিপরীত পাশে রূপসী প্রো-অ্যাকটিভ ভিলেজ আবাসন প্রকল্প। দুই প্রকল্পের মাঝে কমেছে খালের প্রশস্ততা।

খালটির পূর্ব বাইশটেক বালুর মাঠ এলাকায় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলছে। দখলের কারণে সেখানে খালটি নালায় পরিণত হয়েছে।

এলাকার বাসিন্দা ইমরান সরকার বলেন, একটু বৃষ্টি হলেই এখন মিরপুরের সড়কে নৌকা চলে। কারণ একটাই, এ এলাকার মূল প্রবাহমান বাউনিয়া খাল আর আগের মতো প্রশস্ত নেই। দখল, মাটি ভরাট, বালু ভরাটে কমেছে গভীরতাও। ৬০ ফিটের খালটি কোথাও ১০ ফিটে নেমে এসেছে। চারদিকে যেন দখল নৈরাজ্য চলছে।

‘খালটি দখলমুক্ত করতে না পারলে মিরপুর আর বাসযোগ্য থাকবে না,’ যোগ করেন তিনি।

southeast

ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, সরকারি ওই দুই সংস্থার বিরুদ্ধে খাল দখলের লিখিত অভিযোগ করেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ও ঢাকা ওয়াসা। খাল উদ্ধারের জন্য পাঁচ বছর ধরে চিঠি চালাচালি হলেও বন্ধ হয়নি খালে বেআইনি প্রকল্পের কাজ। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ও ভূমি মন্ত্রণালয়কে জানানোর পরও সমাধান মিলছে না।

এ ব্যাপারে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র মো. জামাল মোস্তফা জাগো নিউজকে বলেন, খাল দখল করে ভূমি মন্ত্রণালয় ও জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ হাউজিং প্রকল্প গড়ে তুলছে। পরিবেশ-প্রতিবেশ বিধ্বংসী এ কার্যক্রম বন্ধে এলাকাবাসীকে নিয়ে বারবার প্রতিবাদ জানালেও তারা কর্ণপাত করছে না। বাউনিয়া খালের দখল বন্ধ করতে ঢাকা ওয়াসাসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে জানানো হয়েছে।

২০১৬ সালে বাউনিয়া খালের দখলের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করা হয়। রিটের পর আদালত ঢাকার ডিসি অফিস, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, ঢাকা ওয়াসা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, গণপূর্ত অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট ১০ জন কর্মকর্তাকে এ বিষয়ের ওপর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।

প্যানেল মেয়র মো. জামাল মোস্তফা আরও বলেন, আমরা খালটি দখলমুক্ত চাই। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আছে, বেদখল খাল উদ্ধার করে সৌন্দর্য বাড়ানোর। এরপরও খাল দখল করে প্রকল্প করার সাহস কীভাবে হয়? কোনোভাবে সেখানে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে দেয়া হবে না। প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে। খুব শিগগিরই প্রতিবেদন তৈরি করে আদালতে দাখিল করব।

অন্যদিকে হাইকোর্টের ওই নির্দেশনার পর জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ আদালতে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। কিন্তু তা গ্রহণ না করে পুনরায় পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

southeast

রিটকারীর আইনজীবী পলাশ বৈদ্য জাগো নিউজকে বলেন, রাজধানীর পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় বাউনিয়া খাল রক্ষা করা জরুরি উল্লেখ করে রিট করা হয়েছিল। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সব সংস্থা প্রতিবেদন দিলে সত্যটি আর গোপন থাকবে না। সরকারি সংস্থার দখলে থাকা অংশটি ছেড়ে দিতেই হবে।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত-সচিব (উন্নয়ন-১) এস এম আরিফ-উর-রহমান বলেন, অভিযোগ আছে, শুনেছি। খাল দখলের অভিযোগের ব্যাপারে চিঠি চালাচালির কথাও শুনেছি। বিস্তারিত জানি না। এ বিষয়ে আমাদের আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ভালো বলতে পারবে।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য জানতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে উপ-সচিব (জরিপ-১) মো. আব্দুর রহমান বলেন, তথ্য জানতে চাইলে যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আপনাকে আসতে হবে। তাছাড়া ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশনা ছাড়া এ ব্যাপারে তিনি কিছুই বলবেন না বলে জানান তিনি।

ঢাকা ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের অক্টোবরে চিঠি দিয়ে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে বাউনিয়া খাল ভরাট বন্ধের অনুরোধ করেছিল ঢাকা ওয়াসা। কিন্তু সে অনুরোধ রাখা হয়নি। এখন বাউনিয়া খালের জয়নগর অংশে প্রবাহ বন্ধ করে পাইলিংয়ের কাজ চলছে।

ঢাকা ওয়াসার ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবুল কাসেম জানান, বাউনিয়া খালের আপস্ট্রিম অংশ রক্ষণাবেক্ষণ করছে ঢাকা ওয়াসা। মিরপুর সেকশন-১৫ এর জয়নগর অংশের খালের জায়গা চিহ্নিত করে দিলে খালটি প্রবাহমান রাখা সম্ভব হবে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী কামরুল হাসান বলেন, মিরপুর বাউনিয়া খালের প্রবাহ বন্ধ করে সরকারি সংস্থার চলা হাউজিং প্রকল্প বন্ধের চেষ্টা চলছে। খালটি প্রবাহমান রাখতে প্রধানমন্ত্রী বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন। খাল উদ্ধারের লক্ষ্যে দুটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন পেয়েছে। আশা করছি, শিগগিরই সমস্যার সমাধান হবে।

জেইউ/জেডএ/এনডিএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।