সুষ্ঠু নির্বাচন না দিলে সরকারের পতন অনিবার্য
ড. কামাল হোসেন। বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধানপ্রণেতা। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায়। দ্বিধা আর টানাপোড়েন থেকে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে গণফোরাম নামে রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
ছয় দশকের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নিয়ে ফের আলোচনায় গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। নির্বাচন ঘিরে ‘জাতীয় যুক্তফ্রন্ট’ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন। ঐক্য গঠনে বৈঠক করছেন, আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
‘জাতীয় যুক্তফ্রন্ট’ গঠন প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের শেষটি থাকছে আজ।
জাগো নিউজ : জাতীয় ঐক্য গঠন করছেন। সরকারপক্ষের সঙ্গে আলোচনার কোনো উদ্যোগ আছে কি-না?
কামাল হোসেন : নির্বাচন কাঠামো ভেঙে গেছে। এই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে অবশ্যই সংলাপ বা আলোচনার দরকার। নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি এবং সেটা কোন পদ্ধতিতে সম্ভব তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। নির্বাচনের সময় প্রশাসন কীভাবে কাজ করবে, সেই ব্যাপারেও আলোচনার দরকার আছে।
জাগো নিউজ : সংলাপের জন্য আপনাদের পক্ষ থেকে কোনো আগ্রহ আছে কি-না?
কামাল হোসেন : অবশ্যই, আমাদের পক্ষ থেকে সংলাপের উদ্যোগ নেয়া হবে।
জাগো নিউজ : কবে নাগাদ হতে পারে সংলাপ?
কামাল হোসেন : আমরা আলোচনা করেছি এ ব্যাপারে। আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের ঐক্য ঘোষণার পরই সংলাপের উদ্যোগ নেয়া হবে। যদিও সময় কম।
জাগো নিউজ : অনেকেই বলছেন, আপনাদের ‘জোট’ আওয়ামী লীগেরই ‘বি টিম’। এর বিপরীতে কী বলবেন?
কামাল হোসেন : অনেকেই অনেক কথা বলবেন। অনেকেই ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজবেন। ভালো কোনো উদ্যোগ নিতে গেলে সমালোচনা হতেই পারে। বুঝতে হবে আমরা কাদের সমালোচনা করে রাজনীতি করছি। দুঃশাসনের সঙ্গে কোনো আপস হতে পারে না। সময়ের স্বল্পতায় আমরা সবার কথায় কান দিচ্ছি না। সবার প্রশ্নের জবাব দেয়ার সময়ও নেই এখন।
জাগো নিউজ : সময়ের স্বল্পতার কথা বলছেন। আগে কেন ঐক্যের উদ্যোগ নিলেন না?
কামাল হোসেন : রাজনীতি, নির্বাচন নিয়ে সরকার লুকোচুরি খেলছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সরকারের আরেকটি নির্বাচন দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু দিলো না। কায়দা করে সরকার সময় পার করলো।
জাগো নিউজ : সে সুযোগ তো আপনারাও দিলেন?
আরও পড়ুন >> বিএনপির সঙ্গে জোট গঠন এখনও চূড়ান্ত হয়নি
কামাল হোসেন : হ্যাঁ, বলতে পারেন সুযোগ আমরাও দিয়েছি। সরকারকে আরেকটি নির্বাচনের জন্য বাধ্য করাতে পারিনি। আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটানোর দরকার ছিল। আমরা তা পারিনি। আরেকটি নির্বাচনে বাধ্য করাতে আমরা শতভাগ ব্যর্থ হয়েছি।
জাগো নিউজ : সরকার তো এখন অধিক আত্মবিশ্বাসী। উন্নয়নের প্রশ্ন সামনে এনে জনমত পক্ষে আনতে চাইছে…
কামাল হোসেন : ভালো কথা। তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন দিক। এতো ছলচাতুরি কেন? স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এতো জবরদখল কেন করা হলো? উন্নয়নের ভরসা পেলে তো আওয়ামী লীগের শতভাগ ভোট পাবার কথা। তাহলে এত ভয় কিসের?
এতো আত্মবিশ্বাসী হলে সরকারের এমন নড়বড়ে অবস্থা কেন? আওয়ামী লীগের ভাব-ভঙিমা দেখলে তো মনে হয় তাদের পায়ের নিচে মাটি নেই।
জাগো নিউজ : বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গেও আলোচনা করছেন। ওই জোটে জামায়াত আছে। জামায়াত প্রশ্নে আপনাদের অবস্থান কী?
কামাল হোসেন : জামায়াত প্রশ্নে আমাদের অবস্থান একেবারেই পরিষ্কার। জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি আমাদের জোটে আসতে পারবে না। এটি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। জামায়াত ছাড়লে জোটে আসতে পারবে বিএনপি।
জাগো নিউজ : জামায়াতের ব্যাপারে বিএনপি কোনো ইঙ্গিত দিয়েছে?
কামাল হোসেন : আনুষ্ঠানিকভাবে তারা কোনো অবস্থান জানায়নি। তবে জামায়াত প্রসঙ্গে আলোচনা হলে বিএনপি আমাদের বোঝাতে চায় যে, তারা জামায়াত থেকে সরে এসেছে।
জাগো নিউজ : বিএনপি যদি জামায়াত না ছাড়ে, তাহলে আপনাদের অবস্থান কী হবে?
আরও পড়ুন >> নির্বাচন পরিচালনায় সামরিক বাহিনীকে চান ফখরুল
কামাল হোসেন : জামায়াত না ছাড়লে ঐক্য গঠন ব্যাহত হবে বলে আমি মনে করি। তবে বৃহৎ স্বার্থে বিএনপিকে এ বিষয়ে উপলব্ধির অনুরোধ জানাবো।
জাগো নিউজ : অন্য ইসলামি দল নিয়ে কী বলবেন?
কামাল হোসেন : সংবিধান ও বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক- এমন কোনো দল বা নীতির সঙ্গে আমরা ঐক্য করবো না।
জাগো নিউজ : গণতান্ত্রিক বাম মোর্চাকে পাশে চাইছেন?
কামাল হোসেন : আপাতত রাজনৈতিক মাঠে যুগপৎ আন্দোলনের ব্যাপারে আমরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছি। নির্বাচনের বিষয়েও আলোচনা হবে। একই উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা ২০০৭ সালে মহাজোট গঠন করেছিলাম।
জাগো নিউজ : সরকার যদি বর্তমান পরিস্থিতি না বদলায়, তাহলে রাজনীতি কোন দিকে মোড় নেবে বলে মনে করেন?
কামাল হোসেন : সরকার অবস্থান না বদলালে মহাসংকট দেখা দেবে। আশা করছি সরকারও এখন এই বিপদের কথা বুঝতে পারছে।
জাগো নিউজ : সংকট উত্তরণে অন্য কোনো শক্তির....
কামাল হোসেন : আমরা জনগণের বাইরে অন্য কোনো শক্তির হস্তক্ষেপে বিশ্বাস করি না। অথবা অন্য কোনো শক্তি আসুক- তাও প্রত্যাশা করছি না। কিন্তু পরিস্থিতি যদি অন্য কোনো শক্তিকে এগিয়ে আসতে সহায়তা করে, তখন হয়তো সবাইকে অবাক করবে।
রাজনীতির অভিজ্ঞতা তো আমাদেরও আছে। মহাসংকট থেকেই অন্য শক্তি বা অপশক্তি ক্ষমতায় আসে। যদিও জনগণ অন্য শক্তির উত্থান চায় না।
জাগো নিউজ : আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কোনো আলোচনা হচ্ছে কিনা?
কামাল হোসেন : আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের কথা বলে আসছে আগে থেকেই। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিশ্বমহল কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে, তা সবারই জানা। তারা কিন্তু অবস্থান বদলায়নি। আন্তর্জাতিক মহল চাইছে, তারা আর ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন দেখতে চায় না। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক- এটিই তারা স্পষ্ট করে বলছেন।
আরও পড়ুন >> ইভিএমে যে ষড়যন্ত্র দেখছেন বি.চৌধুরী
জাগো নিউজ : বলা হচ্ছে, এক সময়ের ‘আওয়ামী লীগের ড. কামাল হোসেন’ এখন ‘আওয়ামী লীগবিরোধী’ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এই অভিযোগের জবাবে কী বলবেন?
কামাল হোসেন : এটিই বেশি কষ্ট দেয়। কী ষড়যন্ত্র করছি, সরকার সেটি পরিষ্কার করুক। সরকারের এজেন্সি আছে। প্রমাণ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।
জাগো নিউজ : ‘সুজন’ সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের বাসায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে নৈশভোজে শরিক হলেন। হামলা, মামলার ঘটনাও ঘটলো। সরকারের লোকেরা বলছেন, আপনারা বিশেষ বৈঠকে মিলিত হচ্ছিলেন?
কামাল হোসেন : পারিবারিক অনুষ্ঠান ছিল সেটি। সেখানে এমন কোনো আলোচনা হয়নি যে, সরকারের জন্য নেতিবাচক বার্তা আসবে। খাবারের অনুষ্ঠানমাত্র।
সরকার নিজে থেকে না ঘটালে এমন একটি আয়োজনকে কেন্দ্র করে হামলার ঘটনা ঘটতো না। সরকার তো প্রথমে হামলার কথা স্বীকারই করলো না। পরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতিক্রিয়া দেয়ার পর বিবৃতি দিলো।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত কোথায় যাবেন, তা পুলিশ ও গোয়েন্দারা আগে থেকেই জানেন। পুলিশি প্রটোকলও ছিল। এভাবে প্রকাশ্যে কিসের ষড়যন্ত্র হতে পারে, তা বুঝে আসছে না।
জাগো নিউজ : তাহলে ওই ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ দিয়ে সরকার আসলে কী বোঝাতে চাইছিল?
কামাল হোসেন : সরকার নিজেই জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ঘোষণা করেছে। যারা বলছে, আমরা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছি, মূলত তারাই জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। মিথ্যাচারের সীমা থাকা উচিত। এক জায়গায় চায়ের দাওয়াতে গেলেও ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছে সরকার।
সরকার তো এখন মহাশক্তির অধিকারী। ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে পারছে না কেন?
জাগো নিউজ : ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ে গণভবনে গিয়েছিলেন। গুঞ্জন রয়েছে, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ আপনাকে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন…
আরও পড়ুন >> ঐক্যের ঘোষণাপত্র তৈরিতে হচ্ছে কমিটি
কামাল হোসেন : আমার কানে এমন কোনো কথা আসেনি। বললেও আমি হয়তো শুনিনি। ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েই চলে এসেছি। রাজনীতি নিয়ে কোনো আলোচনা হওয়ার সুযোগ থাকে না এমন অনুষ্ঠানে।
জাগো নিউজ : যদি আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগ যোগদানের আহ্বান জানায়…
কামাল হোসেন : আমরা গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছি। আওয়ামী লীগ নিজেই যদি সেই পরিবেশ তৈরি করে তাহলে তো আমাদের যোগ দেয়ার দরকার পড়ে না। তবে আমরা গণতন্ত্রের জন্য যে কোনো ফোরামকে সহযোগিতা করে যাবো। পরিস্থিতি বদলানোর জন্য আগে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে।
জাগো নিউজ : সরকার আন্তরিক হবে বলে মনে করেন?
কামাল হোসেন : আপাতত তা মনে করার কোনো কারণ নেই। সরকার তো সবকিছু স্তব্ধ করে দিচ্ছে। বাকস্বাধীনতা হরণ করছে প্রতিনিয়ত। সরকারের সব আচরণ তো অগণতান্ত্রিক। তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গণতন্ত্র উদ্ধার হবে- এমনটি আশা করা যায় না।
জাগো নিউজ : জোট গঠনে কোনো দ্বিধা কাজ করছে কিনা অথবা সরকার আরও কঠোর হতে পারে কিনা?
কামাল হোসেন : সরকার তো কঠোর অবস্থানেই আছে। তাদের প্রতিক্রিয়া দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। আশা করছি, সরকার অবশ্যই নীতির পরিবর্তন করে সহনীয় হবে।
জাগো নিউজ : ভিন্ন আঙ্গিকে প্রশ্ন করি। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা পরিচালনার ভার যদি আপনাকে দেয়া হয়, আপনি প্রস্তুত?
কামাল হোসেন : মাটিতে পা রেখে এমন স্বপ্ন দেখা উচিত নয়। অবাস্তব বিষয় নিয়ে ভাবি না। বাস্তবতার আলোকে চিন্তা করতে হবে।
আমরা চাই আওয়ামী লীগও জ্ঞান ফিরে পাক। রাষ্ট্র, সমাজে শান্তি ফিরে আসুক। জবরদখলের পরিণাম ভালো হয় না। ষাট বছরের রাজনীতির অভিজ্ঞতায় অনেক কিছুই দেখলাম।
আরও পড়ুন >> আওয়ামী লীগ ভারতের কথায় চলে না
১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বৃটিশ এক মন্ত্রী সফরে এসে আমাকে বললেন, ‘এরশাদ আরও ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারে।’ আমি বললাম, ও (এরশাদ) ১৫ সপ্তাহও টিকতে পারবে না। বৃটিশমন্ত্রী অবাক হলেন। ঠি তাই হলো। ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতন ঘটলো। পরে লন্ডনে যাওয়ার পর সেই মন্ত্রী আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমার ভবিষ্যৎ বাণীর রহস্য জানতে চাইলেন। আমি বললাম, বাঙালির রাজনীতির ধাঁচ আমার জানা।
জাগো নিউজ : এখন কী ভবিষ্যৎ বাণী করবেন?
কামাল হোসেন : সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন না দিলে কোনোভাবেই টিকতে পারবে না। পতন অনিবার্য হয়ে উঠবে। এটিই আমার ভবিষ্যৎ বাণী।
জাগো নিউজ : ভরসা কোথায়?
কামাল হোসেন : সরকার ১০ ভাগ জনসমর্থন নিয়ে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। জনগণের মতকে অবজ্ঞা করে কেউ ক্ষমতা স্থায়ী করতে পারেনি। সামরিক সরকারও চলে গেছে। আবার রাজনৈতিক দল যারা স্বৈরনীতি প্রতিষ্ঠা করে শাসন করতে চেয়েছে, তারাও টিকতে পারেনি।
জাগো নিউজ : বাংলাদেশের রাজনীতি ভারত অভিমুখী। ‘ভারত’ ফ্যাক্টর কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
কামাল হোসেন : আমাদের নির্বাচন ও রাজনীতিতে ভারতের নাক গলানো অত্যন্ত দুঃখজনক। তবে অচিরেই ভারত বাংলাদেশের মানুষের মনোভাব বুঝতে পারবে। অযথা বাড়াবাড়ি করে মানুষের মন বিষিয়ে তুলবে না ভারত। পাশের দেশটির উচিত বাংলাদেশের উন্নয়ন ও রাজনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা।
কোনো বিশেষ দল নয়, আশা করি তারা জনগণের সঙ্গে থাকবে। যেমনটি ছিল ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে।
এএসএস/এমএআর/জেআইএম