টানাপোড়েনে নির্বাচন কমিশন!

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:০৫ পিএম, ৩১ আগস্ট ২০১৮

>> ইভিএম ব্যবহারের সুযোগ রেখে আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন
>> আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি : সিইসি
>> ইভিএমে ‘ম্যানুপলেশনের’ আশঙ্কা থেকেই যায় : মওদুদ আহমদ
>> কমিশনারদের মধ্যে মতবিরোধ ‘গণতন্ত্রের বিউটি’ : ওবায়দুল কাদের
>> মতবিরোধ সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় : ইফতেখারুজ্জামান

প্রকাশ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে নির্বাচন কমিশনে (ইসি)। পাঁচ কমিশনারের মধ্যে চারজনই একদিকে অবস্থান নিয়েছেন, অন্যজন তাদের বিপক্ষে। এমনকি পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলনও করেছেন তারা। বিষয়টি নজিরবিহীন এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, অতীতেও নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। কিন্তু এবারের মতো তা এতো প্রকাশ্যে আসেনি।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে পাঁচ নির্বাচন কমিশনারের মধ্যে চারজন বিভিন্ন ইস্যুতে একমত হলেও দ্বিমত পোষণ করেন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। কমিশন গঠনের সময় সার্চ কমিটিতে বিএনপির দেয়া তালিকা থেকে তার নাম দেয়া হয়। তিনিই এখন বিএনপির পক্ষ হয়ে কথা বলছেন।

আরও পড়ুন >> ইভিএম ব্যবহারের বিধান রেখে আরপিও সংশোধনের সিদ্ধান্ত

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদাসহ অন্য তিন নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও শাহাদাত হোসেন চৌধুরীর দেয়া সিদ্ধান্তে নোট অব ডিসেন্ট দিচ্ছেন (আপত্তি) তিনি। আগে তা গোপন থাকলেও এখন তা প্রকাশ্যে এসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার কমিশনের বৈঠকে এর প্রতিফলন দেখা যায়।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিরোধিতা করে কমিশনের এ সংক্রান্ত বৈঠক ত্যাগ করেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে তিনি বৈঠক থেকে বের হয়ে যান। ইভিএম ব্যবহারের আইনি বৈধতা দিতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য বৈঠকটি চলছিল।

বিদ্যমান আইন অনুযায়ী স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিধান থাকলেও সংসদ নির্বাচনে সেই বিধান নেই। ফলে আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ নেয় কমিশন। সূত্র জানায়, বৈঠক শুরুর পরই মাহবুব তালুকদার দুই পৃষ্ঠার নোট অব ডিসেন্ট পড়া শুরু করেন। এর জবাবে কবিতা খানম বলেন, এখনও বৈঠক শুরু হয়নি। ইভিএম নিয়ে আলোচনা শুরুর পর আপনি আপনার বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারতেন। এরপরই বৈঠক থেকে বেরিয়ে যান তিনি।

সূত্র আরও জানায়, মাহবুব তালুকদার তার নোট অব ডিসেন্টে লেখেন, ‘এই ইভিএম ব্যবহারের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে এরই মধ্যে ইভিএম ব্যবহার হয়েছে। এতে রাজনৈতিক দল ও ভোটারের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।’

‘এর আগে ৫০ কোটি টাকার ইভিএম ক্রয়ের নথিতে আমি ভিন্নমত পোষণ করেছিলাম। সম্প্রতি ইভিএমের জন্য যে প্রকল্প তৈরি হয়েছে, তাতে ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার মুখে আগামী সংসদ নির্বাচনে এটির ব্যবহার যেখানে অনিশ্চিত সেখানে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় কতটা যৌক্তিক!’

আরও পড়ুন >> ‘আমি পাঁচ টুকরার এক টুকরা’

তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পরও বৈঠক চালিয়ে যান সিইসিসহ অন্য কমিশনাররা। এমনকি বৈঠক শেষে সিইসি সংবাদ সম্মেলনে জানান, প্রয়োজন পড়লে যাতে ইভিএম ব্যবহৃত হয় সেজন্য আরপিও সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হবে- এই ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

সিইসির ওই সংবাদ সম্মেলনের পরই নিজ কার্যালয়ে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তিনি বলেন, ‘ইসিতে আমি পাঁচ টুকরার এক টুকরা। আমি সংখ্যাগরিষ্ঠ নই, সংখ্যালঘিষ্ঠ। ইসির ঘোষিত রোডম্যাপের বাইরে গিয়ে সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সুযোগ তৈরিতে হঠাৎ করে আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ নেয়ায় কমিশন বৈঠক বর্জন করেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য উনারা (সিইসি ও তিন নির্বাচন কমিশনার) বসে বসে আরপিও সংশোধন করবেন, আর আমি সেখানে মূর্তির মতো বসে থাকবো, তা তো হয় না। এ জন্য বের হয়ে এসেছি।’

জানা যায়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এমপিদের নির্বাচনী প্রচারণার সুযোগ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল নির্বাচন কমিশনার। সেই সময়ও তিনি এর বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু বিষয়টা তখন পাল্টাপাল্টি পর্যায়ে যায়নি।

ec-02

কমিশনার মাহবুব তালুকদার

এদিকে, ইভিএম ব্যবহারের জন্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধনের যে উদ্যোগ নির্বাচন কমিশন নিয়েছে, তা ‘প্রত্যাখ্যান’ করেছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘দেড় লাখ ইভিএম কিনতে ইসির নেয়া প্রায় চার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাবের পেছনেও দুর্নীতি রয়েছে। এই মেশিন কিনে লুটপাট হবে। এটি ক্রয়ের ব্যাপারে দুর্নীতি জড়িত আছে, কমিশনের একটা ব্যাপার আছে।’

আরও পড়ুন >> ভিন্নমত থাকাটাই গণতন্ত্রের বিউটি : কাদের

মওদুদের অভিযোগ, ইভিএমে ‘ম্যানুপলেশনের’ আশঙ্কা থেকেই যায়। যেখানে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা হ্যাকারের হাতে চলে যায়, সেখানে যন্ত্রের মাধ্যমে ভোট নিলে তা মানুষের ‘আস্থা বা গ্রহণযোগ্যতা’ পাবে না। কারা এই মেশিনের নিয়ন্ত্রণ করবে? কার কাছে পাসওয়ার্ড থাকবে? যে নির্বাচন কমিশনের ওপরে আমাদের কোনো আস্থা নাই, সেই কমিশনের হাতে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনের নিয়ন্ত্রণ থাকবে! এই ইভিএম চালুর সিদ্ধান্ত আমরা প্রত্যাখান করছি।

তবে কমিশনারদের মধ্যে মতবিরোধের বিষয়টি ‘গণতন্ত্রের বিউটি’ বলে মত দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন তো পাঁচজনকে নিয়ে। পাঁচজনের মধ্যে একজন নোট অফ ডিসেন্ট (আপত্তি) দিতেই পারেন। ভিন্ন মত থাকতেই পারে। এটাই তো গণতন্ত্রের বিউটি।’

তিনি বলেন, কমিশনার মাহবুব তালুকদারের ওই আপত্তি এবং সভা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নির্বাচন কমিশনে ‘গণতান্ত্রিক পরিবেশ’ থাকার প্রমাণ। নির্বাচন কমিশনেও গণতন্ত্র আছে। নোট অব ডিসেন্ট দেয়ার অধিকার তার আছে। এজন্য জটিলতা তৈরি হবে কেন? একজনের মত যেমন আছে, গণতান্ত্রিক ধারায় বাকি চারজনেরও মত আছে। তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।

আরও পড়ুন >> ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করতে সিইসি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ : রিজভী

নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে প্রকাশ্যে বিরোধের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ‘কমিশনারদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ থাকতেই পারে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এর আগে কখনও তা প্রাকাশ্যে আসেনি। এমনকি পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলনের নজিরও নেই। এটি ভালো লক্ষণ নয়।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ইসির মতো একটি প্রতিষ্ঠানে সব কমিশনারের মতামতের ভিত্তিতে বড় কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে- এটাই সবার কাম্য। তাদের মধ্যে মতবিরোধ হলে সেটা নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেটি অন্তরায়।’

এইচএস/এমএআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।