প্রতিকারের চেয়ে হয়রানি বেশি
বর্তমান বিশ্ব তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নির্ভর। বাংলাদেশও এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। একুশ শতকে বাংলাদেশকে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বর্তমান সরকার।
বাংলাদেশ এখন অনেকটাই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে। এ যুগে অপরাধও সংঘটিত হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে। অপরাধ রুখতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন (আইসিটি) করা হয়। এ আইনে অধিকাংশ মামলাই হয় মিথ্যা ও হয়রানি করার জন্য। মামলার পর বিবাদীদের বিরুদ্ধে অধিকাংশ অপরাধ প্রমাণ করতে না পেরে তাদের অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়।
জাগো নিউজের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত (২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের ২৬ জুলাই) তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে ১৪২৬টি মামলা বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালে এসেছে। এর মধ্যে সাজা হয়েছে মাত্র ১৮টি মামলার আসামিদের। অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় ২২০টি মামলার আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।
অধিকাংশ চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মামলা প্রমাণের জন্য কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাদী ও বিবাদীদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির কারণেই মামলা করা হয়েছে। এসব মামলা হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ সালের ৫৭ ধারায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের অধিকাংশ মামলাই মিথ্যা। হয়রানির উদ্দেশ্যেই মামলাগুলো দায়ের করা হয়। যারা মিথ্যা মামলা করছেন তাদের শান্তির আওতায় না আনায় এ ধরনের অপরাধ দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে।
চূড়ান্ত প্রতিবেদন-১
২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থানার খড়কী গ্রামের শফিকুল ইসলামের ছেলে জুলহাস ওরফে এম কে মাহমুদ আহমেদ তার ফেসবুকে জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে একটি ‘বিতর্কিত’ স্ট্যাটাস দেন।
ওই স্ট্যাটাসের পরিপ্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পরামর্শে হবিগঞ্জ সদর থানার উপ-পরিদর্শক রকিবুল হাসান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এর ৫৭ (২) ধারায় জুলহাসের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
অথচ ২০১৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর হবিগঞ্জ মডেল থানার উপ-পরিদর্শক পার্থ রঞ্জন চক্রবর্তী আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, মামলার আসামি জুলহাস ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সাক্ষ্যপ্রমাণে প্রমাণিত না হওয়ায় মামলার দায় হতে অব্যাহতি প্রার্থনা করছি।
২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনাল পুলিশের দেয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে আসামিকে অব্যাহতি প্রদান করেন।
তদন্তকারী কর্মকর্তা চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ফেসবুকে যে স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে তা সত্য। মামলার আসামির বিরুদ্ধে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি। আসামি যে মোবাইল নম্বর দিয়ে ফেসবুক আইডি খুলেছেন তা যাচাই করে দেখা যায় তা অন্য নামে। এছাড়া আসামি জুলহাস যে ফেসবুক আইডি থেকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন তারও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন।
এ প্রসঙ্গে ওই মামলার আসামি জুলহাস ওরফে এম কে মাহমুদ আহমেদ বলেন, আমি কোনো অপরাধ করিনি। আমাকে হয়রানি করার জন্য মিথ্যা মামলাটি দেয়া হয়েছিল। তদন্তেও সেটা প্রমাণিত হয়েছে।
চূড়ান্ত প্রতিবেদন-২
২০১৭ সালের ৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক এক ছাত্রী একটি ফেসবুক গ্রুপে ঢাবি অধ্যাপক ড. আবুল মুনসুর আহাম্মদের বিভাগের সম্পর্কে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হকের ফেসবুক স্ট্যাটাসকে উদ্ধৃত করে মাস্টার্স পরীক্ষার ফলাফলে দীর্ঘসূত্রতার জন্য অধ্যাপক ড. আবুল মুনসুর আহম্মদকে দায়ী করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনের প্রসঙ্গও টানেন। যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামান্য একটি বিষয়কে জটিল করে তোলে। ওই ফেসবুক গ্রুপটির সদস্য সংখ্যা ৬৯ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ওই ঘটনায় সংক্ষুব্ধ হয়ে ২০১৭ সালের ১২ জুলাই রাজধানীর শাহবাগ থানায় ড. আবুল মুনসুর আহাম্মদ বাদী হয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এর ৫৭ (২) ধারায় মামলাটি করেন। মামলায় একমাত্র আসামি করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হককে। ওই মাসের ৩১ জুলাই আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন রাজধানীর শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক ইমাম মেহেদী।
চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, আসামির বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে অপরাধ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু বাদী ও বিবাদী পক্ষ মামলাটি মীমাংসা করে নেয়ায় এবং বাদী মামলাটি চালাতে ইচ্ছুক না থাকায় আসামিকে অব্যাহতিদানের প্রার্থনা করা হলো।
২০১৭ সালের ১ নভেম্বর বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক পুলিশের দেয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি গ্রহণ করে আসামিকে অব্যাহতি প্রদান করেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ইমাম মেহেদী জাগো নিউজকে বলেন, মামলাটির প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। মামলার বাদী ও বিবাদী আপস-মীমাংসা করেছেন। তার কপিও আমাকে দিয়েছেন। মামলা চালাতে ইচ্ছুক নন বাদী। বাদী যদি মামলা না চালান তাহলে আর কি করার থাকে। তাই আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছি।
এ বিষয়ে মামলার বাদী ঢাবি অধ্যাপক ড. আবুল মুনসুর আহাম্মদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালে যেসব মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে সেগুলোর প্রায় সবগুলোরই একই দশা! কোনোটার ভিত্তি দুর্বল তো কোনোটার আপস-মীমাংসা করা হয়েছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনটির যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। অধিকাংশ মামলাই মিথ্যা ও হয়রানির জন্য করা হচ্ছে। মামলা করায় বিবাদীরা সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছেন। আর অর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অধিকাংশ মামলাই হয়রানির জন্য করা হয়। যেসব মামলার অভিযোগ মিথ্যা সেগুলোর বাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার সংখ্যা কমে আসবে।
‘বাদীর বিরুদ্ধে শান্তির কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় এ ধরনের অপরাধ দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে’- যোগ করেন তিনি।
এ ধরনের মামলা কেন নেয়া হয়- এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেলী ফেরদৌস জাগো নিউজকে বলেন, ‘আপতদৃষ্টিতে যে ঘটনা সত্য মনে হয় সে ধরনের মামলা নেয়া হচ্ছে। কিছু কিছু সময় দু-একটা মামলার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়ে যায়। আমরা আরও সচেতন হবো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের মামলা নেয়ার ক্ষেত্রে।’
বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নজরুল ইসলাম শামীম বলেন, ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা নেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশকে আরও সচেতন হতে হবে। যাতে নিরাপরাধ মানুষ হয়রানির শিকার না হয়।’
আইনজীবী এম হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘এ আইনে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে সঠিক আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় না। পুলিশও মামলা নেয়ার ক্ষেত্রে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে না। এ কারণে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ হচ্ছে। একটু সচেতন হলেই এটি রোধ করা সম্ভব।’
জেএ/এসএইচএস/এমএআর/এমআরএম