খুব পেইন হয়, স্প্লিন্টারগুলো এখনও কষ্ট দেয়

আদনান রহমান
আদনান রহমান আদনান রহমান , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:১২ পিএম, ৩০ জুন ২০১৮

‘হলি আর্টিসানে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। দ্রুত সেখানে যাও, লেক ভিউ ক্লিনিকে যাও।’ টহলে দায়িত্বে থাকা গুলশান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফারুক হোসেন ওয়াকিটকিতে বার বার এমন ম্যাসেজ আসছিল। গুলশানের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি সিরাজুল ইসলামের এমন নির্দেশনা পেয়ে গুরুত্বটা ঠিকই উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। ছুটে যান আর্টিসানে। নিজে এবং সঙ্গে থাকা কনস্টেবলের রাইফেল দিয়ে জঙ্গিদের আর্টিসানের ভেতরে থাকতে বাধ্য করেন। কোনোভাবেই তাদের পালাতে দেননি।

তিনিই গুলশান হামলার প্রথম প্রতিরোধকারী। অন্যের জীবন বাঁচাতে প্রায় নিজের জীবনই বিলিয়ে দিতে চলেছিলেন। বিধাতার ইচ্ছায় শেষ রক্ষা হয় তার।

গুলশান হামলার ২৪ মাস অতিবাহিত হয়েছে। পুরোপুরি সুস্থ হতে ৬-৭ মাস সময় কেটেছে হাসপাতালে। বিধাতা তাকে নতুন জীবন দান করেছেন। দান করেছেন বাংলাদেশ পুলিশের সর্বোচ্চ বিপিএম পদক (বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল)। এত কিছুর পরও ফারুককে স্বাভাবিক হতে দিচ্ছে না জঙ্গিদের ছোড়া গ্রেনেডের স্প্লিন্টারগলো। দুই বছর পরও হাঁটতে কষ্ট হয়। কেমন আছেন? উত্তরে তিনি জাগো নিউজকে বললেন, ‘নয়টা স্প্লিন্টার এখনও ভেতরে আছে। খুব পেইন হয়, স্প্লিন্টারগুলো এখনও কষ্ট দেয়।’

মানসিক শক্তি না হারালেও শারীরিকভাবে এখনও সেরে উঠতে পারেননি এসআই ফারুক। জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি আরও বলেন, ‘শরীরে মোট ২১টি স্প্লিন্টার ঢুকেছিল। এখনও নয়টা আছে। এগুলো হাড়ের মধ্যে ঢুকে যাওয়ায় বের করা সম্ভব হয়নি। এমনিতেই পায়ের নার্ভ কয়েকটা কেটে গেছে। অবশিষ্টগুলো বের করলে আরও নার্ভ কাটার সম্ভাবনা আছে। আরও ক্ষতি হতে পারে। এ কারণে সেগুলো রেখে দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি বাম পা’টা প্রায় অচল হয়ে গেছে। হাঁটতে খুবই কষ্ট হয়।’

দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক ফারুক পুলিশের ইউনিফর্মে মাঠে থাকলেও যতদিন যাচ্ছে স্প্লিন্টারগুলো তার কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শারীরিক অবস্থা জানতে চাইলে ফারুক বলেন, ‘তেমন ভালো নেই। বাম গালে ১টা, দুই পায়ের হাড়ের ভেতর আটটা স্প্লিন্টার রয়েছে। পেইন হয়, খুবই যন্ত্রণা হয়। হাঁটতে কষ্ট হয়। থাইল্যান্ডে গিয়ে একটা অপারেশন করেছিলাম। একটু ভালো হয়েছিল। কিন্তু চার মাস ধরে আবারও ব্যথা বেড়েছে।’

দুই বছর আগে আর্টিসানে হামলার দুঃসহ স্মৃতি এখনও তাড়া করে বেড়ায় ফারুককে। সেদিন (১ জুলাই, ২০১৮) হামলার সময় কোথায় ছিলেন?

ফারুক জানান, সেদিন কিলো এইট-ওয়ান (পুরো থানা এলাকা) ডিউটি ছিল। ইফতারের পর সাড়ে ৮টার দিকে আমরা টহল দিচ্ছিলাম। আমার সঙ্গে ছিল একটি গাড়ি, চার কনস্টেবল ও একজন ড্রাইভার। ওয়েস্টিন হোটেলের কাছাকাছি যাওয়ার পর শুনতে পেলাম আমাকে ওয়াকিটকিতে খুঁজছিলেন গুলশান থানার তৎকালীন ওসি (সিরাজুল ইসলাম) স্যার। ওপাশ থেকে তিনি বলছিলেন, ‘তুমি একটু দ্রুত হলি আর্টিসানে যাও, লেক ভিউ ক্লিনিকে যাও। দেখো ওখানে কী সমস্যা হচ্ছে। দ্রুত গিয়ে আমাকে বিস্তারিত জানাও।’

‘একই কথা বার বার বলেছিলেন। তার স্বর শুনেই বুঝেছিলাম সমস্যাটা ছোট ছিল না।’

ছয়জনের ফোর্স নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রওনা দিলাম। গুলশান-২ নম্বর ক্রস করার সময় স্যার (ওসি) আবারও ওয়াকিটকিতে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। এবার বললেন, ‘ওখানে হেলমেট-বুলেটপ্রুফ (জ্যাকেট) ছাড়া কেউ যাবেন না। সবাই হেলমেট-বুলেটপ্রুফ পরে নিন।’

পরে আমরা জ্যাকেট পরে আবার গাড়ি স্টার্ট করলাম। ড্রাইভার খুব এক্সপার্ট ছিল। দ্রুত আমাদের আর্টিসানে নিয়ে গেল। আর্টিসানের মেইন গেটে ঢোকার সময় রেস্টুরেন্টের পেছন থেকে একজনকে বের হয়ে আসতে দেখি। কিছুদূর এসেই পড়ে গেল। মাটিতে শুয়ে বললো, ‘স্যার আমার সমস্ত শরীরে রক্ত। আমাকে ধরেন। ভেতরে সব লোক মেরে ফেলছে। আমাকে কুপিয়েছে। আমাকে বাঁচান।’

ওই ছেলেকে ধরতে গিয়ে দেখি ৩-৪টা ছেলে আর্টিসানের ভেতরে ছুটোছুটি করছে। আমাদের দেখেই তাৎক্ষণিক একটা গ্রেনেড ছুড়ল। আমরাও পাল্টা গুলি করি। এটাই ছিল তাদের লক্ষ্য করে আমাদের প্রথম আক্রমণ, প্রথম প্রতিরোধ।

তাদের ছোড়া প্রথম গ্রেনেডে আমি সামান্য আহত হই। সঙ্গে থাকা কনস্টেবল প্রদীপ ও আলমগীর গুরুতর আহত হয়। আমি প্রদীপের রাইফেল হাতে নিয়ে ওদের লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকি। সঙ্গে দুই কনস্টেবলও গুলি ছুড়ছিল। আমরা আর্টিসানের বাইরে এর একপাশে সেল্টার নিয়ে থেমে থেমে গুলি করতে থাকি। তারাও অনবরত গুলি আর গ্রেনেড ছুড়ছিল।

আমাদের গুলি বর্ষণের কারণে ওরা ভেতরে ঢুকে রেস্টুরেন্টের দরজা আটকে দেয়। তখন আমরা বাইরের দরজাটি ব্লক করে ফেলি। আমি ওয়াকিটকিতে সাহায্য চাই। ঘটনার গভীরতা বুঝে, ‘কন্ট্রোল রুম সমস্ত স্টেশন বন্ধ করে শুধুমাত্র আমার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে।’ আমি কন্ট্রোলে বলি, ‘ফোর্স পাঠান। গুলিও পাঠান। আমাদের গুলি প্রয়োজন।’

এরপর ওয়াকিটকিতে সংযুক্ত হন ডিসি-গুলশান (মোস্তাক আহমেদ) স্যার। তাকে সবকিছু জানাই। উনি বললেন, ‘আমি সংবাদ পেয়েছি, চলে আসছি। তুমি ওখানেই থাকো।’

৫টা ৭ মিনিটের মধ্যে গুলশানের ডিসি ও ওসি স্যার চলে আসেন গুলি আর ফোর্স নিয়ে। সঙ্গে ছিলেন বনানীর ওসি (প্রয়াত সালাউদ্দিন খান) স্যার, গুলশান ও বনানী থানার পুলিশ সদস্যরা। ঊর্ধ্বতনরা আমার কাছে ঘটনাস্থলের বর্ণনা জানতে চান। ভেতরে কারা ঢুকেছে, তাদের বিবরণ জানতে চান। তখন তাদের বিস্তারিত জানাই। যা যা দেখেছি সেগুলো স্যারদের অবহিত করি।

তখন ডিসি স্যার ওয়াকিটকিতে নির্দেশ দেন, ‘পুরো গুলশান এলাকা কর্ডন করো।’ আমি সামান্য আহত ছিলাম। ডিসি স্যার আমাকে বললেন, ‘তুমি হাসপাতালে গিয়ে ট্রিটমেন্ট নাও।’

আমি ফোর্স রেখে যেতে রাজি হইনি। আমি বলি, ‘ফোর্স রেখে যেতে পারব না স্যার। আমি থেকেই যাই। পরবর্তী অভিযানে অংশ নিতে চাই।’

‘এরপর ডিএমপি কমিশনার (আছাদুজ্জামান মিয়া) স্যার আসেন। তার নির্দেশনায় সিনিয়র স্যাররা ভেতরে ঢুকে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছিলেন। ওরা (জঙ্গিরা) তখন লোক মারছিল ভেতরে। গুলি করছিল। দেখা যাচ্ছিল।’

‘সব ফোর্স রেডি। সোয়াটও (পুলিশের স্পেশাল উইপনস অ্যান্ড ট্যাকটিকস) প্রস্তুত। তাদের প্রতিরোধে হালকা পা বাড়ানোর পরই গ্রেনেড ছুড়ল। অনেকেই ছিটকে পড়েছিল। সেই হামলায় ওসি সালাউদ্দিন স্যার ও রবিউল স্যার মারা যান। আমিও তখন আহত হই।’

এরপর নিজেকে ইউনাইটেড হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করেন ফারুক। ফারুক বলেন, ‘আর্টিসানে আহত হওয়ার পর প্রথমে আমাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ১০ দিন চিকিৎসা নেয়ার পর আমাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) স্থানান্তর করা হয়। সিএমএইচে তিন মাস চিকিৎসার পর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে ১৫ দিন। তখন মোটামুটি সুস্থই ছিলাম। ডিউটি শুরু করি।’

‘কিন্তু ২-৩ মাস পর আবার ব্যথা অনুভব করতে থাকি। বুঝতে পারছিলাম শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। পায়ে পচন ধরেছিল। ডিসি স্যারকে জানাই। স্যার আমাকে সিএমএইচ ভর্তি হওয়ার কথা বলেন। নভেম্বরে আবার সিএমএইচে ভর্তি হই। সেখানকার চিকিৎসকরা আমাকে থাইল্যান্ড যাওয়ার পরামর্শ দেন। ডিসি স্যার থাইল্যান্ড পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।’

গত বছরের জুনে থাইল্যান্ডের বাম্রুনগ্রাড হাসপাতালে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ব্যাংককের ফিয়াথাই হাসপাতালে পায়ের একটি অপারেশন করা হয়। সেখানে ২১ দিন পর বাংলাদেশে সুস্থভাবে ফিরে আসি।

‘গত চার মাস ধরে আবারও পায়ে ব্যথা শুরু হয়েছে। সিএমএইচে ড. শফিক স্যারের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন আছি। কিছু ওষুধ দিয়েছেন, সেগুলো খাচ্ছি। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব কিনা- জানি না। আমি খুব একটা ভালো নেই।’

২০১৬ সালের ১ জুলাই আর্টিসানে জঙ্গিদের হামলায় ১৭ বিদেশি ও দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২২ জন মারা যান। জীবিত জিম্মিদের উদ্ধারে ২ জুলাই হলি আর্টিসানে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনা করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এতে হামলাকারী ছয় জঙ্গিও নিহত হন।

গুলশান হামলার সাতদিনের মাথায় শোলাকিয়ার ঈদ জামাতে হামলা করে জঙ্গিরা। এতে দুই পুলিশ কর্মকর্তা, এক নারী ও আক্রমণকারী জঙ্গি নিহত হন।

এআর/এমএআর/এমআরএম/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।