ধান-চালের দামে বাজেটের প্রভাব

মামুন আব্দুল্লাহ মামুন আব্দুল্লাহ
প্রকাশিত: ১০:৫৯ এএম, ২৭ জুন ২০১৮

‘গত ১০ বছরে বাজেটের পর জিনিসপত্রের দাম বাড়েনি। এবারও বাড়বে না। দেশবাসীর জন্য এটি আমার এবারের সুসংবাদ’- গত ৪ জুন সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এমন দাবি করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

তার ওই দাবি আগের নয় বছরে সত্য ধরে নিলেও এবার সেটা হয়নি। কারণ প্রস্তাবিত ২০১৮-১৯ সালের বাজেট ঘোষণার পর বেড়ে গেছে ধান ও চালের দাম। এ ক্ষেত্রে ধানের দাম মণপ্রতি বেড়েছে প্রকারভেদে ২০০ টাকা পর্যন্ত।

চালের দামও বেড়েছে। খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি চালের মূল্য বেড়েছে ২-৩ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজেটে চাল আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ হচ্ছে। এজন্য পাইকারি বাজারে চালের দাম বেড়েছে। ফলে এর প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারেও।

একই ধরনের কথা জানিয়েছেন জেলা পর্যায়ের চাতাল ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, চাতাল কলগুলোতে চালের দাম বাড়েনি। কিন্তু বাজারে ধানের দাম বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার পর বাজার ঊর্ধ্বমুখী বলে জানা গেছে। ১৫-২০ দিনের ব্যবধানে মোটা ধানের দাম বেড়েছে ২০০ টাকা পর্যন্ত।

প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানি করা চালের ওপর শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেন মুহিত। ৭ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘কৃষকের উৎপাদিত ধান-চালের ন্যায্য মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিতে চাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করে সর্বোচ্চ আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ এবং রেগুলেটরি ডিউটি ৩ শতাংশ পুনঃআরোপ করার প্রস্তাব করছি।’

এর আগে কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে যাওয়া চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে গত বছরের ২০ জুন আমদানি শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরপর দু’দফায় চাল আমদানিতে নির্ধারিত ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক এবং ৩ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু এবার বোরোর বাম্পার ফলন হওয়ায় এবং ঘাটতির তুলনায় ১০ গুণের বেশি চাল আমদানি হওয়ায় কৃষকের স্বার্থ চিন্তা করে পুনরায় সরকার চাল আমদানির ওপর ধার্য করা শুল্ক ২৮ শতাংশ করার চিন্তা করছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেটের পর বাড়তে শুরু করেছে ধানের দাম। ধানের এ বাড়তি দামের ধারা অব্যাহত আছে। শেরপুর জেলার নওহাটা এলাকার চাতাল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আবু শামা জাগো নিউজকে বলেন, ‘ধানের বাজার এখন অস্থির। আজ ৫০ টাকা বেশি তো কাল ১০০ টাকা। সবমিলিয়ে ১৫-২০ দিনের ব্যবধানে প্রকারভেদে ২০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে মোটা ধানের দাম বেশি বেড়েছে। কিন্তু চাতাল থেকে দাম বাড়ানো হয়নি। ফলে বেশি দামে ধান কিনে আগের দামেই চাল বিক্রি করতে হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘ঈদের আগে আটাশ ধান (চিকন) বাজারে কেনা-বেচা হয়েছে ৭৮০ টাকা দরে। এখন কিনতে হচ্ছে ৯০০-৯৫০ টাকায়। অন্যদিকে যে মোটা ধান ঈদের আগে কেনা হয়েছে ৬৮০-৭০০ টাকায় এখন তা ৮০০-৮২০ টাকা উঠেছে। বাজেট ঘোষণার পর কোনো কারণ ছাড়াই ধানের দাম বাড়ছে। এখনও সেটা অব্যাহত আছে।’

একই তথ্য জানান সেখানকার ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন। তিনি বলেন, ‘এখন কৃষকের হাতে তেমন ধান নেই। ধান চলে গেছে ব্যাপারীদের (মধ্যস্বত্বভোগী) কাছে। তারা সিন্ডিকেট করে ধানের দাম বাড়াচ্ছে। ফলে বাড়তি ধানের দাম কৃষকরা পাচ্ছেন না। অন্যদিকে, আমরা পাচ্ছি না বাড়তি চালের দাম। ফলে জনগণের টাকা খরচ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু টাকা যাচ্ছে মহাজনদের পকেটে।’

রাজধানীর খুচরা বাজারেও বেড়েছে চালের দাম। অজুহাত একই। ‘বাজেটে আমদানি করা চালের ওপর শুল্ক আরোপের প্রস্তাব।’ এ কারণে বেড়েছে চালের দাম। রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মিনিকেট চালের দাম আগের মতোই আছে। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৮ টাকায়। তবে কেজিপ্রতি ২ টাকা বেড়েছে নাজিরশাইল। এটি বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। ঈদের আগে এ চাল ৫৬-৫৮ টাকায় বিক্রি হয়।

মিরপুরের ‘মোল্লা রাইস’ এজেন্সির মালিক আজিজ মোল্লা বলেন, ‘ঈদের পরে চালের পাইকারি বাজারে দাম বেড়েছে। পাইকারি বাজারে সব চালের দাম বস্তায় ৫০-১০০ টাকা বেড়েছে। বাজেটের পর আমদানি চালের বিক্রি নেই বললেই চলে। তবে এ চালের দামও বাড়তি।’

তিনি বলেন, ‘বাড়তি দামও স্থির নয়। বর্তমানে নাজিরশাইল চাল ভালোটা বিক্রি হচ্ছে ২৮০০-২৯০০ টাকায়। মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ২৫৫০-২৬৫০ টাকায়।’

চালের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারি বাজার মনিটরিং সংস্থা- টিসিবিও বলছে একই কথা। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, গত সোমবার পর্যন্ত সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৬ টাকায়। এ চালই আগের সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ৫৮-৬৬ টাকায়। অর্থাৎ কেজিতে বেড়েছে ২ টাকা। এছাড়া নাজিরশাইল ৬০-৬২ টাকায়, যা আগের সপ্তাহে ২ টাকা কম ছিল। একই অবস্থা মোটা চালের দামের ক্ষেত্রে। রাজধানীর বাজারে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৩৮-৪২ টাকায়। তবে অন্যান্য চালের দাম তেমন বাড়েনি।

মিরপুরের চাল ব্যবসায়ী নান্টু পাটোয়ারী বলেন, ‘বাজেটে আমদানি করা চালের ওপর শুল্ক আরোপ হচ্ছে। এ অজুহাতে আড়ৎদাররা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে পাইকারি বাজারের দামের প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে।’

তিনি বলেন, ‘বাজারে চালের কোনো সংকট নেই। এরপরও দাম বাড়ছে। এর যৌক্তিক কারণ কেউ দিতে পারবেন না।’

তবে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী বলেন ভিন্ন কথা। তার দাবি, নতুন করে শুল্ক আরোপের পর আর চাল আমদানি হচ্ছে না। ধানের দাম বাড়ার কারণে চালের দাম বাড়ছে।

তিনি বলেন, ‘এ সময়ে ধানের দাম গড়ে মণপ্রতি ১০০-১৫০ টাকা বেড়েছে। ফলে চালের দাম তো বাড়বেই।’

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সরকারি গুদামে ১৩ লাখ ২৩ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুদ আছে। এর মধ্যে ১০ লাখ ৬৬ হাজার টন চাল এবং দুই লাখ ৫৭ হাজার টন গম। এছাড়া খালাসের অপেক্ষায় বন্দরে আছে ৫২ হাজার টন খাদ্যশস্য।

সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১ জুলাই থেকে গত ১১ জুন পর্যন্ত বেসরকারিভাবে ৮৩ লাখ ২০ হাজার টন খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ২৯ লাখ ৪৪ হাজার টন চাল এবং ৫৩ লাখ ৭৬ হাজার টন গম। এ সময়ে সরকারিভাবে আমদানি হয়েছে ১৫ লাখ ৯২ হাজার টন খাদ্যশস্য। এর মধ্যে ১১ লাখ ১৬ হাজার টন চাল এবং ৪ লাখ ৭৬ হাজার টন গম।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাজেট ঘোষণার সঙ্গে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক নেই। বাজারে সব পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক আছে। একই সঙ্গে বাজারে ধান-চাল পর্যাপ্ত রয়েছে। সরকারের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ মজুদও রয়েছে। এখন বিনা কারণেই দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।’

তিনি বলেন, ‘সরকার বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর সহজে হস্তক্ষেপ করে না। বাজার তার নিয়মেই বাড়বে আর কমবে। তবে কেউ যদি ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।’

এমএ/এমএআর/আরএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।