পড়াশোনা করতে চায় নির্যাতিত গৃহকর্মী শাওন
‘আমাকে বলেছিল ভালো স্কুলে ভর্তি করাবে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানাবে। আর মাঝে মাঝে পড়াশোনার পাশাপাশি বাজার করবে। তাই বাবা তাদের কাছে আমাকে দিতে রাজি হয়। এ কথা শুনে আমি বাবা-মাকে ছেড়ে বড় হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে তাদের বাসায় আসি।
এরপর বাবাকে দিয়ে আগের স্কুল থেকে সার্টিফিকেটটা আনিয়েছি, চেয়ারম্যান সার্টিফিকেটাও আনিয়েছি। কিন্তু কোথাও ভর্তি করায়নি ওরা। উল্টো তাদের বাসায় আসার পর থেকে লেখাপড়ার কোনো সুযোগই আমি পাইনি। এখন আপনাদের সবার সহযোগিতায় সুস্থ হয়ে আবার গ্রামে গিয়ে পড়াশোনা করতে চাই।'
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের শিশু বিভাগের ২০৩ নম্বর ওয়ার্ডের ৯ নম্বর বেডে বসে থমকে যাওয়া স্বপ্নের করুণ বর্ণনা দিচ্ছিলেন নির্যাতনের শিকার ১১ বছরের শিশু গৃহকর্মী জাহিদুল ইসলাম শাওন। বলার সময় ভয়ে নিশ্চুপ হয়ে পড়া চোখ যেন ছলছল করছিলো।
তার এই কথাগুলো বলতে চেয়েও কাউকে বলতে পারেনি নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ভয়ে। এ বয়সে কাঁধে স্কুলের বই নিয়ে পড়াশোনা মেতে উঠার কথা ছিল তার। অথচ নির্মম বাস্তবতায় দারিদ্রতার আঘাতে এটুকু বয়সে বাবা-মায়ের ভরসা হতে অনিশ্চিত গন্তব্যে পাড়ি দিতে গিয়ে নিজের সর্বনাশের ভয়াবহতা তাকে যেন হাসপাতালের বেডেও তাড়া করছিলো! বার বার নির্যাতনের কথাগুলো বলছে আর এ নিষ্ঠুরতার প্রকৃত বিচার চাচ্ছে শিশুটি ও তার পরিবার।
শাওনের বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ থানার উত্তর সাহেবগঞ্জে। সে ফরিদগঞ্জের বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় পঞ্চম শ্রেণি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠে। এরপর থেমে যায় তার পড়াশোনা। বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন কালু পেশায় কাঠমিস্ত্রী হওয়ায় দারিদ্রতার বেড়াজাল ছিন্ন করে তার লেখাপড়া নিশ্চিত করতে পারছিলেন না।
তাই বাড়ির পাশের পরিচিত বাসিন্দা গৃহকর্তার বাবার সূত্রে শাওনকে ঢাকায় কাজ করতে পাঠায় তার বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন। শর্ত ছিল ছেলেকে পড়াশোনা করাবে এবং এর পাশাপাশি টুকটাক বাজার করাবে। ফলে শিশু শাওন লেখাপড়া করতে পারবে এবং ওই পরিবারেরও উপকার হবে। যে কারণে শাওনের বাবা সন্তানকে দূরে ঠেলে দেয়ার কষ্টকর মুহূর্তেও উজ্জীবিত ছিলেন ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে।
এরপর গত ৭ মাস ধরে অর্থাৎ ২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে শাওন রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেনের ১২/এ, নম্বর বাড়ির ১১ তলার ১১০২ নম্বর ফ্ল্যাটের গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছিল। কিন্তু বিনিময়ে কোনো টাকা-পয়সা তো দেয়নি উল্টো তাকে বাসায় আনার সময় পড়াশোনা এবং স্কুলে ভর্তি করানোর যে শর্ত ছিল তাও ভেস্তে গেলো। দিনের পর দিন শিশু শাওনের ওপর নেমে আসে গৃহকর্তাদের অমানবিক নির্যাতন।
শাওন এ প্রতিবেদক জানায়, দিনের পর দিন তাদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বাবাকে বিষয়টি জানালে অত্যাচারের তীব্রতা আরও বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে চুরির অপবাদে তাকে একাধিকবার ইলেক্ট্রিক শক দেয়। ফলে শিশুটির হাতে, পায়ের তালুতে, পিঠে, ঘাড়েসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম লাগে। এমনকি তার বাবা জাহাঙ্গীরকেও এমন নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে বলে জানায় শিশুটি।
নির্যাতনের ভয়াবহতা থেকে প্রাণে বাঁচতে গত বুধবার রাতে ওই বাসার বাথরুমের পাইপ বেয়ে শাওন নিচে নেমে আসে। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। ধরা পড়ে যায়। এরপর শুরু হয় নতুন করে নির্যাতন। বিষয়টি স্থানীয় এক বাসিন্দার নজরে এলে তিনি হেল্প সেন্টার ‘৯৯৯’ নম্বরে ফোন দিয়ে সহায়তা চান। তাৎক্ষণিক এগিয়ে আসেন স্থানীয় রমনা থানা পুলিশ। তারা অভিযান চালিয়ে ওই বাসার গার্ডরুম থেকে শাওনকে বন্দি অবস্থায় উদ্ধার করেন। এবং এ ঘটনায় মো. ইকবাল (গৃহকর্তার শ্যালক), তার স্ত্রী তামান্না খান ও তানজিলুর রহমানকে (ইকবালের ভায়রা ও গৃহকর্তার ছেলে) আটক করা হয়। তবে গৃহকর্তা ও তার স্ত্রী এখনও পলাতক রয়েছেন।
শিশু শাওন জাগো নিউজকে বলেন, ভেবেছিলাম তাদের বাসা থেকে বের হতেই পারবো না কখনও। তবুও সবার সহযোগিতায় বের হয়ে এসেছি। এখন এ ঘটনায় আইনে যা হবার হবে। কিন্তু আমি হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে গ্রামে গিয়ে আবার পড়াশোনা করবো। বড় হয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করবো। এজন্য সবার সহযোগিতা চাই।
এসএইচ/এমআরএম/পিআর