প্রসূতির নিরাপদ ঠিকানা ইউএইচএফডব্লিউসি
তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভবতী মায়েদের কাছে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র (ইউএইচএফডব্লিউসি)। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য (এমসিএইচ) ইউনিটের অধীনে পরিচালিত এসব কেন্দ্রে প্রশিক্ষিত পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকাদের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা বিনামূল্যে নরমাল ডেলিভারি করানো হয়। ফলে ক্রমেই কেন্দ্রগুলো গর্ভবতী মায়েদের আস্থা অর্জন করছে।
জানা গেছে, কেন্দ্রগুলোতে স্বাভাবিকপন্থায় সন্তান প্রসবে বিনামূল্যে ডেলিভারি কিটসহ (১৫ ধরনের ওষুধ, গজ, ব্যান্ডেজ, তুলা) বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহ করা হয়। প্রতিটি ডেলিভারির জন্য অত্যাবশ্যকীয় অক্সিটসিন ইনজেকশন ও সংক্রমণ (ইনফেকশন) প্রতিরোধে ২০০ টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। শয্যা, বালিশ ও চাদরের জন্য প্রতিটি কেন্দ্রে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে আট হাজার টাকা।
পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা ও সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের (সাকমো) মাধ্যমে কেন্দ্রের আশপাশে নির্দিষ্ট এলাকার গর্ভবতী নারীদের তালিকা প্রণয়ন, প্রসবকালীন সময়ে কেন্দ্র থেকে ফলোআপ চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহিত, সর্বোপরি কেন্দ্রে প্রশিক্ষিত পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকার মাধ্যমে সন্তান প্রসবে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। তবে জটিলতা দেখা দিলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতালে রেফার্ড করা হচ্ছে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রকে সত্যিকার অর্থে সুচারু ও সফলতার সঙ্গে পরিচালনায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, ইউপি চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে কার্য়ক্রম চলছে। ইউপি চেয়ারম্যানদের সভাপতি করে ১৫ সদস্যের কমিটি প্রতি দুই মাসে একবার সভা করে কেন্দ্র পরিচালনায় প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী সরবরাহ নিশ্চিতের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। এ উদ্যোগের সুফল পাওয়া শুরু করেছেন গর্ভবতীরা।
তারা জানান, ২০১৪ সালে দেশে ইউএইচএফডব্লিউসিতে মাত্র ৫৬ হাজার ৯১২ গর্ভবতীর নরমাল ডেলিভারি হলেও ২০১৭ সালে তা দাঁড়ায় এক লাখ ১৮ হাজার ৮৬৯-তে।
সর্বশেষ ২০১৪ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ হেলথ ডেমোগ্রাফি সার্ভে (বিডিএইচএস) অনুযায়ী, বিগত দুই দশকে দেশে মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস পেয়েছে। ১৯৯০ সালে সন্তান জন্ম দেয়ার সময় প্রতি এক লাখ নারীর মধ্যে ৫৭৪ জন মারা যেতেন। মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি, এনজিও ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পর্যায়ক্রমে এ সংখ্যা কমে ২০০১ সালে ৩২২ এবং সর্বশেষ জাতিসংঘের মাতৃমৃত্যুর মূল্যায়ন ইন্টার-এজেন্সি গ্রুপের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে মাতৃমৃত্যু প্রতি লাখে ১৭৬ জনে দাঁড়িয়েছে। ২০২২ সালের মধ্যে এ সংখ্যা প্রতি লাখে ১২১ এবং ২০৩০ সালে এ সংখ্যা ৭০-এ নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে মন্ত্রণালয়।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য ইউনিটের উপ-পরিচালক ও মাতৃ ও প্রজনন স্বাস্থ্য কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. ফাহমিদা সুলতানা জানান, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক (২০১৭-২২ মেয়াদে) হেলথ পপুলেশন নিউট্রেশন সেক্টর প্রোগ্রামের (এইচপিএনএসপি) আওতায় মাতৃমৃত্যু রোধে গর্ভবতীদের সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক উপায়ে সন্তান প্রসবের ওপর অধিক গুরত্ব দিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে।
এ কর্মসূচিতে সন্তান প্রসবে স্কিল বার্থ অ্যাটেনডেন্টর সংখ্যা শতকরা ৪২ ভাগ থেকে ৬৫-তে উন্নীত, প্রশিক্ষিত মেডিকেল প্রোভাইডারদের মাধ্যমে চারবার প্রসবপূর্ব সেবা নিশ্চিত করা, প্রতি লাখে জীবিত নবজাতক মৃত্যুহার ১৭৬ জন থেকে ১২১-এ নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
দেশে প্রতি বছর ৩০ লাখ গর্ভবতী নারী সন্তান প্রসব করেন। বাংলাদেশ হেলথ অ্যান্ড ডেমোগ্রাফিক সার্ভে (বিডিএইচএস-২০১৪) অনুসারে শতকরা ৩১ ভাগ গর্ভবতী মা দক্ষ সেবা দানকারীর কাছ থেকে অন্তত চারবার গর্ভকালীন সেবা (অ্যান্টি নেটাল কেয়ার বা এএনসি) গ্রহণ করে থাকেন। এখনও শতকরা ৬৩ ভাগ প্রসব বাড়িতে হয়। মাত্র ৪৭ শতাংশ সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্য স্থাপনায় ডেলিভারি হয়।
মোট ডেলিভারির শতকরা ৪২ ভাগ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রসব সহায়তাকারী দ্বারা হয়। প্রসবের ৪৮ ঘণ্টায় শতকরা মাত্র ৩৪ ভাগ মা দক্ষ সেবাদানকারীর কাছ থেকে সেবা পেয়ে থাকেন।
বাংলাদেশ গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, মাতৃমৃত্যু হলো গর্ভকালীন, প্রসবকালীন অথবা প্রসব পরবর্তী ৪২ দিনের মধ্যে গর্ভজনিত কারণে কোনো মহিলার মৃত্যু যা গর্ভকালীন, প্রসবকালীন অথবা প্রসব পরবর্তী কোনো জটিলতা কিম্বা ব্যবস্থাপনাজনিত কারণে ঘটে। তারা জানান, রক্তক্ষরণ, একলাম্পশিয়া, বিলম্বিত বাধাগ্রস্ত প্রসব ও অনিরাপদ গর্ভপাত- এ চার কারণে মাতৃমৃত্যু হয়। মোট মাতৃমৃত্যুর শতকরা ৩১ ভাগ মা প্রসবের আগে, প্রসবের সময় কিম্বা প্রসব পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান। শতকরা ২০ ভাগ মাতৃমৃত্যু একলাম্পশিয়া (খিঁচুনিজনিত কারণ), শতকরা সাত ভাগ বিলম্বিত বা বাধাগ্রস্ত প্রসব এবং শতকরা এক ভাগ অনিরাপদ গর্ভপাতের কারণে ঘটে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, একটি দেশে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব বা সি-সেকশনের হার ১০-১৫ শতাংশের আশপাশে থাকা উচিত। কিন্তু বিডিএইচএস’র হিসাব বলছে, ২০১৪ সালে দেশে অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্মদানের হার ছিল ২৩ শতাংশ। এক দশক আগেও ২০০৪ সালে এ হার মাত্র পাঁচ শতাংশ ছিল। এখন বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় প্রায় ৮০ শতাংশ প্রসবই হচ্ছে সি-সেকশনের মাধ্যমে। সরকারি হাসপাতালে এ হার ৩৮ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে ডা. ফাহমিদা সুলতানা আরও জানান, অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান সংখ্যা হ্রাস করতে গ্রামীণ দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত গর্ভবতীদের বিনামূল্যে সন্তান প্রসবের সুবিধা প্রদান করছে ইউএইচএফডব্লিউসি।
তিনি জানান, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরে অধীনে সারাদেশে তিন হাজার ১৩১টি ইউএইচএফডব্লিউসি স্থাপনা রয়েছে। এসব কেন্দ্রে ২/১ জন করে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শক (মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ে ১৮ মাসের প্রশিক্ষণ ও ছয় মাসের মিডওয়াইফারি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত) রয়েছেন।
২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৩১ জন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকাকে প্রশিক্ষিত করে নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়া নয় মাসের স্কিল বার্থ অ্যাটেনডেন্ট (এসবিএ) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পরিবার পরিকল্পনা সহকারী রয়েছেন। ২০১৬ সালে উপজেলা মাতৃ ও শিশু পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে ৩৪০ জন ডাক্তার নিয়োগ দেয়া হয়।
তিনি জানান, বছর তিনেক আগে সেভ দ্য চিলড্রেনের উদ্যোগে এ, বি ও সি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে দেশের তিন হাজার ১৩১টি ইউএইচএফডব্লিউসির কোনটির কী অবস্থা তা নির্ণয় করা হয়। জরিপকালে ৪৪৬টি ‘এ’, দুই হাজার ১৫৫টি ‘বি’ ও ৫৩০টি ‘সি’ ক্যাটাগরির প্রমাণ পাওয়া যায়। পর্যায়ক্রমে এগুলোকে স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ ও স্থানীয় সরকারকে সম্পৃক্ত করে ইউপি চেয়ারম্যানদের সভাপতি করে গঠিত ১৫ সদস্যের কমিটির মাধ্যমে কেন্দ্রগুলোর সংস্কার, ডেলিভারি কিট ও ওষুধের মজুদসহ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেয়ার ফলে ইতোমধ্যে শতাধিক ইউএইচএফডব্লিউসিসহ পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের অন্যান্য সেবাদান কেন্দ্রে আগের তুলনায় নরমাল ডেলিভারির সংখ্যা বেড়েছে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, বিশ্ব ব্যাংক চতুর্থ এইচপিএনএসপি সেক্টর প্রোগ্রামে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে ১৬টি সূচকের ওপর ভিত্তি করে ৫১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ওই ১৬টি সূচকের মধ্যে ১০, ১১ ও ১৫ সূচক সরাসরি এমসিআরএএইচ অপারেশনাল প্ল্যানের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে ১০ (নরমাল ডেলিভারি) ও ১১ (ই ও সি বা জরুরি প্রসূতি সেবা কার্যক্রম বৃদ্ধি) নম্বর সূচকটি চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের জন্য প্রযোজ্য।
ওই কর্মকর্তা জানান, ২০১৬ সালে প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি সেবার সংখ্যা ছিল এক লাখ ২৮ হাজার ৮০৫টি, ২০১৭ সালে লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় এক লাখ ৩০ হাজার এবং ২০১৮ সালে এ লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে এক লাখ ৪০ হাজার হবে। ২০২২ সালে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব সেবার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৮০ হাজার।
প্রতি বছর প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব সেবা বাড়ানোর বিপরীতে বিশ্বব্যাংক শূন্য দশমিক ২১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার করে অর্থ সহায়তা করবে। সুতরাং আমরা এ লক্ষ্য অর্জনে সামর্থ্য হলে পাঁচ বছরে মোট ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা পাওয়া যাবে বলে ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের পরিচালক (মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য) ডা. মোহাম্মদ শরীফ বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে নরমাল ডেলিভারির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে না পারলে মাতৃ মৃত্যুরোধে কাঙ্ক্ষিত সফলতা আনা সম্ভব হবে না। এ লক্ষ্যে সারাদেশে কার্যক্রম শুরু হয়েছে এবং আগের তুলনায় মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস পাচ্ছে।
সম্প্রতি রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের উদেোগে ‘সরকারি স্বাস্থ্য খাতের স্বাস্থ্যকেন্দ্র শক্তিশালী করার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি বৃদ্ধি করা’ শীর্ষক অভিজ্ঞতা বিনিময় সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘বর্তমান সরকার তৃণমূল পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে গর্ভকালীন সময়ে একজন গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্যপরীক্ষা এমনকি নরমাল ডেলিভারির ব্যবস্থা করেছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের পর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোকে কার্যকর করতে স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে সুফল পাওয়া যাচ্ছে।
তিনি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে অর্থাৎ সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে স্বাভাবিক উপায়ে সন্তান ডেলিভারির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়মিত মনিটরিং ও সুপারভিশন প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন।
এমইউ/এএইচ/এমএআর/আরআইপি