আস্থার সংকটে ইসি!

সিরাজুজ্জামান
সিরাজুজ্জামান সিরাজুজ্জামান , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৩:৩১ পিএম, ০৮ মে ২০১৮

হাইকোর্টের আদেশে একের পর এক নির্বাচন স্থগিত হওয়ার পরও কার্যকর কোনো ভূমিকা না নেয়া, ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী কাজ করতে না পারা, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী মন্ত্রীদের কারণে সীমানা পুনর্নির্ধারণ থেকে পিছু হটা এবং বিএনপির আপত্তি সত্ত্বেও সংসদ সদস্যদের (এমপি) সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রচারণার সুযোগ দেয়ার উদ্যোগসহ নানা কারণে আস্থার সংকটে পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

এসব কারণে দায়িত্বভার গ্রহণের দেড় বছর না হতেই তাদের পদত্যাগের দাবিও উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা ইসির কাজে শিথিলতা দেখছেন। প্রশ্ন তুলেছেন, কার স্বার্থে কাজ করছেন তারা?

তবে এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন দুই নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিব। তারা বলছেন, সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানের কোনো ব্যর্থতা নেই। সবকিছু ঠিকঠাকভাবেই চলছে।

ঢাকার দুই সিটির পর গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন স্থগিত হওয়ায় ক্ষুব্ধ দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। এছাড়া ঢাকা সিটি নির্বাচন স্থগিতের পর এ নির্বাচন করার বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় ইসির ‘উদ্দেশ্য’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে গত রোববার সীমানাবিরোধ নিয়ে গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ওপর হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দেন। সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি শোনার পর ওই নির্বাচনের সব কর্মকাণ্ড বন্ধ ঘোষণা করে ইসি।

ওইদিন (রোববার) নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘হাইকোর্ট গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন স্থগিত করেছেন। এটা আমরা গণমাধ্যমে প্রচারিত খবরের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। আদালতের নির্দেশনার প্রতি ‘সম্মান’ রেখে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সব কার্যক্রম বন্ধ রাখতে সেখানকার রিটার্নিং কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’

অভিযোগ উঠেছে, নির্বাচন কমিশন নির্বাচন-সংক্রান্ত কোনো অনিয়মের খবর গণমাধ্যমে দেখেও ‘লিখিত অভিযোগ না পাওয়া’র কথা বলে কোনো ব্যবস্থা নেয় না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ওপর স্থগিতাদেশের পর নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমে আমি শিথিলতা লক্ষ্য করেছি। এর আগেও ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে একই ঘটনা ঘটেছিল। গাজীপুর তারই কার্বন কপি।’

‘তবে গাজীপুর নির্বাচন ভোটের খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। সেই সময়ই (ঢাকা সিটির স্থগিতের রায়) নির্বাচন কমিশনের অধিকারটা স্টাবলিস্ট করার প্রয়োজন ছিল যে, ইসিকে শুনানির সময় দেয়া হোক। ইসির কথা শুনে তো আদালত একটা জাজমেন্ট দেবে। কিন্তু এক মাস পর তারা (ইসি) আপিলে গিয়েছিল। কিন্তু এর ফলাফল কী হয়েছে আমরা কেউ জানি না। এসব কারণে নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘হাইকোর্ট স্থগিত করলেও তার ওপর তো অ্যাপিলেট ডিভিশন আছেন; চেম্বার জজ আছেন। সেখানে কালও যেতে পারে ইসি, পরশুও যেতে পারে। কিন্তু ইসি তা করছে না। তারা বলছে, রায়ের লিখিত কপি না আসলে কিছু করবে না। কিন্তু লিখিত কপি না আসলেও আপনারা (ইসি) রায়ের কথা শুনেই সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনের সব কাজ স্থগিত করে দিয়েছেন।’

‘ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেরও কোনো অগ্রগতি দেখছি না। এতে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম। বলেন, ‘দায় কার, এটা বলার সুযোগ আমার নেই। তবে আমি বলতে পারি, কমিশনের কোনো গাফিলতি ছিল না। আমরা গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ব্যাপারে স্থানীয় সরকার থেকে দুবার ক্লিয়ারেন্স নিয়েছি। তারা জানিয়েছে, সেখানে কোনো ধরনের জটিলতা নেই। তারা আমাদের নির্বাচন করতে বলেছে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী কাজ করতে পারছে না ইসি। গত বছর ডিসেম্বরের মধ্যে সংসদীয় আসনের সীমানা চূড়ান্ত করে গেজেট প্রকাশের কথা থাকলেও তা করেছে ৩০ এপ্রিল। ৩৮টি আসনের সীমানা পরিবর্তন এনে ৩০০ আসনের খসড়া গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। পরবর্তীতে শুনানি শেষে ২৫টির পরিবর্তন আনা হয়। কিন্তু চূড়ান্ত সংসদীয় সীমানা বিশ্লেষণ করে দেখে গেছে, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা খসড়া তালিকাতে থাকলেও পরে তাতে পরিবর্তন আনা হয়নি। এ কারেণে বিএনপি ইসির নতুন সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে।

গত ফেব্রুয়ারির মধ্যে পাঁচটি আইন ও নয়টি বিধিমালার সংস্কার চূড়ান্তের কথা থাকলেও এগুলোর কোনোটি এখনও শেষ হয়নি।

নির্বাচন সামনে রেখে অংশীজনদের সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সংলাপ শেষ করতে পারলেও সময়মতো এর সুপারিশ চূড়ান্ত করতে পারেনি ইসি। গত ডিসেম্বরের মধ্যে সংলাপের সুপারিশ চূড়ান্ত করে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানোর কথা থাকলেও তা শেষ করতে এপ্রিল পার হয়ে যায়।

এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাগো নিউজকে বলেন, ইসির বিতর্কিত কর্মকাণ্ড আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হচ্ছে। সব নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা আছে। কারণ এ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি।

ইসি সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করতে। তাই নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এখন সময়ের দাবি- বলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।

বিএনপির আপত্তি সত্ত্বেও এমপিরা যাতে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সময় প্রচার চালাতে পারে তার পক্ষে মত দিয়েছে ইসি। গত রোববার নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে আইন, বিধি-বিধান প্রণয়ন কমিটির এক সভায় এ প্রস্তাব তোলা হয়। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম নির্বাচন কমিশনে গিয়ে এ সুযোগ চান। তবে ইসির সঙ্গে বৈঠক করে এর বিরোধিতা করেছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।

এসব অভিযোগের বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা তো এখন দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। তারা কার স্বার্থে কাজ করছে; তারা জনস্বার্থে কাজ করছে কি না- এনিয়ে অনেকের মনে সন্দেহ আছে। ঢাকা সিটির নির্বাচন নিয়ে যে নাটক হলো আরেকটি নাটক মঞ্চস্থ হলো গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নিয়ে। এগুলো তো জনস্বার্থের পরিপন্থী। এর মাধ্যমে ভোটারদের ভোটাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, সংবিধান লঙ্ঘন হচ্ছে। জনগণ দারুণভাবে সংক্ষুব্ধ।’

ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘নির্বাচনের প্রস্তুতি সঠিকভাবেই চলছে। যে কোনো কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময় একটু এদিক-সেদিক হতেই পারে।’

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনগুলো স্থগিতের দায় নেব না আমরা। কারণ স্থানীয় সরকারের কাছে লিখিত অনুমতি পাওয়ার পরই আমরা তফসিল ঘোষণা করি। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে স্থগিতের বিষয়ে আপিল করা হয়েছে। আদালতের ওপর আমাদের কোনো হাত নেই।’

‘ইসি এখনও সবার আস্থায় আছে। কেউ যদি দাবি করে আমরা আস্থা হারাচ্ছি, সেটা তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য’- যোগ করেন তিনি।

এইচএস/এমএআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।