মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসা সেলে বিনামূল্যে সেবা মিলছে না
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য পৃথক ‘মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসা সেল’ খোলার প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করলেও সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সকল প্রকার চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না।
গত ২০ মে বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান ‘সি’ ব্লকের নীচ তলার ২২ নম্বর কক্ষে এ সেলের উদ্বোধন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কেবিন ব্লকে দুটি কক্ষে চারটি বেড (দুটিতে পুরুষ ও দুটিতে মহিলা) সংরক্ষিত রাখা হয়।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, উদ্বোধনের পর থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত সেল থেকে মোট ৬১২ জন মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার পরিজন (বাবা, মা, স্ত্রী ও সন্তান) চিকিৎসা সুবিধা পেয়েছেন। এছাড়াও কমপক্ষে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৯০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
মঙ্গলবার সরেজমিন মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসা সেল পরিদর্শনকালে আগত মুক্তিযোদ্ধা ও তার পরিবারের সদস্যরা জাগো নিউজের এ প্রতিবেদককে বলেন, বিএসএমএমইউ’র এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ব্যাপক প্রশংসনীয় হলেও সেল থেকে তারা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না।
তারা জানান- ব্লাড, এক্সরে, ইসিজি সাধারণ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা (যেগুলোর ফি ৫০০টাকা পর্যন্ত) সম্পূর্ণ বিনামূল্যে করা হলেও ক্যান্সার, হার্ট, কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন জটিল রোগব্যাধি নির্ণয়ের অত্যাবশ্যাক সিটিস্ক্যান, এমআরআই, এন্ডোসকপি, এনজিওগ্রাম করতে তাদেরকে শতকরা ৪০ ভাগ টাকা পরিশোধ করতে হয়।
এছাড়াও জটিল রোগ-ব্যাধি সারাতে যে সব দামী ওষুধ লাগে তার সিংহভাগই তাদের নিজেদেরকে বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনে আনতে হয়। কেবিনে মাত্র দুটি বিনামূল্যের বেড বরাদ্দ থাকার কারণে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে পেয়িং বেডে থেকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে বলে জানান মুক্তিযোদ্ধারা।
২০১৪ সালের ২৮ জানুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব নুরুন্নাহার স্বাক্ষরিত এক সার্কুলারে দেশের সকল সরকারি ও আধা সরকারি হাসপাতালে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের রোগ নির্ণয়সহ ওষুধ বিনামূল্যে সরবরাহের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছিল।
বলা হয়েছিল- দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা অর্জন তথা পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত করার জন্য ১৯৭১ সালে এ সকল অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারাই তাদের জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। জাতির প্রয়োজনে তাদের অনেকেই জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তাই সঙ্গত কারণেই আজ তারা ও তাদের পরিবার বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা প্রাপ্তির দাবি রাখে। সে লক্ষ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা অতীব প্রয়োজন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেই নির্দেশনা অনুসারে বিএসএমএমইউতে মুক্তিযোদ্ধারা বিনামূল্যে পরীক্ষানিরীক্ষা ও ওষুধ পাওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে সম্পূর্ণরূপে পাচ্ছেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- বিএসএমএমইউতে এনজিওগ্রাম করতে ৮০০০ টাকা, সিটি স্ক্যান ৫০০০ টাকা, এন্ডোসকপি ৫৮০০ টাকা, সিটি স্ক্যান ২০০০ টাকা ও কালার ডপলারে ২০০০ টাকা লাগে। মুক্তিযোদ্ধারা জটিল রোগ-ব্যাধির পরীক্ষা নিরীক্ষা ও ওষুধ সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেয়া যায় কিনা এ ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের জোর দাবি জানান।
সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা গেছে- ‘সি’ ব্লকের নীচ তলায় পৃথক মুক্তিযোদ্ধা সেল যে রয়েছে তা জানানোর জন্য প্রবেশপথের আশেপাশে কোথাও নির্দেশক চিহ্ন দেয়া নেই। ফলে ‘সি’ ব্লকে আসলে মুক্তিযোদ্ধা বা তার পরিবারের সদস্যরা সহজেই জানতে পারবেন না সেলে যোগাযোগের জন্য কোন দিকে যেতে হবে।
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টায় মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসা সেল সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায় সিরাজগঞ্জ সদর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান কর্তব্যরত এক যুবকের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে কেবিন পাবেন সে সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত জানতে এসেছেন।
তিনি জানান, তার ভাই সিরাজগঞ্জের গজারিয়া ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল হামিদ (৭০) গত একমাসেরও বেশি সময় ধরে হাসপাতালের ৫১৫ নম্বর ওয়ার্ডের ৮ নম্বর পেয়িং বেডে লিভার সমস্যা নিয়ে ভর্তি আছেন। চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাবদ তাদের অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। ফলে পরবর্তী চিকিৎসা চালাতে তারা রীতিমত হিমশিম খাচ্ছেন।
ওয়ার্ডের ডাক্তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় পেয়ে তাকে মুক্তিযোদ্ধা সেলে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। এখানে এসে জানতে পেরেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পুরুষ ও মহিলাদের জন্য দুটি কেবিন রাখা হয়েছে। তবে কেবিনগুলো এখন বুকড। এছাড়া ৫শ’ টাকার নীচের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সম্পূর্ণ ফ্রি ও ৫শ’ টাকার উপরের সব পরীক্ষায় শতকরা ৬০ ভাগ পরিশোধ করতে হবে।
চাঁদপুর মতলবের মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন খান জানান, সম্পূর্ণ না হলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আংশিক বিনামূল্যে চিকিৎসা দিচ্ছে এতেই তিনি সন্তুষ্ট। তবে হাসপাতাল থেকে জটিল রোগাক্রান্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দামী ওষুধ সরবরাহ করার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি বিনীত অনুরোধ জানান।
মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসা সেলে কর্তব্যরত সিনিয়র অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট আবদুল্লাহ জাগো নিউজকে জানান, ২০ মে উদ্বোধন হলেও তার কয়েকমাস আগে থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এ সেলের কাজ চলছে। এ পর্যন্ত ৯ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসা পেয়েছেন।
তিনি জানান, ৫শ’ টাকার নীচের সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সম্পূর্ণ ফ্রি। তবে ৫শ’ টাকার উপরের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে শতকরা ৬০ ভাগ ফ্রি।
এমইউ/এসএইচএস/পিআর