শীর্ষ ছয় আসামির ফাঁসি কার্যকর, অভিযোগ ছয় শতাধিক

মুহাম্মদ ফজলুল হক
মুহাম্মদ ফজলুল হক মুহাম্মদ ফজলুল হক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৫:১৫ পিএম, ৩০ মার্চ ২০১৮

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, দেশান্তর ও ধর্মান্তরসহ সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গত সাত বছরে ছয় শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করেছে।

ট্রাইব্যুনাল এখন পর্যন্ত মোট ৩১টি মামলায় ৬৮ জনের দণ্ড ঘোষণা করে রায় দিয়েছে। রায়ের পর বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ ছয় নেতার বিচার কার্যক্রম শেষ করে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। তারা হলেন- জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা, দলটির জ্যেষ্ঠ সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মো. কামারুজ্জামান, দলটির সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী এবং চট্টগ্রামের আলবদর কমান্ডার মীর কাসেম আলী।

মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগেও তাদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। সর্বশেষ আইনি ধাপ আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে করা রিভিউ শুনানির পর তাদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন সুপ্রিম কোর্ট। পরবর্তী পদক্ষেপে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।

শত প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়েও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গত ২৫ মার্চ অষ্টম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করেছে। সম্পূর্ণ নতুন বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে দেশের কলঙ্কময় অধ্যায় মুছে দিতে ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম পেয়েছে ঐতিহাসিক মর্যাদা। এ সময়ে বহু আলোচনা-সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে সংস্থাটির। তবুও এর বিচার কার্যক্রম থেমে থাকেনি। গঠনের শুরু থেকে অনেক সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতা থাকলেও বিগত সাত বছরে ট্রাইব্যুনাল নিজস্ব সক্রিয়তা দেখিয়েছে।

স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল, প্রসিকিউশন টিম এবং তদন্ত সংস্থা গঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেফতার এবং তাদের অপরাধের বিষয়ে তদন্তের উদ্যোগ নেয় ট্রাইব্যুনাল। নাগরিক সমাজের দাবি এবং তাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে বিচার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পুরাতন হাইকোর্ট ভবনকে আদালত হিসেবে প্রস্তুত করা হয়।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন সূত্র মতে, ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর ২০১৩ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত মোট ৩১টি মামলায় ৬৮ জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা হয়েছে। এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যাই বেশি। অন্যদিকে দণ্ডপ্রাপ্ত গোলাম আযম ও আব্দুল আলীম আপিল চলাকালীন সময়ে মারা যান।

সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগের চূড়ান্ত (রিভিউ) নিষ্পত্তি শেষে ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে ছয় আসামির। আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত একমাত্র আসামি হলেন জামায়াতের দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। তিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন।

একাত্তরের এসব ঘাতকের বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ায় জনগণের শতভাগ আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়েছে বলে মনে করেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাসগুপ্ত। সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার না হওয়া পর্যন্ত এর কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলেও মনে করেন ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্টরা।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাসগুপ্ত জাগো নিউজকে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দেশীয় মানবতাবিরোধীদের বিচারে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বিশেষ আইনে গঠিত এ ট্রাইব্যুনাল এখন পর্যন্ত ৩১ মামলায় ৬৮ জনের দণ্ড ঘোষণা করেছে। বেশির ভাগ আসামির ফাঁসির রায় ঘোষণা হয়েছে। ইতোমধ্যে ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। শুধুমাত্র সাঈদীর মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পর তার মৃত্যুদণ্ড কমে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেছেন সুপ্রিম কোর্ট।

তিনি বলেন, ‘যে উদ্দেশ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল, প্রসিকিউশন, তদন্ত সংস্থা এবং বিচারকরা মিলে গত সাত বছরে তার শতভাগ আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছেন। জাতি যে প্রত্যাশা নিয়ে ট্রাইব্যুনালে আমাদের প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল, আমরা বলতে চাই সে আশা পূরণে আমরা ব্যর্থ হয়নি। আমরা আশা পূরণে সক্ষম হয়েছি। জামায়াতকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সেখানে আরও বলা হয়েছে, স্বাধীনতার পর তারা যে কার্যক্রমগুলো চালিয়ে যাচ্ছে সেগুলোও একাত্তরের মতো একই ধারার।’

ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান বলেন, আমরা ৩১টি মামলার রায় পেয়েছি। সফলতার কথা বলতে হলে আমি বলব, শতভাগ মামলায় আসামিপক্ষ সাজা পেয়েছে। এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর কোনো ইতিহাসে আছে কিনা, আমার জানা নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাতটি সংস্থার বিরুদ্ধে বিচার হয়েছিল এবং তাদের নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

‘মহান স্বাধীনতা যু্দ্ধে অপরাধী সংগঠন জামায়াতের বিচার এবং স্থানীয়পর্যায়ের রাজাকারদের বিচার যত দিন শেষ না হবে ততদিন এ ট্রাইব্যুনাল থাকবে’- যোগ করেন তিনি।

ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা বলছে, এখনও ছয় শতাধিক রাজাকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তাদের হাতে। যাদের পর্যায়ক্রমে বিচারের আওতায় আনা হবে।

ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এম সানাউল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে প্রত্যাশা নিয়ে এ ট্রাইব্যুনালে আমাদের তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন, আমার মনে হয় সে আশা পূরণে আমরা ব্যর্থ হয়নি। আশা পূরণে আমরা সক্ষম হয়েছি। এখন সারা দেশের রাজাকারদের তালিকা তৈরি এবং এ বিষয়ে একটি আরকাইভ তৈরির প্রক্রিয়া চলছে।

ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটর মোখলেছুর রহমান বাদল বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা একাত্তরে জীবনবাজি রেখে, জীবন উৎসর্গ করে একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ে তোলার কল্পনা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটা মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বাংলাদেশ যেন সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সেই প্রচেষ্টা নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। জাতিকে কলঙ্কমুক্ত ইতিহাস থেকে মুক্তি দিতে আমরা একে একে বেঁচে থাকা সব যুদ্ধাপরাধীর বিচারের মুখোমুখি করে তাদের দণ্ড নিশ্চিত করছি। তাই এ বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে আমরা যারা জড়িত তারা নিজেদের সবসময় ভাগ্যবান মনে করি।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে সর্বমোট ৩০টি মামলার বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে একটি মামলার রায় যেকোনো দিন ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি), এছাড়া সাক্ষ্যগ্রহণ ও তদন্ত শেষে চলতি বছরে আরও নতুন কিছু মামলা যোগ হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।

এফএইচ/এমএআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।