নারীদের থেকে কাজ আদায় করে নিচ্ছেন, জায়গা দিচ্ছেন ছেলেদের

মুহাম্মদ ফজলুল হক
মুহাম্মদ ফজলুল হক মুহাম্মদ ফজলুল হক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৫:৪৫ পিএম, ০৮ মার্চ ২০১৮

অ্যাডভোকেট সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন প্রসিকিউটর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো নরপিশাচদের বিচারের মখোমুখি করার জন্য লড়াই করে যাওয়া এই সংগ্রামী নারীকে নিজের জীবনযুদ্ধেও কম সংগ্রাম করতে হয়নি। তবুও থেমে থাকেননি। শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে অদম্য ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে আইন পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেনছেন তিনি।

বাবার কর্মক্ষেত্রের সুবাধে অ্যাডভোকেট সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নির বেড়ে উঠা কুষ্টিয়া অঞ্চলে। সাত বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে পঞ্চম। এসএসসি পাশ করার পরপরই ১৯৮৯ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয় তাকে। স্বামী ব্যবসায়ী নাজমুল ইসলাম জীবনের সঙ্গে ঘর-সংসার শুরু হওয়ার পরেও নানা প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত গাহাস্থ অর্থনীতি কলেজ থেকে পুষ্টিবিদ্যা বিষয়ে বিএসসি পাশ করেন। পরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ধানমন্ডি ল' কলেজ থেকে আইন বিষয়ে অধ্যায়ন শেষ করে ২০০৩ সালে আইন পেশায় কাজ করা শুরু হয়। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে সনদ (এনরোলমেন্ট) পান। ২০১২ সালে অন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রকিসিউটর হিসেব যোগদান করেন অ্যাডভোকেট সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি।

ছোটবেলায় নাটক-সিনেমায় অভিনয় দেখে নয়, বাবার ইচ্ছা আর মায়ের অনুপ্রেরণায় আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। নিজের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত এই আইনজীবী দেশ, সমাজ ও আইন পেশার উন্নয়ন নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। নারীদের জন্য সুস্থ স্বাভাবিক এবং সুন্দর এক বাংলাদেশ দেখেতে চান। নারীদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবদান রাখতে চান তিনি। কাজ করে যেতে চান গরীব-দুঃখী নারীসহ সকল মানুষের জন্য।

জীবনের নানান স্মৃতি, আগামীর পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এই প্রথম গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেনে এই আইনজীবী। অ্যাডভোকেট সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক মুহাম্মদ ফজলুল হক।

জাগো নিউজ : শৈশব-কৈশোর-পড়ালেখা বিষয়ে কিছু বলবেন ?

সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি : বাবা ডাক্তার হওয়ার সুবাধে তার কর্মস্থল কুষ্টিয়াতেই জন্ম, বেড়ে উঠা, শৈশব-কৈশোর-পড়ালেখা সবকিছুরই শুরু। আমার প্রথম স্কুলে যাওয়া এবং কুষ্টিয়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের লেখাপড়ার দিনগুলো ছিল খুবই মজার। আমরা আটজন বান্ধবী ছিলাম। সবাই ডিবেট, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতাম। আমি খুব লাকি এই কারণে যে, যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তারা আমার জীবনে খুব পজিটিভ ভুমিকা পালন করেছে। আমরা একসঙ্গে ঘুরতে যেতাম, মজা করতাম। পাশাপাশি ওরা পড়াশুনার দিক দিয়ে খুব সিরিয়াস ছিল।

prosecutor

জাগো নিউজ : ভাইবোনদের বিষয়ে বলবেন কী ?

সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি : আমরা ভাইবোন মোট নয়জন। সাত বোন, দুই ভাই এর মধ্যে তিন বোন এক ভাই আমার বড়, আমি পঞ্চম। আবার আমার ছোট্ট এক ভাই ও তিন বোন। আমাদের সবার বড় বোন আইএফআইসি ব্যাংকে, মেজ বোন রুপালী ব্যাংকে, সেজ বোন জনতা ব্যাংকে আছেন, তার পর ভাই পরিবারসহ আমেরিকায় বসবাস করেন। আমি আইনজীবী। ষষ্ঠ ভাই ব্যবসা করেন, সপ্তম বোন পরিবারসহ আমেরিকায় বসবাস ও বুটিকের ব্যবসা করেন ও অষ্টম বোন একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষক এবং সবার ছোট বোন সাংবাদিক (ফারজানা খান গোধূলী)।

জাগো নিউজ : বিয়ে, সংসার নিয়ে বলুন-

সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি : আমার বোনদের বেশির ভাগ বিয়ে হয়েছে এসএসসি বা এইচএসসি পাশ করার পর অথবা লেখাপড়া চলাকালীন। এমনকি আমারও বিয়ে হয় এসএসসি পাশ করার পরপরই ১৯৮৯ সালে। তার পরও আমরা লেখাপড়া করেছি মায়ের উৎসাহে।

জাগো নিউজ : বিয়ের পরে লেখাপড়া করেছেন, সমস্যা হয়নি ?

সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি : এসএসসি পাশ করার পর শ্বশুর বাড়িতে থেকেই স্ট্রাগল আর যুদ্ধ করে পড়াশোনা করতে হয়েছিল। সার্পোট তো ছিলই না বরং মানসিক টর্চার ছিল। মা বলেছিলেন শ্বশুর বাড়িতে সমস্যা হলে বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য কিন্তু তা আর করতে হয়নি। কারণ লেখাপড়ায় স্বামীর সহযোগিতা ছিল।

জাগো নিউজ : পুষ্টিবিদ্যায় বিএসসি কারার পর আইন কেন পড়লেন ?

সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি : বাবা আমাকে আইনজীবী না হলে শিক্ষক হওয়ার জন্য বলতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পুষ্টিবিদ্যায় বিএসসি করার পরেও বাবার ইচ্ছা এবং নিজের স্বপ্ন নিয়ে সেই মানসিকতা থেকে স্বাধীন পেশা হিসেবে আইনজীবী হওয়া। এখানে নিজেকে স্বাধীনভাবে উপস্থাপন করা যায়, নারী ও সকল মানুষের এবং সমাজের জন্য কাজ করা যায়।

prosecutor

জাগো নিউজ : পেশার বাইরে মানুষের কল্যাণে কী কী করেছেন ?

সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি : আইন পেশায় আসার কারণে মানুষের কল্যাণে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। যেমন- বেশ কিছু মামলা বিনা খরচে করার সুযোগ। বিশেষ করে নারীদের পক্ষে মামলা করার সময় কোনো অর্থ গ্রহণ করিনি। এমন অনেক সুযোগ পেয়েছি। অন্য কোনো পেশায় এই সুযোগ আছে কিনা তা আমার জানা নেই।

জাগো নিউজ : নারীদের কল্যাণে কী করেছেন ?

সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি : আমার কাজে বিশ্বাসী, প্রচারে না। তাই নিযার্তিত নারীদের পক্ষে বিনা খরচে মামলা পরিচালনা ও গরীব অসহায় নারীদের জন্য সেলাই মেশিন এবং অর্থ সহায়তা করেছি। এছড়াও নিজে সহযোগিাত করার পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকার অসহায় নারীদের সহযোগিতা করার জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং অন্যান্যাদের সহযোগিতা কামনা করে সুপারিশ করেছি।

জাগো নিউজ : মায়ের অনুপ্রেরণার কথা বলছেন, তার সঙ্গে আর কে কে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন ?

সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি : মা মরহুম সুফিয়া বেগম গৃহিণী হওয়ার পরেও আমাদের অনুপ্রেরণা আর উৎসাহ দিতেন। তার সঙ্গে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন বাবা মরহুম আনোয়ার আহমেদ খান এবং বড় বোন।

prosecutor

জাগো নিউজ : আইন পেশার শুরুটা জানতে চাই-

সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি : বাবাার ইচ্ছা আর মায়ের অনুপ্রেরণায় ২০০৩ সালের সৈয়দ রেজাউর রহমান স্যারের চেম্বারে কাজ শুরু করি। ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে মো. মোখলেসুর রহমানের সঙ্গে প্র্যাকটিস শুরু করি। সৈয়দ রেজাউর রহমান স্যারের সঙ্গে থাকতে অনেক নারী নির্যাতনের মামলা বিনা পয়সায় করেছি। এখন পযন্ত অন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রায় ১৭/১৮টি মামলা করেছি।

জাগো নিউজ : স্ত্রী হিসেবে সংসারের কাজে স্বামীর সহযোগিতা কেমন পান ?

সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি : একদমই না। এখানেই পুরুষদের সঙ্গে নারীদের তফাৎ। আমাদের অফিসের কাজ এবং সংসারের সকল কাজ করতে হয়। সকালে রান্না, স্বামী এবং মেয়েকে গুছিয়ে দিয়ে নিজের বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি। আবার ফিরে গিয়ে সংসারের কাজ করতে হয়। এই কাজে স্বামীর সহযোগিতা পাওয়া যায় না। এখানে যদি স্বামী-স্ত্রী দুজনে সংসারের কাজ ভাগাভাগি করে নেয় তাহলে কাজের কোনো সমস্যাই থাকে না।

জাগো নিউজ : কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সহযোগিতার বিষয়ে বলবেন কী ?

সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি : কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্য করা হয় না। তবে মেয়েদের কাজ করানো হয় বেশি। কিন্তু উন্নতি বা ওপরের উঠার ক্ষেত্রে পুরুষদের প্রাধান্য দেয়া হয়। বসরা নারীরদের কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিচ্ছেন, আর যখনি জায়গা দিতে হচ্ছে তখন জায়গা করে দিচ্ছেন ছেলেদের।

জাগো নিউজ : আইন পেশায় আগতদের জন্য আপনার পরামর্শ

সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি : আসলে আইন পেশায় লেগে থাকতে হয়, অনেক খাটতে হয়। খুব কম টাকা পাওয়া যায় শুরুর দিকে। আমরা দেখেছি কষ্টটা করলে পরের দিকে ফলটা পাওয়া যায়। যারা নতুন আসছেন তাদেরকে রিকোয়েস্ট করবো- অবশ্যই আপনারা আসবেন একটু ধৈর্য ধরবেন, লেগে থাকবেন। ধৈর্য নিয়ে কষ্ট করতে হবে। এই কষ্টটা যদি কেউ করতে পারেন তাহলে তিনি অবশ্যই একজন ভাল উকিল হবেন। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, কেউ ধৈর্য সহকারে কাজ করলে তিনি একজন ভাল মানুষ হবেন। সো, ধৈর্য আর ধৈর্য।

prosecutor

জাগো নিউজ : নারী দিবস এবং নারীদের মূল্যায়ণ করুন।

সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি : নারীরা যাতে বিজ্ঞাপনের পণ্য না হয়। নিজেরা নিজেদের মূল্যায়ণ করতে শেখে। কোনো প্রকার প্রলোভন এবং ছল-চাতুরিতে যেন ধরা না পড়ে এই বিষয়ে নিজেদের সচেতন থাকার পশাপাশি অন্যান্যদের সচেতন করে তোলা।

অবহেলিত, বঞ্চিত, পিছিয়ে পড়া নারী এবং উদ্যোক্তা নারীদের কল্যাণে পাশে দাঁড়ানোর জন্য দেশের সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক এবং এনজিওগুলোকে আহ্বান জানিয়েছেন আইন পেশাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়া এই প্রসিকিউটর।

জাগো নিউজ : আগামীতে কেমন বাংলাদেশ প্রত্যাশা করেন ?

সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি : নারীর যোগ্যতা অনুযায়ী প্রাপ্য সম্মান, নিযার্তন মুক্ত নিরাপদে একা চলার সুন্দর পথ, সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ এবং আত্মসম্মান। এককথায় নারী এবং পুরুষের সমন্বয়ে একটি সুন্দর আগামীর বাংলাদেশ চাই।

জাগো নিউজের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।

সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি : জাগো নিউজকেও ধন্যবাদ।

এফএইচ/এমবিআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।