পরচুলায় জীবন বেঁধেছেন ইসমত আরা
শুরুটা একেবারে শূন্য হাতে। কিন্তু কয়েক বছরের ব্যবধানে আজ তিনি জীবন সংগ্রামে হয়ে উঠেছেন সফল এক নারীর প্রতিকৃতি। ‘পরচুলা’ বা হেয়ারক্যাপ তৈরি করে তিনি পাল্টে দিয়েছেন জীবনধারা। তাইতো সমাজে তিনি আজ এক অনুকরনীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। তার হতদরিদ্র জীবনে যেমন স্বচ্ছলতা এসেছে, তেমনি তিনি অনেক নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
জীবনযুদ্ধে সফল এই নারীর নাম ইসমত আরা। তার তৈরি ‘পরচুলা’ (হেয়ারক্যাপ) এখন বিদেশে রফতানি হচ্ছে। তার কাছে হাতে-কলমে শিক্ষা লাভ করে তারই কারখানায় বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন ১২০ জন নারী কর্মী। যাদের আর্থিক সংকট অনেকটাই মোচন হয়েছে।
শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার পশ্চিম নন্নী গ্রামের অধিবাসী এই নারী জানান, তার বাবা একজন ভূমিহীন দিনমজুর। মা দুলুফা খাতুন গৃহবধূ। ৪ সন্তানের মধ্যে তিনি একমাত্র মেয়ে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে আর পড়তে পারেননি। এরপর একই গ্রামের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আবু তালেবের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পরও অভাব তাদের পিছু ছাড়েনি। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর উপক্রম।
কিন্তু ঢাকায় চাচাতো বড় বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে তার সামনে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে যায়। যেখানে তার বোন তাকে পরচুলা (হেয়ার ক্যাপ) তৈরির প্রশিক্ষণ নিতে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি সেখানে তিনমাস পরচুলা তৈরির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং আরো তিনমাস সেখানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। পরে শেরপুরে তার গ্রামে ফিরে এসে কয়েকজনকে হাতেকলমে কাজ শেখান।
২০১৩ সালে মাত্র ৪ জন কর্মী নিয়ে তিনি পরচুলা তৈরি শুরু করেন। ঢাকার শিশির ক্যাপ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। প্রতিষ্ঠানটি হেয়ারক্যাপ তৈরির জন্য সকল উপকরণ সরবরাহ করে। চাহিদা অনুসারে পরচুলা তৈরি করে মজুরী পান তারা। পরচুলার সাইজ অনুসারে প্রতিটি হেয়ার ক্যাপের জন্য ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকা মজুরি দেয়া হয়। একদন দক্ষ শ্রমিক ২ দিনে ১টি পরচুলা তৈরি করতে পারেন।
আত্মবিশ্বাসী নারী ইসমত আরা জোনান, তার কারখানায় বর্তমানে ১২০ জন নারী শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। এদের প্রতিমাসে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা মজুরি দিয়ে থাকেন। আর সবাইকে মজুরির টাকা এবং উকরণ খরচপত্র বাদ দিয়ে প্রতিমাসে নিজের আয় থাকে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। তাদের ২ ছেলে-মেয়ে। মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে এবং ছেলে প্রথম শ্রেণির ছাত্র। এখন তার নিজস্ব বাড়ি হয়েছে। সংসারে স্বচ্ছলতাও এসেছে।
কথা প্রসঙ্গে ইসমত আরা বলেন, তিনি তার ভাইদের সহ প্রায় ৪ শতাধিক নারী পুরুষকে পরচুলা তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তারা এখন ঢাকার বিভিন্ন ক্যাপ তৈরির প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করছেন।
তিনি জানান, জাপান, থাইল্যান্ডের নাগরিকরাই এসব পরচুলা বেশি ব্যবহার করেন। সেসব দেশেই ঢাকার ‘বায়ার’ বা বিক্রেতাদের মাধ্যমে এসব পরচুলা রফতানি হয়ে থাকে।
তার ইচ্ছা কারখানাটি আরো বড় করার এবং নিজেই তার উৎপাদিত পরচুলা বিদেশে রফতানি করার। এজন্য মোটা অংকের পুঁজির প্রয়োজন। কোনো ব্যাংক বা আর্থিক সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলে তার ইচ্ছা পূরণ হতে পারে।
শূন্য থেকে শুরু করে অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী হিসেবে গত বছর জেলা প্রশাসন ও মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদফতর ইসমত আরাকে শেরপুর জেলা পর্যায়ে ‘শ্রেষ্ঠ জয়িতা’ নির্বাচন করে সম্মাননা প্রদান করে।
হাকিম বাবুল/এফএ/আরআইপি