আস্থার প্রতিদান দিচ্ছেন নারী পুলিশ সদস্যরা
সিনিয়র এএসপি কাজী রোমানা নাসরিন। গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ক্লোথিং অ্যান্ড টেক্সটাইল বিভাগ থেকে বিএসসি ও এমএস শেষ করেন। ৩১তম বিসিএসের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশে এএসপি হিসেবে যোগদান করেন খাগড়াছড়ি জেলার এ কৃতি সন্তান।
একটি বছর যোগ্যতা ও সফলতার সঙ্গে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেন। সম্প্রতি দেশে ফিরে গত সপ্তাহে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক উত্তর বিভাগের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার সিনিয়র এএসপি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।
হাতিরঝিল সংলগ্ন নিজ কার্যালয়ে বুধবার জাগো নিউজ’র মুখোমুখি হন তিনি। আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে এক সাক্ষাৎকারে তিনি নারীর উন্নয়ন, কর্মক্ষেত্রে নারীর যোগ্যতা, বৈষম্য, পদায়ন, অধিকার ও মর্যাদা, পুলিশে নারীদের অগ্রগামিতা এবং নারীদের এগিয়ে যাবার সংকল্পের কথা ব্যক্ত করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজ’র নিজস্ব প্রতিবেদক জসীম উদ্দীন।
জাগো নিউজ : কেমন আছেন?
কাজী রোমানা নাসরিন : জ্বি ভালো আছি। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে অগ্নিঝরা বক্তব্য রেখেছিলেন। ঐতিহাসিক দিনটি উপলক্ষে রাজধানীতে জনসভার আয়োজন করা হয়েছে। সেজন্য সকাল থেকেই ব্যস্ততা।
জাগো নিউজ : নারী দিবস আসে, দিবস যায়। সার্বিক দিক বিবেচনায় নারীদের প্রতি বৈষম্য কমছে কি? আপনার কী মনে হয়?
কাজী রোমানা নাসরিন : কখনও বৈষম্য করে কাউকে আটকে রাখা যায় না। বীজ যেমন মাটি ভেদ করে অঙ্কুরিত হয় তেমনি মেধাবীরা নিজ যোগ্যতায় তার আসন অলঙ্কৃত করবেই। বীর বাঙালিরা যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। স্বাধীনতার পর থেকে একটু একটু করে এগিয়েছে নারীরা। বৈষম্য কমেছে। তবে তা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের নয়। এটা জিরোতে আনতে নারীদেরই অগ্রগামী হতে হবে।
জাগো নিউজ : নিজ বাহিনীতে নারীদের অবস্থা আপনি দেখছেন। পুলিশে নারীদের অগ্রগতি সম্পর্কে যদি বলতেন?
কাজী রোমানা নাসরিন : এক সময় তো পুলিশে নারীদের নিয়োগই ছিল না। নারীদের নিয়োগ শুরু হওয়ার পর সরকারের আস্থার প্রতিদান দিয়েছে নারী পুলিশ সদস্যরা। এখন আর এটা বলার সুযোগ নেই, নারীরা পারবে না। পারে না এটা নারীরাও আর বিশ্বাস করে না। শতাংশের হিসাব করলে হয়ত পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা পুলিশে অনেক কম। কিন্তু এজন্য দায়ী আমরা নারীরাই। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মানসিকতা অর্জন করতে হবে। প্রমাণ দিতে হবে নিজেকে। সেই দিকটায় বেশ এগিয়েছে নারীরা। সামনে এর প্রমাণ পাবেন।
জাগো নিউজ : নারীদের সম-অধিকার ও মর্যাদা পাবার ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে আপনি কতটা দায়ী করবেন?
কাজী রোমানা নাসরিন : আমার কাছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা কিংবা চিন্তা-চেতনা নারীকে পিছিয়ে দেবার ক্ষেত্রে দায়ী নয়। আমার দাদী ১০৫ বছর বয়সে মারা গেছেন। তিনি পাকিস্তান প্রিয়ডে হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। আমার বাবাও শিক্ষক ছিলেন। সবাই আমাকে প্রেরণা দিয়েছেন। যে কারণে আজ আমি বিসিএস দিয়ে পুলিশে। আমার ছোট বোনও বিসিএস দিয়ে শিক্ষা ক্যাডারে যুক্ত। ছোট ভাইও ডাক্তারি পড়ছে। সুতরাং অবহেলা পাইনি।
কর্মক্ষেত্রে, পরিবারে, সমাজের প্রত্যেকটি স্তরেই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার মানুষ রয়েছে। খেয়াল করে দেখবেন যেসব নারী পিছিয়ে কিংবা যোগ্যতা ও মেধা থাকার পরও উঠে আসতে পারেননি তাদের এগিয়ে নেয়ার মতো কেউ নেই। বরং পেছন থেকে টেনে ধরা হয়েছে।
আবার এটাও দেখতে পাবেন, যেসব নারী যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন, দেখবেন তার পরিবার, স্বামী, আত্মীয়রা অনেক বেশি পজিটিভ। অনেক বেশি মোটিভেট করেছে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে। এই এগিয়ে যাবার প্র্যাকটিসটা কিংবা মানসিকতার পরিবর্তনের ধারাটা ছড়িয়ে দিতে হবে সব স্তরে।
জাগো নিউজ : মেধা কিংবা যোগ্যতার কারণে কি অবস্থানগত ও মর্যাদায় নারীরা পিছিয়ে যাচ্ছে?
কাজী রোমানা নাসরিন : যোগ্যতা ও মেধা নারীর যথেষ্ট রয়েছে। পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট, দেশ-বিদেশ, মঙ্গল গ্রহে- কোথায় পিছিয়ে নারী? নারীদের পিছিয়ে থাকার ক্ষেত্রে অন্যান্য কারণের চেয়ে আমার কাছে নারীর মানসিকতাকেই বেশি দায়ী মনে হয়েছে। কারণ পরিবার, সন্তান, বাবা-মা, স্বামীসহ সবাইকে নিয়ে নিজেকে সামলানো, নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দেয়ার ক্ষেত্রে নারীরা অনেকটা ভাবনায় পড়েন। এখান থেকে বের হতে হবে। নিজেকে নারী না ভেবে কিংবা পুরুষের সঙ্গে তুলনায় না গিয়ে নিজেকে মানুষ ভেবে যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে হবে। কারও করুণায় নয়, নিজের যোগ্যতার মাপকাঠিতে প্রমাণ দিয়ে নারীরা আরও এগিয়ে যাবে।
জাগো নিউজ : দেশে-বিদেশে নারীরা উদ্যোগী হচ্ছে। যোগ্যতার প্রমাণ রাখছে। ব্যবসা, চাকরি, শিক্ষা, রাজনীতিসহ সবক্ষেত্রে নারীরা আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?
কাজী রোমানা নাসরিন : সবকিছুর মূলে মূল্যবোধ। নারীদের মধ্যে মূল্যবোধ জন্মেছে। দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এখন নারীরাও উদগ্রীব। ব্যবসা, চাকরি, শিক্ষা, রাজনীতিসহ সবক্ষেত্রে দেখবেন যেখানে নারীরা অংশীদারিত্ব পেয়েছে, দায়িত্ব পালন করছে সেখানেই সফলতা এসেছে। আমিও নিজে একটি বছর পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে মিশনে কাটিয়ে আসলাম। জাতিসংঘে সফলতার জন্য নারীদের নিয়ে আলাদা টিম করা হয়েছে। এসবই তো নারীর সফলতা। জাতিসংঘ মিশনে নারীর অংশগ্রহণ আন্তর্জাতিক মানচিত্রে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছে।
জাগো নিউজ : ট্রাফিক বিভাগে নারীদের কাজের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কোনো সমস্যা হচ্ছে কি?
কাজী রোমানা নাসরিন : চ্যালেঞ্জ সবখানেই। আপনি উপরে উঠতে চাইলে পরিশ্রমী, মেধাবী ও দক্ষ হতে হবে। পুলিশের ট্রাফিক বিভাগে কাজ করার ক্ষেত্রে সফলতার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে আপনাকে শৃঙ্খল হতে হবে। অন্যান্য ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে সার্বক্ষণিক কমিউনিকেশন রাখতে হবে। তাহলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় উন্নতি আনা যাবে।
ট্রাফিক বিভাগে নারী সার্জেন্ট নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। নারী কর্মকর্তারাও রয়েছেন। ট্রাফিক বিভাগে নারীরা যে সফলতা পাচ্ছে তা আর বলতে হয় না। তবে কিছু সমস্যা তো রয়েই যায়। ট্রাফিক বিভাগে নারী সদস্যদের জন্য আলাদা টয়লেট, ওয়াশরুম কিংবা রেস্টরুম নেই। রোদে পুড়ে কিংবা বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করতে হয়। সময় বদলাচ্ছে। সামনে এ চিত্রও থাকবে না।
জাগো নিউজ : নারীদের এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আপনার ব্যক্তিগত অভিমত কী?
কাজী রোমানা নাসরিন : মোটিভেশন, তবে সভা-সেমিনারে সেটি আটকে থাকলে হবে না। নিজেকে এগিয়ে নিতে হবে। কথা কম, কাজে বেশি মনোনিবেশ করাই আমার কাছে নারীর সফলতার অন্যতম চাবিকাঠি।
জাগো নিউজ : নারী দিবস উপলক্ষে শুভ কামনা রইলো। ভালো থাকবেন…
কাজী রোমানা নাসরিন : জাগো নিউজকে ধন্যবাদ। আশা করছি জাগো নিউজ তাদের পাতায় নারীদের নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করবে।
জেইউ/জেডএ/আরআইপি