গণপরিবহনের জন্য ‘পৃথক লেন’ এখন সময়ের দাবি
রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা হাসিবুর রহমান। মতিঝিলে অবস্থিত একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। প্রতিদিন মিরপুর থেকে মতিঝিলে গিয়ে অফিস করতে হয় তাকে। যানজটের প্রসঙ্গ তুলে হাসিবুর রহমান বলেন, পরিবার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মিরপুর থাকি। অফিস করতে মতিঝিল যেতে হয়। কিন্তু যানজটের কারণে প্রতিদিন গড়ে প্রায় চার ঘণ্টা বাসেই সময় কাটে।
‘দিন দিন রাজধানীর যানজট ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে’ উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘অন্য জেলা শহর হলে এ দূরত্বে বাসে যাওয়া-আসায় সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা সময় লাগতো। সেখানে এ শহরে যাতায়াতে প্রতিদিন চার ঘণ্টা সময় নষ্ট হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে সমস্যা আরো প্রকট হবে। যেহেতু পাবলিক বাসে যাতায়াতকারী মানুষের সংখ্যা বেশি তাই এ জন্য পৃথক লেনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’
যানজটের কারণে শুধু হাসিবুর রহমানের নয়, প্রতিদিন এ সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন রাজধানীতে চলাচলকারী প্রতিটি মানুষ।
বিশ্বব্যাংকের এক জরিপ প্রতিবেদন তুলে ধরে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) বলছে, ঢাকা শহরের বর্তমান যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এ কারণে বছরে যে আর্থিক ক্ষতি হয়, অঙ্কের হিসাবে তা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। গত কয়েক বছরের বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে আর্থিক ক্ষতির এ আনুমানিক পরিমাণ পাওয়া যায়। রাজধানীতে এখন ঘণ্টায় গড়ে প্রায় সাত কিলোমিটার গতিতে চলছে যানবাহন।
এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে নগরপরিকল্পনাবিদ, পরিবেশবাদী সংগঠন, বিশেষজ্ঞরা পৃথক লেনে গণপরিবহন চলাচলের বিষয়ে সুপারিশ করেছেন। তারা বলছেন, যানজট থেকে রক্ষা পেতে এবং পাবলিক পরিবহনের প্রতি সবাইকে আগ্রহী করতে পৃথক লেনে বাস চলাচলের পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
সম্প্রতি ভিআইপিদের জন্য পৃথক লেনে যাতায়াতের একটি প্রস্তাবনা তোলা হয়। এ প্রস্তাবনার পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
রাজধানীর যানজট নিরসনে প্রধান সড়কগুলোতে ভিআইপি লেনের প্রস্তাব নাকচ করে গণপরিবহন চলাচলের জন্য আলাদা লেনের সুপারিশ করেছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিবের কাছে পাঠানো ডিটিসিএ’র চিঠিতে এমন সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত সচিব প্রকৌশলী জাকির হোসেন মজুমদার। তিনি বলেন, পৃথক লেনে পাবলিক বাসবিষয়ক একটি পাইলট প্রকল্প নিয়েও আমাদের মধ্যে আলোচনা চলছে।
একটি জরিপ প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) বলছে, নব্বয়ের দশকে ঢাকা পাবলিক পরিবহনের সংখ্যা ছিল ১১ হাজার, ২০০৮ সালে এ সংখ্যা ছিল আট হাজার। নানা কারণে ২০১৫ সালে এ সংখ্যা এসে দাঁড়ায় মাত্র তিন হাজারে।
২০১০ সালে রাজধানীতের ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ছিল তিন লাখ ১৮ হাজার ৪৯৫। ২০১৬ সালে এসে তা দাঁড়ায় চার লাখ ৩৬ হাজার ৫৫-তে। দিন দিন ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে অন্যদিকে পাবলিক বাসের সংখ্যা হ্রাসের হার খুবই উদ্বেগজনক।
সড়কে চলাচল ও গণপরিবহনের অবস্থা
রাজধানীতে প্রতিদিন অন্তত ছয় লাখ মানুষ নানা কারণে আসছেন। ২০১৩ সালে প্রকাশিত ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ঢাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। দিনে অন্তত ২১ লাখ পরিবহন ট্রিপের প্রয়োজন। কিন্তু যানজটের কারণে ২১ লাখের তিনভাগের একভাগ ট্রিপও হচ্ছে না।
পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীতে প্রতি তিন হাজার যাত্রীর যাতায়াতের জন্য বাস ও মিনিবাস আছে মাত্র একটি। এছাড়া সিএনজি অটোরিকশাগুলোর এক-তৃতীয়াংশ অচল। গণপরিবহন সঙ্কটের বিপরীতে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। ঢাকায় প্রতিদিন নামছে ৩৭টি ব্যক্তিগত গাড়ি।
তিন রুটে পরিচালিত জাইকার এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকায় গণপরিবহনে প্রতিদিন প্রায় ১৯ লাখ যাত্রী চলাচল করেন। এছাড়া ঢাকার তিন করিডোরে গণপরিবহনে যাতায়াতের জন্য গড়ে ৭৭ মিনিট করে সময় লাগে। যার ২৪ শতাংশ পরিবহনের জন্য অপেক্ষা, ৪৪ শতাংশ পরিবহনে ওঠা-নামা ও পরিবহন পরিবর্তনে এবং ৩২ শতাংশ সময় পরিবহনে চলন্ত অবস্থায় ব্যয় হয়।
পবা'র মতে, ঢাকা মহানগরীতে যানজট হ্রাসে গণপরিবহনের দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার মাধ্যমে অপেক্ষার সময়, পরিবহনে ওঠা-নামা ও পরিবহন পরিবর্তনের সুবিধা সৃষ্টির পাশাপাশি গণপরিবহনের জন্য পৃথক লেন করা গেলে যাতায়াতের সময় অনেক কমে আসবে। যা মানুষকে গণপরিবহন ব্যবহারে উৎসাহিতের পাশাপাশি ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনার অভাবে গণপরিবহনের সর্বোচ্চ সুবিধা কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না।
৬ শতাংশ মানুষের দখলে ৭৬ ভাগ সড়ক
গেল বছরের ২২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল (ডিআই) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনের বলা হয়, ব্যক্তিগত গাড়িতে চলাচলকারী ছয় শতাংশ মানুষ ঢাকার ৭৬ ভাগ সড়ক দখল করে আছেন। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোট সড়কের ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ ব্যক্তিগত গাড়ির দখলে থাকে। গণপরিবহনের দখলে থাকে ছয় থেকে আট শতাংশ। সড়কের বাকি অংশ বিভিন্নভাবে অবৈধ দখল ও অবৈধ পার্কিংয়ের দখলে থাকে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাধারণ সম্পাদাক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, আমাদের দেশে এখনো গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়নি। গণপরিবহনের সুবিধা না থাকায় অনেক পরিবারে ৩-৪টি করে ব্যক্তিগত গাড়ি আছে। ফলে যানজট কমানো যাচ্ছে না। যেভাবে হোক ব্যক্তিগত গাড়ি নিরুৎসাহিত করতে হবে। যানজট কমাতে বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি এক লেনে গণপরিবহন চালু করা জরুরি।
ঢাকার রাস্তায় গণপরিবহনের জন্য জায়গা কম
পবা বলছে, রাজধানীতে সিটি কর্পোরেশনের মোট আয়তনের নয় শতাংশ সড়ক, মাত্র ছয় শতাংশ ফুটপাত রয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের এক হাজার ২৮৬ কিলোমিটার সড়কের ৬১ কিলোমিটার প্রাইমারি, ১০৮ কিলোমিটার সেকেন্ডারি, ২২১ কিলোমিটার কনেক্টর, ৫৭৩ কিলোমিটার লোকাল এবং বাকিটা সংকীর্ণ। পুরো শহরের মধ্যে ১০৭ কিলোমিটার সড়কের প্রশস্ততা ২৪ মিটারের বেশি।
প্রকৃতপক্ষে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মোট সড়কের ৮২১ দশমিক ৬১ কিলোমিটারের (৬৪ শতাংশ) প্রশস্ততা চার দশমিক ৭৫ মিটার বা তার চেয়ে কিছুটা বেশি। ফুটপাতের প্রশস্ততা অনুযায়ী এটি মাত্র ৬১৮ দশমিক ১৪ কিলোমিটার (৪৮ শতাংশ)। বাকি ৪৬৪ কিলোমিটার (৩৬ শতাংশ) সড়কে জরুরি গাড়ি যেমন অ্যাম্বুলেন্স বা অগ্নিনির্বাপক গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না।
এ অবস্থায় ৯৪ শতাংশ মানুষের যাতায়াতের জন্য (গণপরিবহন) পৃথক লেনের দাবি খুবই যৌক্তিক, ন্যায্য ও সময়ের দাবি।
বিশ্বের উন্নত শহরে গণপরিবহন
নিউইয়র্ক, লন্ডন, সিউলসহ বিশ্বের ১৪টি বড় শহরে পৃথক লেনে গণপরিবহন চালানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব শহরে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ এবং গণপরিবহন ব্যবহারে জনগণকে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে ঢাকা শহরে পৃথক একটি লেনে পাবলিক পরিবহন চলাচলের ব্যবস্থা করা গেলে অনেক কম সময়ে অনেক বেশি যাত্রী নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে।
রাজধানীবাসীর যাতায়াত সমস্যা নিরসনে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সদ্যপ্রয়াত মেয়র আনিসুল হক চার হাজার পাবলিক বাস নামানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিআরটিসি প্রায় ৪০০ বাস কেনার প্রক্রিয়া শুরু করে। কিন্তু বিদ্যমান সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ির জটের কারণে অতিরিক্ত গণপরিবহনও জনগণের কাঙ্ক্ষিত সুবিধা দিতে পারবে না। তাই এখনই গণপরিবহন চলাচলের জন্য পৃথক লেনের পরিকল্পনা প্রয়োজন।
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমে গেলে রাজধানীতে যানজট কমে যাবে। যে কারণে গণপরিবহনের সুবিধা সৃষ্টি করে যাত্রীদের এখানে আগ্রহী করে তুলতে হবে। তাহলে অনেকেই চলাচলের জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি বের না করে গণপরিবহনে যাতায়াত করবেন। এ কারণে ভিআইপি লেনের চেয়ে গণপরিবহনের জন্য আলাদা লেন করলে তা কার্যকর পদক্ষেপ হবে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজ্জামেল হক বলেন, গণপরিবহনের জন্য পৃথক লেন আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি। এটি চালু করা গেলে যানজট অনেকাংশে কমে যাবে। সেই সঙ্গে সার্ভিস ভালো হলে ব্যক্তিগত গাড়ির মালিকরাও গণপরিবহনে চলাচলে আগ্রহ দেখাবেন। ফলে স্বাভাবিকভাবে যানজট কমে আসবে।
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের বলেন, ঢাকা শহরের অনেক রাস্তায় গণপরিবহন চলতে দেয়া হয় না। যানজট নিরসনে আমাদের দাবি, পৃথক লেনে গণপরিবহন চালুর পাশাপাশি সব রাস্তায় গণপরিবহন চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে।
যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবহন বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগে অধ্যাপক ড. সামছুল হক জাগো নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সড়কে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। ঢাকার রাস্তায় একটিমাত্র কোম্পানির মাধ্যমে পরিবহন সেবা দিতে পারলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।
‘সড়কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গণপরিবহনের লেনটি আলাদা করে দেয়া হোক, দেখা যাবে দিনে একেকটি পরিবহন মিরপুর থেকে মতিঝিলে ১৫ বার ট্রিপ দিতে পারবে। সরকার সে কৌশল না নিয়ে শত শত বাস নামিয়ে আরো যানজট সৃষ্টি করছে’- যোগ করেন তিনি।
এএস/এমএআর/জেএইচ/আরআইপি