বাংলার বিকাশে প্রতিবন্ধকতা কোথায়?

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:৫০ পিএম, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ভাষা ইতিহাসের ঐতিহ্য নিয়ে বাঙালি যে গর্ব করার অধিকার রাখে, তা অন্য জাতি রাখে না। লড়াই করে ভাষার অধিকার রক্ষা! ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রক্ত দিয়ে এ জাতি মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় করে নেয়। অথচ বাংলা এখনও গর্ব করার মতো ভাষা হয়ে উঠতে পারছে না। কিন্তু এটা তো স্বাধীন বাংলাদেশ, এখানে বাংলার বিকাশ রুদ্ধ কেন? স্বাধীনতার এত বছর পর ভাষা-সংস্কৃতিতে কতটুকু অর্জন করল বাংলাদেশ? বাংলা ভাষাকে বিশ্বমানে উন্নীত করতে করণীয় কী, শিল্প-সাহিত্যের উন্নয়নে রাষ্ট্রেরই বা দায় কতটুকু- এসব বিষয়ে কথা বলা হয় ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা চারজন ভাষাবিদ ও গবেষকের সঙ্গে।

লেখক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, বিশ্ব পুঁজিব্যবস্থার কারণেই বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হতে পারেনি। বাংলাদেশ যে স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছে, তা পুঁজিবাদের পেছনে ছুটতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। কথিত যে কাঠামোর ওপর রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে, তা খুবই ভঙ্গুর। এ রাষ্ট্রকাঠামো কোনোভাবেই গণমানুষের না। গণমানুষের কাঠামো হতে পারেনি বলেই, বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি বিশ্বমানের হতে পারেনি। রাষ্ট্রের দৈন্যতায় বাংলা বৈশ্বিক রূপ পায়নি। আমাদের এখানে আসলে সত্যিকার অর্থে সামাজিক বিপ্লব হয়নি। সামাজিক বিপ্লবের সুফল গণমানুষের কাছে পৌঁছায়নি বলেই আমরা জাতি হিসেবে সমৃদ্ধ হতে পারিনি। আর এ কারণে আমরা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ হতে পারিনি।

তিনি বলেন, ভাষার জন্য রক্ত দিল। আর সেই রক্তের ওপর ভর করে একটি রাষ্ট্র দাঁড়াল। অথচ আজও বাংলা ভাষার সর্বত্র প্রয়োগ হলো না। রাষ্ট্র তিন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা জারি করে বৈষম্য বজায় রেখেছে। যারা উচ্চবিত্ত তারা ইংরেজি শেখেন। আর মধ্যবিত্তের যারা বাংলা শেখেন, তাদের মধ্যে গভীর কোনো চর্চা নেই। এ কারণেই বাংলা ভাষায় ভালো কোনো বই লেখা হচ্ছে না, সাহিত্য চর্চা হচ্ছে না।

সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করাতে না পারা আমাদের জাতি হিসেবে দৈন্যতা বলে মতো দেন আরেক গবেষক অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। এ শিক্ষাবিদ বলেন, বাংলা ব্যবহারে সরকারগুলোর অবহেলা পরম্পরায়। সরকারগুলো সবসময় এ ব্যাপারে উদাসীন বলে মনে করি। সরকারগুলোর অবহেলার কারণেই বাংলা ভাষার আজও সর্বত্র ব্যবহার হচ্ছে না। এ নিয়ে নীতিমালা করার কথা থাকলেও, তা আজও আলোর মুখ দেখেনি।

তিনি বলেন, রক্ত দিয়ে আমরা আমাদের বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষা করেছি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পাওয়ায় বাংলা ভাষা এবং ভাষা শহীদদের মর্যাদা বেড়েছে। অথচ আমরা আমাদের সাহিত্যকর্ম বিশ্বমানের করে তুলতে পারিনি। পারিনি এ কারণে যে, ভাষা নিয়ে আমাদের গভীর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। রাষ্ট্র এ ব্যাপারে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। শিক্ষার দুরবস্থা সর্বত্র। যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়েছে, তা দিয়ে শিল্প-সাহিত্যের চর্চা ঠিক বিকশিত হবার নয়। সংকট ঠিক এখানেই। শিক্ষার সঙ্গে ব্যবসাকেই মুখ্য করে তোলা হচ্ছে।

তবে হতাশা থাকলেও মানুষের ভাষা-সাংস্কৃতিক চেতনাবোধ জাগ্রত হচ্ছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন লেখক, গবেষক ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। তিনি বলেন, সাহিত্য-সংস্কৃতির এ আয়োজনে নানা বিষয়ই এখন দৃশ্যমান। আগে মানুষ শুধু ছুটির দিনগুলোতে ভিড় করেছে মেলায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রতিদিনই ভিড় হচ্ছে। মনে হচ্ছে প্রতিদিনই ছুটির দিন। এটি আমাদের বিশেষ নজর কেড়েছে। আশার কথাও বটে।

‘আমাদের তরুণ প্রজন্ম দিনকে দিন বই, সাহিত্যের প্রতি ঝুঁকছে’ এমনটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, নতুন প্রজন্ম অনেকেই সাহিত্যের সঙ্গে বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। সাহিত্যমান নিয়ে বাংলা একাডেমি নানাভাবেই কাজ করে যাচ্ছে। একটি কমিটি রয়েছে এ নিয়ে। এ কমিটি মানসম্পন্ন বলে বাছাই করেছে। কমিটির সদস্যরা বই পড়েছেন। বই পড়েই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, এ বই ভালো বা মানের বলা যায়। হতাশা থাকলেও আমি মনে করি, মানুষের ভাষা-সাংস্কৃতিক চেতনাবোধ জাগ্রত হচ্ছে।

শামসুজ্জামান খান বলেন, শুধু গল্প-উপন্যাস নয়, প্রচুর পাঠক জীবনীগ্রন্থ কিনছেন। প্রকাশও হয়েছে বেশ। জীবনী বা আত্মজীবনী লেখায় আগ্রহ বাড়ছে লেখকদের, আগ্রহ বাড়ছে পাঠকদেরও।

তিনি মনে করেন, পাঠক সহজপাঠে অভ্যস্ত বটে, কিন্তু তরুণ প্রজন্ম সিরিয়াস পাঠে মন দিচ্ছে, তা এবারে জোর দিয়েই বলা যায়। যদি গল্প-উপন্যাসেই পাঠক আটকে থাকতেন, তাহলে জীবনী, রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি নিয়ে এত বই প্রকাশ হতো না।

অপরদিকে লেখক, সাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, শিক্ষা নিয়ে যেখানে যাওয়ার কথা ছিল, সেখানে যেতে পারিনি। আর শিক্ষার দুর্বলতার কারণেই বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি ঘটেনি।

তিনি বলেন, সংবিধানের মৌলিক আদর্শগুলো বাধাগ্রস্ত হতে থাকল পর্যায়ক্রমে এবং একমুখী শিক্ষার পরিবর্তে চারমুখী শিক্ষার প্রবর্তন শুরু হলো। আশির দশকে এ ধারা তীব্র হলো। ওই সময়ে প্রতিষ্ঠা পেল ধনীর সন্তানরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়বে। মধ্যম আয়ের পরিবারের সন্তানরা পড়বে সাধারণ শিক্ষায়। আর হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানরা পড়বে মাদরাসায়। শিক্ষায় এ শ্রেণিগত বিভাজন সর্বনাশ ডেকে আনলো। অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা না থাকার কারণেই সমাজে বৈষম্য বাড়ছে এবং শিক্ষার মান কমছে। এমন একটি বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থাই আমাদের ভাষা-সংস্কৃতির বিকাশের অন্তরায়।

এএসএস/বিএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।