বনানীতে ফের ধর্ষণ : গেস্ট হাউসটি অবৈধ

জসীম উদ্দীন
জসীম উদ্দীন জসীম উদ্দীন , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৫৭ পিএম, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

জন্মদিনের দাওয়াত দিয়ে গত বছর রাজধানীর বনানীতে ‘দ্য রেইন ট্রি’ হোটেলে নিয়ে দুই তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। এবার এই বনানীতেই জন্মদিনের দাওয়াত দিয়ে একটি গেস্ট হাউসে নিয়ে এক তরুণীকে ধর্ষণ করেছে কথিত প্রেমিক। ওই প্রেমিকের নাম রাজিব আহম্মেদ (২৮)।

বনানীর ডি-ব্লকের ১৫ নং সড়কের ৬৫ নং বকুল ভিলা নামের বভনে গেস্ট হাউসটিতে জোরপূর্বক আটকে রেখে ওই তরুণীকে রাতভর ধর্ষণ করে রাজিব। আর এতে সহযোগিতায় করে রাজিবের বন্ধু রুবেল হোসেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নির্দেশনা উপেক্ষা করে বকুল ভিলায় কোনো সাইনবোর্ড ছাড়াই চলছে ওই গেস্ট হাউস। নিচ তলা ও দ্বিতীয় তলায় থাকেন বাড়ির মালিক। ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় চলছে গেস্ট হাউস।

মানবাধিকার সংগঠন ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু বনানীর ওই ভবন নয়, বনানী ও গুলশানে এভাবেই আবাসিক ভবনে গড়ে উঠেছে অবৈধ হোটেল, গেস্ট হাউস। পুলিশের নাকের ডগায় এভাবে হোটেল, রেস্ট হাউস, গেস্ট হাউস গড়ে উঠলেও কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না পুলিশ কিংবা রাজউক।

jagonews24

তবে রাজউক বলছে, প্রকাশ্যে আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে রাজউক। গোপনে হলে তা দেখার দায়িত্ব পুলিশের।

ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর হোটেলগুলোতে অতিথির নাম-ঠিকানা লেখা, ছবি তোলা, এনআইডি, পাসপোর্ট বা ড্রাইভিং লাইসেন্সের কপি, ফোন নম্বর রাখা ও ফোন দিয়ে নম্বর যাচাই করাসহ আটটি নির্দেশনা রয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী হোটেলগুলোয় কাজ হচ্ছে কি না তাও নজরদারি করে পুলিশ। পাশাপাশি ভাড়াটিয়া নিবন্ধন ফর্মে দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাড়িগুলোতে ভাড়াটিয়ারা থাকছেন কিনা সেটিও দেখে পুলিশ।

গত শনিবার রাতে ধর্ষণের ঘটনায় আলামত পরীক্ষার জন্য ওই তরুণীকে সোমবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়েছে।

বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বি এম ফরমান আলী জানান, নারী ও শিশু নির্যাতনের ৯ (৩) ধারায় দায়ের হওয়া মামলাটি তদন্ত করছেন থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) বোরহান উদ্দিন রানা। মামলা নং ৩।

মামলা দায়ের ও আসামি গ্রেফতারের পর সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বনানী ডি-ব্লকের ১৫ নং সড়কের ৬৫ নং ভবনটিতে নেই কোনো সাইটবোর্ড। আবাসিক ভবন হলেও সেখানেই গেস্ট হাউস গড়ে তোলা হয়েছে। বাইরে থেকে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে ভেতরে রয়েছে গেস্ট হাউসের কারবার।

মামলার এজাহারে দ্য স্টার গেস্ট হাউসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করা হলেও মূলত বাড়িটির তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় দ্যা স্কাই প্যালেস গেস্ট হাউস নাম রয়েছে। তবে নথিপত্রে এর নামও ভিন্ন। নাম ‘হোটেল সিট্রাস লি.’। ওই নামেই বাসার মালিক নওশের আলীর সঙ্গে গেস্ট হাউস কর্তৃপক্ষের চুক্তি। ওই ভবনের চতুর্থ তলার ৪০৩ নং কক্ষেই ধর্ষণের ঘটনা ঘটে বলে নিশ্চিত করেছে বনানী থানা পুলিশ।

সরেজমিনে দেখা যায়, পুরাতন কাঠামোয় গড়া চতুর্থ তলাবিশিষ্ট ভবনটির প্রধান ফটকে গেট দুটি। একটা ওই গেস্ট হাউসটিতে ওঠার। আরেকটি গেট ভবনের মালিকের। ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় গেস্ট হাউস। তবে গেস্ট হাউসের গেটে তালা মারা।

ভবনের সামনে অবস্থান করা ইলেকট্রিক মিস্ত্রী মনির জাগো নিউজকে জানান, এই ভবনে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ আইছিল। এরপর থেকে সব পালাইছে। গতকাল দুপুর থেকে গেস্ট হাউসের গেটে তালা। কাউকে আর দেহি নাই।’

যোগাযোগ করা হলে ভবনের মালিক নওশের আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘তৃতীয় ও চতুর্থ তলা গেস্ট হাউস হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়েছে। রেডিয়াল প্যালেস নামে একটি হোটেলের ম্যানেজিং পার্টনার মো. শাহ আলমের সঙ্গে মাসে এক লাখ টাকায় ভাড়া দেয়া হয়েছে। তারা কে কীভাবে এটা চালায় তা আমি জানি না। কখন কোন গেস্ট আসেন সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই। এখানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বিষয়টি প্রথম জানলাম। পুলিশ এসেছিল। কিন্তু কী কারণে এসেছিল কিংবা ধর্ষণের ব্যাপারে আমাকে কিছু তারা জানায়নি।

তিনি বলেন, এক বছর আগে ভাড়া দেয়া হয়। এমন ঘটনা এখানে ঘটবে বিশ্বাস করতে পারছি না। এ ব্যাপারে রেডিয়াল প্যালেস হোটেলের ম্যানেজিং পার্টনার মো. শাহ আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করে চুক্তি বাতিল করে গেস্ট হাউস ভাড়া রাখবেন না বলে জানান তিনি।

এ ব্যাপারে রেডিয়াল প্যালেস নামে হোটেলটির ম্যানেজিং পার্টনার মো. শাহ আলমের সঙ্গে মোবাইল ফোনে, মেইলে ও ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

jagonews24

আবাসিক এলাকায় অবৈধ প্রতিষ্ঠান

বনানীর শুধু বকুল ভিলা নয় রাজউক ও ডিএমপির নির্দেশনা উপেক্ষা করে পুরো গুলশান ও বনানীর আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কোনো কোনো বাড়িতে আছে জুতা, হার্ডওয়্যার, কসমেটিক্স ও ব্যাটারিসহ বিভিন্ন পণ্যের কারখানা।

মালিকরা মোটা অঙ্কের ভাড়া পাওয়ার লোভে আবাসিক ভবনে খুলতে দিয়েছেন খাবার দোকান, মুদি দোকান, ফ্লেক্সিলোডের দোকান, ফার্মেসি, টেইলার্স, বিউটি পারলার, তৈরি পোশাকের দোকান, সেলুন, জিমনেশিয়াম, লাইব্রেরি, ইলেকট্রনিক্স পণ্য মেরামতের দোকান এবং লন্ড্রি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ মো. নজরুল ইসলাম বলেন, শহরের চরিত্র যদি ঠিক না থাকে তবে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। আবাসিকের স্থলে বাণিজ্যিক কাঠামো তৈরি করা হলে মানুষ নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারবে না। অনৈতিক কর্মকাণ্ড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

হিউম্যান রাইটস মনিটরিং অর্গানাইজেশন নামে একটি মানবাধিকার সংগঠনের ডিরেক্টর (ইনভেস্টিগেশন) মোহাম্মদ জিয়াউল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, আবাসিক এলাকায় আবাসিক ভবনে হোটেল চালানো আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। সেটাই দিনের পর দিন ঘটছে বনানী, গুলশান এলাকায়।

তিনি বলেন, শতাধিক আবাসিক ভবনে এমন বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড চলছে। এ ব্যাপারে রাজউক ও পুলিশকে অভিযোগ করেও কোনো কাজে আসেনি।

এসব আবাসিক ভবনে গোপনে হোটেল মানে অনৈতিকতা চলে। এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ বনানীর ডি-ব্লকের ১৫ নং সড়কের ৬৫ নং ভবনটি। কোনো সাইটবোর্ড ছাড়াই আবাসিক ভবনটিতে দ্য স্টার গেস্ট হাউস পরিচালিত হচ্ছে। যেখানে গত শনিবার ধর্ষণের ঘটনার ঘটলো। সময় এসেছে এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার।

রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (গুলশান ও বনানী এলাকা) ও পরিচালক খন্দকার অলিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আবাসিক এলাকায় বানিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা বেআইনি। দৃশ্যমান স্থানগুলোতে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। তবে গোপনে কোথাও হলে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। গোপনে কোনো আবাসিক ভবণ বাজিণ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না তা দেখার দায়িত্ব পুলিশের বলে দাবি করেন তিনি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোস্তাক আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, হোটেলগুলো সঠিক নিয়মে পরিচালনা হচ্ছে কি না তা দেখা হচ্ছে। ডিএমপির নির্দেশনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হয়। ব্যত্যয় ঘটার অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

জেইউ/জেডএ/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।