আইন মন্ত্রণালয় এখন ঠুঁটো জগন্নাথ

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:১১ এএম, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭

অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম, আওয়ামী লীগের আইন-বিষয়ক সম্পাদক। আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্য তিনি। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। পেশাগত জীবনে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, জেলহত্যা মামলা ও এক-এগারোর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন।

নিম্ন আদালতের শৃঙ্খলাবিধির প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। দীর্ঘ আলোচনায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, ষোড়শ সংশোধনীসহ সম-সাময়িক বিভিন্ন বিষয়ও গুরুত্ব পায়। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সায়েম সাবু। তিন পর্বের ধারাবাহিকের আজ থাকছে প্রথম পর্ব-

জাগো নিউজ : নিম্ন আদালতের শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে গেজেট করলো সরকার। কেমন দেখছেন এ গেজেট?

রেজাউল করিম : নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণভাবে আলাদার নির্দেশ এসেছে মাজদার হোসেন মামলার রায়ে। নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতিসহ সব বিষয় থাকবে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে। এ রায়ের মূল স্পিরিট এখানেই।

বিভিন্ন সরকার কালক্ষেপণ করে বিষয়টি আমলে নেয়নি। অবশেষে ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

ওই সময় থেকে নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে সুপ্রিম কোর্ট। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোনোভাবেই নির্বাহী বিভাগের ন্যূনতম কোনো হস্তক্ষেপ নেই।

বিচার বিভাগের আর্থিক বিষয়টিও এখন সুপ্রিম কোর্টের অধীন। নিম্ন আদালতের অন্য নিয়োগও এখন সুপ্রিম কোর্ট দিয়ে থাকেন।

জাগো নিউজ : এসবে আইন মন্ত্রণালয়ের কি কোনো সম্পৃক্ততা নেই?

রেজাউল করিম : না। বিচারকদের নিয়োগে আইন মন্ত্রণালয় কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করতে পারে না।

জাগো নিউজ : নিয়োগের মতো জটিল বিষয় সুপ্রিম কোর্টের অধীন। তাহলে বদলি, পদোন্নতির মতো বিষয়গুলো কেন আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে রাখতে হচ্ছে?

রেজাউল করিম : এটি ভুল ধারণা। নিম্ন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি সবই সুপ্রিম কোর্টের অধীন। রাষ্ট্রপতির পরামর্শক্রমে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন সুপ্রিম কোর্ট।

বরং গেজেটে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি ও সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দিলে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তই প্রাধান্য পাবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির চেয়ে বড় স্থান দেয়া হয়েছে সুপ্রিম কোর্টকে। এটি অতীতে কখনো ছিল না।

Rejaul-Karim-1

জাগো নিউজ : আইন মন্ত্রণালয়ের কাজ কী তাহলে?

রেজাউল করিম : আইন মন্ত্রণালয় এখানে পোস্ট অফিসের কাজ করবে। সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব কোনো সচিবালয় না থাকায় আইন মন্ত্রণালয়কে এখানে থাকতে হচ্ছে। ফাইল তৈরি করা, রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর কাজগুলো তো কাউকে না কাউকে করতে হয়।

জাগো নিউজ : সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সব পারলে পোস্ট অফিসের কাজ কেন করতে পারে না?

রেজাউল করিম : এখানে কয়েকটি দফতরে কাজ হয়। যেমন- ভেটিং দফতর, লিগ্যাল অপিনিয়ন, ফাইল তৈরি ইত্যাদি। এসব কাগজ তৈরিতে বিজি প্রেসে যেতে হয়। ড্রাফট উইং নেই সুপ্রিম কোর্টে। এসবের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের ড্রাফট উইং ব্যবহার করতে হচ্ছে।

একটি গেজেট তৈরির জন্য যে স্টাফ দরকার তা কিন্তু জুডিশিয়ালে নেই।

মাজদার হোসেন মামলার রায়ে বলা হয়েছে, ‘বিচার বিভাগীয় কর্মে শুধু বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা থাকবেন’। এখানে সবাই তো জুডিশিয়াল সার্ভিস থেকে আসা…

জাগো নিউজ : ড্রাফট কি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল করার ক্ষমতা রাখে না?

রেজাউল করিম : শৃঙ্খলাবিধি বিচার বিভাগের কাছে আসার পর আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে আর কিছুই নেই বলতে পারেন। তবে ড্রাফট তৈরি করতে হলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশনকে আলাদা উইং দিতে হবে। আলাদা প্রেসও দিতে হবে।

জাগো নিউজ : উইং তৈরি হচ্ছে না বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে, অন্তত এটি ধারণা করা যেতে পারে…

রেজাউল করিম : সুপ্রিম জুডিশিয়ালে ‘জিএ’ নামে আরেকটি কমিটি আছে। ওই কমিটি আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়ে থাকে। যদি মন্ত্রণালয় সেটি ফলো না করে, তাহলে জিএ কমিটি নিজেই সিদ্ধান্ত দিতে পারে।

জাগো নিউজ : আগে কি ছিল?

রেজাউল করিম : আগে ফাইল তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয় জিএ কমিটির কাছে পাঠাতো। এখন ফাইল তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয়কে তারা নির্দেশ দেবে রাষ্ট্রপতির কাছে পরামর্শ নিতে।

সুতরাং আইন মন্ত্রণালয় এখন ঠুঁটো জগন্নাথ। অন্তত জুডিশিয়ারি অংশে।

জাগো নিউজ : এরপরও প্রশ্ন থেকে যায় কিনা?

রেজাউল করিম : আমি নিজেও মনে করি সুপ্রিম কোর্টের জন্য সতন্ত্র একটি সচিবালয় থাকা দরকার। এজন্য কাঠামো, ভবন, জনবল দরকার। কিন্তু বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি আমলে নিয়ে বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।

অনেক মন্ত্রণালয় এখনো বাইরে। সব-তো এক জায়গায় আনা সম্ভব হয়নি।

Rejaul-Karim-3

জাগো নিউজ : জটিলতা দেখছেন কেন? মাজদার হোসেন মামলার রায়ের ১৭ বছর পর বাংলাদেশ তো অনেক এগিয়ে গেছে...

রেজাউল করিম : করা হয়নি, এটিই বাস্তবতা এবং দুঃখজনকও বটে।

জাগো নিউজ : এ বাস্তবতা বিচার বিভাগের জন্য রাজনৈতিক আঘাত কিনা?

রেজাউল করিম : রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতেই পারে। রাজনীতি হচ্ছে মানুষের জন্য। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে বিচার বিভাগের পূর্ণাঙ্গ কাঠামো দাঁড় করানো সময়ের দাবি বলে মনে করি। আকাঙ্ক্ষা আমাদেরও তীব্র। কিন্তু বাস্তবায়নের প্রশ্নে সময় লাগে।

জাগো নিউজ : আর কোনো জটিলতা?

রেজাউল করিম : সুপ্রিম কোর্ট কখনো কখনো নিজেও জটিলতা সৃষ্টি করে। কখনো কখনো এমন সব প্রস্তাব রাখে, যা অবাস্তব মনে হয়।

জাগো নিউজ : কেন এমন মনে হয়?

রেজাউল করিম : সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেছিলেন, বার এসোসিয়েশনকে সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে জায়গা দিতে পারবেন না। আমরা বললাম, আইনজীবীদের ছাড়া তো আর আদালত চলতে পারে না।

তিনি বললেন, সুপ্রিম কোর্টের অনেক জায়গা দরকার। সুপ্রিম কোর্টের আলাদা ব্যবস্থা, গাড়ির জন্য আলাদা ফুয়েল পাম্প, কোর্টের পরিচ্ছন্নকর্মীদের জন্য কোয়ার্টার, ড্রাইভারদের জন্য কোয়ার্টার, প্রেস, অডিটোরিয়াম, জাজদের জন্য পার্লার, জাজদের জন্য আলাদা রেস্তোরাঁও লাগবে।

জাগো নিউজ : বিচার বিভাগের উন্নয়নের জন্য প্রস্তাবগুলো প্রাসঙ্গিকও বটে। অবাস্তব বলছেন কেন?

রেজাউল করিম : তিনি এতগুলো বিষয় প্রস্তাব রাখায় মূল বিষয়গুলো চাপা পড়ে গেলো। এ কারণে তার দেয়া প্রস্তাবের অনেকগুলোই মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।

বাস্তবতা আমলে নিয়ে তো কথা বলতে হবে। চাইলেই আইন মন্ত্রণালয় কোনো বিচারককে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিতে পারেন না। রাষ্ট্রপতি ছাড়া এ ক্ষমতা আর কারোর ওপর বর্তায় না। এ বাস্তবতা তো অস্বীকার করতে পারবেন না। ঠিক অন্য দুর্বলতাগুলোও বাস্তবতার নিরিখে মূল্যায়ন করতে হবে।

জাগো নিউজ : রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, আইন- এগুলো তো কিতাবি ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের অন্য হাত সক্রিয় থাকলে আইনের হাত খর্ব হতে দেখা যায়…

রেজাউল করিম : কিতাবি ব্যবস্থা হলেও আপনি রাষ্ট্রের অধিপতিকে তো অস্বীকার করতে পারেন না। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সুপ্রিম কোর্টের বিধানের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকেও অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন।

জাগো নিউজ : কীভাবে?

রেজাউল করিম : সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ উচ্চ আদালত যতক্ষণ পর্যন্ত বাতিল না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত একটি রায়ে আপনি রাষ্ট্রপতির নাম বাতিল করতে পারেন না। ষোড়শ সংশোধনীর মামলার পর্যবেক্ষণে তিনি এককভাবে সেটিই করেছেন।

জাগো নিউজ : সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অন্তরায় বলে মনে করা হয়…

রেজাউল করিম : ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে আদালতে রিট হয়েছে। বিষয়টি বিচারাধীন। যে মামলায় ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হয়েছে, সেই মামলায় কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদকে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে অন্য বিচারপতিরা যে সার্টিফিকেট দিয়েছেন সেখানেও ১১৬ অনুচ্ছেদের কথা বলা হয়নি। রায়ের অংশও ছিল না। এস কে সিনহা নিজ থেকেই রায়ে রাষ্ট্রপতির নাম বাতিল করতে চেয়েছিলেন।

এএসএস/এমএআর/পিআর

গেজেটে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি ও সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দিলে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তই প্রাধান্য পাবে

আইন মন্ত্রণালয় এখানে পোস্ট অফিসের কাজ করবে। সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব কোনো সচিবালয় না থাকায় আইন মন্ত্রণালয়কে এখানে থাকতে হচ্ছে। ফাইল তৈরি করা, রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর কাজগুলো তো কাউকে না কাউকে করতে হয়

এস কে সিনহা নিজ থেকেই রায়ে রাষ্ট্রপতির নাম বাতিল করতে চেয়েছিলেন

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।