বিমানের ফ্লাইট সার্ভিসে অনিয়মই নিয়ম!

রফিক মজুমদার
রফিক মজুমদার রফিক মজুমদার , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১১:৪০ এএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭
ফাইল ছবি

নিয়ম-কানুন ও দাফতরিক আদেশ কিছুই মানছে না বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের গ্রাহকসেবা বিভাগ। ফ্লাইট সার্ভিসে জ্যেষ্ঠতা প্রদানের মতো স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে বিমান কর্তৃপক্ষের সুস্পষ্ট মতামত ও সিদ্ধান্ত অমান্য করে নিজেদের ইচ্ছামতো কেবিন ক্রুদের দায়িত্ব বণ্টন করা হচ্ছে ফ্লাইটে। বিমানেরই তৈরি আইন ভঙ্গ করে সুবিধাভোগীরা ‘সি’ নম্বরধারী ক্যাজুয়াল ক্রুদের সিনিয়র বানিয়ে ফ্লাইটে পাঠাচ্ছেন।

নিয়োগবিধি অমান্য করে এবং সরকারি অডিট আপত্তির পরও তাদের হোটেলে দেয়া হচ্ছে সিঙ্গেল রুমের সুবিধা। সিডিউল শাখার এক কর্মকর্তার সহায়তায় এসব হচ্ছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী জুনিয়র পার্সারদের।

তাদের অভিযোগ, ‘সি’ নম্বরধারী ক্যাজুয়াল ক্রু'রা অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য নন। তবুও কেবিন ক্রু অ্যাসোসিয়েশনের বিদায়ী সভাপতি ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক তাদের পক্ষাবলম্বন করেছেন। তাদের ছত্রছায়ায় এ অনিয়ম হচ্ছে।

তবে বিদায়ী সভাপতি আকতারুজ্জামান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ম্যানেজমেন্ট জেনে-বুঝেই সিনিয়র হিসেবে তাদের সুযোগ দিচ্ছে। তাহলে নিয়ম-নীতি সবই কি ভুল- এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে তিনি বলেন, এসব নিয়ে নিউজ করে কী লাভ? ম্যানেজমেন্টের দুর্নীতি ও অনিয়ম বের করে নিউজ করুন।

এদিকে ভুক্তভোগীরা বলছেন, সুবিধাভোগী ‘সি’ নম্বরধারী ক্যাজুয়াল ক্রুদের সিনিয়র বানিয়ে ফ্লাইটে পাঠিয়ে ঠিক মতো সার্ভিস দেয়া যাচ্ছে না। উল্টো বিমানের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। সার্বিক ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠানের। তারা বলেন, বিষয়টি অপমানজনক হওয়ায় বেশির ভাগ স্থায়ী জুনিয়র পার্সার কাজে মনোযোগ হারাচ্ছেন। এ নিয়ে ফ্লাইট সার্ভিসে কর্মরত স্থায়ী শতাধিক জুনিয়র পার্সারের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করলেও অদৃশ্য কারণে নীরব বিমান প্রশাসন।

বিমান সূত্রে জানা গেছে, ভলেন্টারি রিটায়ারমেন্ট স্কিম-ভিআরএস সুবিধা নিয়ে পাঁচ জুনিয়র পার্সার অবসরে যান। এ সময় ৯০ দিনের চুক্তিতে পাঁচজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। অথচ ওই সময় জুনিয়র পার্সার পদে ১০২ অতিরিক্ত জনবল কর্মরত ছিলেন। নতুন নিয়োগ দেয়া পাঁচজনকে নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে।

বিতর্কিত নিয়োগের পর ২০১১ সালে ৩ জুন জুনিয়র পার্সার (দিলরুবা আক্তার নাহিদ/সি-১৬২১, ফাহমিদা পারভিন জয়া/সি-১৬২২, ফারহানা আহমেদ কোয়েল/সি-১৬২৩) এর জ্যেষ্ঠতা পাওয়ার আবেদনের পরিপ্রক্ষিতে বিমান প্রশাসন, আইন বিভাগসহ সকল বিভাগ মতামত দেয় এবং ২০১২ সালের ১ মার্চ জারিকৃত পত্রে (স্মারক নম্বর- ডিএসিসিএন/৩১/২০১২/৭) সুস্পষ্ট উল্লেখ করা হয় যে, ‘স্থায়ী কর্মচারীদের সাথে সি-নম্বরধারী (ক্যাজুয়াল ভিত্তিক) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জ্যেষ্ঠতা একীভূত করার কোনো সুযোগ নেই।’ অর্থাৎ নিয়োগের শর্ত অনুযায়ী ৯০ দিনের জন্য নিয়োগ পাওয়া সি-নম্বরধারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পদোন্নতি বা জ্যেষ্ঠতা পেতে পারেন না।

জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১ অক্টোবর সরকারি অডিটের মন্তব্য ও সুপারিশে উল্লেখিত পত্রে (৮৭১১/সে-২/অ-১/অগ্রীম/বিমান/বিমান বাংলা : এয়া : লি : /ঢাকা/২০১২-১৩/৭৩৩) যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল, সেসব সুপারিশ অনুযায়ী কাজ করেনি বিমান প্রশাসন। সুপারিশে মন্তব্য করা হয়, দৈনিকভিত্তিতে পাঁচজন জুনিয়র পার্সারকে সিঙ্গেল রুমের সুবিধা প্রদান তাদের নিয়োগের শর্তভঙ্গের শামিল।

অডিট সুপারিশে বলা হয়, স্থায়ী জুনিয়র পার্সারদের বহিঃস্টেশনে অবস্থানকালে সিঙ্গেল রুম সুবিধা প্রদানের সপক্ষে বিমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত নীতিমালার কপি প্রেরণ করা এবং দৈনিকভিত্তিক জুনিয়র পার্সারদের নিয়োগপত্রের শর্তবহির্ভূত বহিঃস্টেশনে সিঙ্গেল রুমের সুবিধা প্রদান করে বিমানের আর্থিক ক্ষতির টাকা সংশ্লিষ্ট জিএম, ডিজিএম ও ম্যানেজারের নিকট হতে আদায় করতে হবে।

প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ১২ ডিসেম্বর ১০৭ জন জুনিয়র পার্সার পদে পদোন্নতি পান। এর আগে ২০১১ সালের ৯ অক্টোবর পাঁচ ক্যাজুয়ালকে নিয়োগ দেয়া হয়। তখন জ্যেষ্ঠতা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। জটিলতা নিরসনে কাস্টমার সার্ভিসের জিএম আতিক সোবহান ১৫৭ জনের একটি তালিকা তৈরি করেন। ওই তালিকায় ১৫২ জন ‘পি’ নম্বরধারী বা স্থায়ী জুনিয়র পার্সারকে জ্যেষ্ঠতা প্রদান করে আদেশ জারি করা হয়। ১৫৩-১৫৭ তালিকায় থাকা চারজনকে জুনিয়র হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়। সেই থেকে তারা ‘পি’ নম্বরধারীদের কনিষ্ঠ হিসেবে ফ্লাইট করে আসছেন। সম্প্রতি শিডিউল শাখার এক কর্মকর্তা নিয়ম-কানুন তোয়াক্কা না করে বিতর্কিত ‘সি’ নম্বরধারী ক্রুদের জ্যেষ্ঠতা দিয়ে সমানে ফ্লাইটে পাঠাচ্ছেন।

গত ১৮ ডিসেম্বর ঢাকা-কুয়ালালামপুরের ফ্লাইটে স্থায়ী পদে কর্মরত জুনিয়র পার্সার শামীমা পারভিন শ্যামাকে (৩৫৩৮৮) জুনিয়র বানিয়ে অস্থায়ী জুনিয়র পার্সার ফারহানা আহমেদ কোয়েলকে (১৬২৩) জ্যেষ্ঠতা প্রদান করে ফ্লাইটে পাঠানো হয়। একইভাবে ২২ ডিসেম্বরের ঢাকা-কলকাতার ফ্লাইটে স্থায়ী জুনিয়র পার্সার মোহাম্মদ এনায়েত উল্লাহ হেলালের (৩৫৬৫০) উপরে স্থান দিয়ে অস্থায়ী জুনিয়র পার্সার সাইয়েদা নাজনীন সানজানাকে (১৬১৬) পাঠানো হয়। ২৩ ডিসেম্বরের এফসিপি'তে একই চিত্র লক্ষ্য করা যায়। ওইদিন ঢাকা-কলকাতার ফ্লাইটে স্থায়ী জুনিয়র পার্সার রোজিনা মওলা রোজিকে (৩৫৫১০) জ্যেষ্ঠতা প্রদান না করে অস্থায়ী জুনিয়র পার্সার ফাহমিদা পারভিন জয়াকে (১৬২২) সিনিয়র বানিয়ে ফ্লাইটে পাঠানো হয়।

অফিস আদেশ অমান্য করে স্থায়ীদের উপরে অস্থায়ীদের স্থান দিয়ে কীভাবে ফ্লাইটে পাঠানো হলো- এমন প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে রাজি হননি বিমান পরিচালক (প্রশাসন) এম মোমিনুল ইসলাম। একইভাবে ওইসময় গ্রাহকসেবা বিভাগে দায়িত্ব না থাকার অজুহাত দেখিয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না বলে জানান গ্রাহকসেবা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আলী আহসান বাবু।

এ বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এ এম মোসাদ্দিক আহমেদ বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা প্রায়ই বিব্রত হই। কিন্তু কোনো সমাধান হচ্ছে না। অচিরেই বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধান হবে।

উল্লেখ্য, বিমানের আইন অনুযায়ী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী জ্যেষ্ঠতার জন্য বিবেচিত হবেন না। একই সঙ্গে এফসিপি লিস্টেও তাদের নাম স্থায়ী ফ্লাইটকর্মীদের সঙ্গে তালিকায় উঠবে না। তাদের নাম থাকবে গ্রুপ-৫-এর স্থায়ীকর্মীদের নিচে। কারণ ৯০ দিন পরপর তারা নতুন করে নিয়োগ পান। যে কারণে পদন্নোতিও তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

আরএম/এমএআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।